প্রকৃতিতে চিরন্তন সত্য বলে কিছু ঘটনা আছে। সৃষ্টির শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সেগুলো ঘটে আসছে বিরতিহীনভাবে। সূর্য পূর্ব দিকে উঠে। গ্রহ তার নিজস্ব নক্ষত্রের চারপাশে ঘোরে। প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য অক্সিজেন অপরিহার্য। তবে শেষ বাক্যটা নিয়ে হয়তো এখন নতুন করে ভাবার সময় এসেছে। কারণ, বিজ্ঞানীরা এমন এক প্রাণীর খোঁজ পেয়েছেন, যেটি অক্সিজেন ছাড়াই বাঁচতে পারে।
২০২০ সালে ইসরায়েলের একদল বিজ্ঞানী জেলিফিশজাতীয় একধরনের পরজীবীর খোঁজ পান। এর কোনো মাইটোকন্ড্রিয়াল জিনোম নেই। মাইটোকন্ড্রিয়াল জিনোম ছাড়া স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়া সম্ভব নয়। জীবজগতের প্রতিটি বহুকোষী প্রাণীর মাইটোকন্ড্রিয়াল জিনোম থাকে। জেলিফিশ জাতীয় এই পরজীবীর যেহেতু শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই, তাই বেঁচে থাকার জন্য এদের অক্সিজেনের ওপর নির্ভর করতে হয় না।
এই আবিষ্কার পৃথিবীতে জীবের কার্যকলাপে যেমন নতুন মাত্রা দিয়েছে, তেমনি ভিনগ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনাও বেড়েছে বহু গুণে। কারণ, যে সব গ্রহে অক্সিজেন থাকার সম্ভাবনা নেই, সেখানে প্রাণ থাকতে পারে না বলেই আমরা ভেবে এসেছি এতদিন। সেই ভাবনায় ছেদ পড়ল এই আবিষ্কারের ফলে। অক্সিজেন নেই, এমন গ্রহেও প্রাণ থাকার সম্ভাবনার দুয়ার খুলে গেছে এখন।
পৃথিবীতে জীবনের সূচনা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ১৪৫ কোটি বছর আগে, অক্সিজেন মেটাবলাইজ করার মাধ্যমে। শুরুটা হয়েছিল আর্কিওনের সাহায্যে। আর্কিওন নিজেকে পরিবেশের সঙ্গে মেলাতে গ্রাস করে নিয়েছিল ব্যাকটেরিয়াম। আর্কিওনের সঙ্গে ব্যাকটেরিয়ামও নতুন পরিবেশে বেশ ভালোই মানিয়ে নিয়েছিল।
পরে দুটি আলাদা জীব এক হয়ে পরিবর্তিত হতে শুরু করে। ব্যাকটেরিয়াগুলো পরিণত হয় মাইটোকন্ড্রিয়ায়। ধীরে ধীরে কোষের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গাণু হয়ে ওঠে মাইটোকন্ড্রিয়া। শুধু লোহিত রক্তকণিকা ছাড়া শরীরের প্রতিটি কোষে এ অঙ্গাণু দেখা যায়।
মাইটোকন্ড্রিয়া অক্সিজেন ভেঙে অ্যাডিনোসিন ট্রাইফসফেট বা এটিপি নামে একধরনের জৈব অণু তৈরি করে। এই অণু শরীরের যাবতীয় শক্তির জোগান দেয়। অভিযোজন প্রক্রিয়ায় কিছু কিছু জীব আবার কম অক্সিজেন বা হাইপোক্সিক অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নেয়। কিছু কিছু এককোষী জীব নিজেদের শ্বসন কাজ চালানোর জন্য মাইটোকন্ড্রিয়াজাতীয় কোষ বদলে নিয়েছিল কালের আবর্তে।
কিন্তু অ্যানেরোবিক বহুকোষী জীব নিয়ে একটা বিতর্ক ছিল সব সময়। সেই বিতর্কের অবসান ঘটিয়েছে এই নতুন আবিষ্কার। ইসরায়েলের তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডায়না ইয়াহলোমির নেতৃত্বে গবেষকদের একটি দল হেনেগুইয়া সালমিনিকোলা (Henneguya salminicola) নামে স্যামন মাছের পরজীবী নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এই তথ্য আবিষ্কার করেন।
এই পরজীবী মূলত নিডারিয়া পর্বের প্রাণী। কোরাল, জেলিফিশের সঙ্গে একই ফাইলাম বা পর্বের অংশ এগুলো। স্যামন মাছের পরজীবী হলেও এরা তেমন ক্ষতিকর নয়। বরং স্যামন মাছের পুরো জীবনজুড়েই এরা সঙ্গী হয়ে ঘুরে বেড়ায়। নিডারিয়া পর্বের এই পরজীবী বেশ হাইপোক্সিক পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকতে পারে। তবে এরা ঠিক কীভাবে বেঁচে থাকে, তা নিয়ে প্রশ্ন ছিল গবেষকদের।
গবেষণায় দেখা যায়, এসব পরজীবী তার মাইটোকন্ড্রিয়াল জিনোম হারিয়েছে অনেক আগেই। এমনকি পরজীবী হিসেবে বেঁচে থাকতে থাকতে নিজেদের বায়বীয় শ্বাস-প্রশ্বাসের ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে। এখন তাদের শরীরের প্রতিটি নিউক্লিয়ার জিন মাইটোকন্ড্রিয়ার মতো কাজ করে।
এককোষী প্রাণীদের মতো এদের শরীরে মাইটোকন্ড্রিয়াজাতীয় অর্গানেল বা অঙ্গাণু তৈরি হয়েছে। কিন্তু এই পরজীবীর অঙ্গাণুগুলো বাকিদের চেয়ে আলাদা। এদের ইনার মেমব্রেনে বা কোষের অভ্যন্তরীণ পর্দায় একধরনের ভাঁজ রয়েছে, যা সাধারণত দেখা যায় না। এগুলোর মতোই আরেকটি পরজীবী প্রাণী মাইক্সোবোলাস স্কোয়ামালিস (Myxobolus squamalis), কিন্তু এদের শরীরে মাইটোকন্ড্রিয়াল জিনোম স্পষ্ট দেখা যায়। এখন পর্যন্ত এরাই একমাত্র বহুকোষী প্রাণী, যাদের শ্বসনে অক্সিজেন লাগে না।
হেনেগুইয়া সালমিনিকোলা এখনও গবেষকদের কাছে এক রহস্যের নাম। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট। অনেক বছরের পরিবর্তনের ফলে এক সময় জেলিফিশজাতীয় এ প্রাণী পরিণত হয়েছে পরজীবীতে। জেলিফিশের বেশির ভাগ জিনোম হারিয়ে ফেললেও তাদের আকার জেলিফিশের স্টিংগিং কোষের মতোই আছে। তা দিয়েই স্যামন মাছ আঁকড়ে ধরে এরা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।