নিজস্ব প্রতিবেদক, গাজীপুর : গাজীপুরে অগ্রণী ব্যাংক শ্রীপুর শাখার একাউন্ট থেকে জালিয়াতি করে বিভিন্ন গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে তিন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত ও ব্যবস্থাপককে অপসারণ করে ঢাকার একটি শাখায় নেয়া হয়েছে।
বরখাস্তকৃতরা হলেন- ওই প্রতিষ্ঠানের শ্রীপুর শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার মো. নজরুল ইসলাম, ক্যাশ অফিসার বদরুল হাসান সনি ও ক্যাশ অফিসার মো. দোলোয়ার হোসেন।
অগ্রণী ব্যাংকের বর্তমান ব্যবস্থাপক মো. জাকির হোসেন জানান, এভাবে ব্যাংকের টাকা কারো একার পক্ষে তুলে আত্মসাৎ করা সম্ভব নয়। কী পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ হয়েছে তা জানতে অডিট চলছে। ৩১ আগস্টও ব্যাংকের একাউন্টে জমা করা টাকার গড়মিলের তথ্য ও অভিযোগ নিয়ে গ্রাহকরা এসেছেন। ৩০ আগস্ট পর্যন্ত এক কোটি ৩০ লাখ টাকা উদ্ধার করে গ্রাহকের একাউন্টে জমা করা সম্ভব হয়েছে। যার সবই বদরুল হাসান সনি দিয়েছেন বলে তিনি জানান।
অগ্রণী ব্যাংকের শ্রীপুর শাখার গ্রাহক বদরুন নাহার গত ২৭ আগস্ট ব্যাংক ম্যানেজারের কাছে লিখিত এক আবেদনে জানান, ‘আমার সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর- ৭৪২৯, সম্প্রতি আমি আমার একাউন্টে এক লাখ টাকা জমা করি। বদরুল হাসান সনি প্রতারণা করে আমার কাছ থেকে চেক বইয়ের একটি পাতা (নং-৩৪৩৮৭৯) আত্মসাৎ করেন। পরবর্তীতে ওই চেকের মাধ্যমে তিনি আমার হিসাব থেকে এক লাখ টাকা তুলে নেন। বিষয়টি ধরা পড়লে ব্যাংক ম্যানেজারের মাধ্যমে আমার একাউন্টে ওই টাকা জমা দেন সনি।’
একই অভিযোগ তোলেন ওই ব্যাংক শাখার গ্রাহক জুয়েনা বেগম (হিসাব নম্বর ১৭৪৮০)। তার স্বামী ও ছেলে সৌদি আরবে চাকরি করেন। সেখান থেকে তার একাউন্টে তারা টাকা পাঠান। ১৩ জুলাই তিনি ওই একাউন্টের তথ্য জানতে গিয়ে দেখেন তার একাউন্টে ৮ লাখ ২০ হাজার টাকা কম। পরে বিষয়টি ম্যানেজোরকে অভিযোগ করলে ১৪ জুলাই ৫ লাখ এবং ১৫ জুলাই ৩ লাখ ২০ হাজার টাকা তার একাউন্টে জমা করা হয়। বদরুল হাসান সনির বিরুদ্ধে ওই টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠলে দুই ধাপে ওই টাকা তার হিসাবে জমা করা হয়।
অপর গ্রাহক আফতাব উদ্দিন (হিসাব নম্বর-১৯৭২৫) জানান, ৪ জুন তিন লাখ টাকা তার হিসাবে জমা করেন। ২২ আগস্ট বিকেলে ম্যানেজার জমা ও চেক বইসহ কাগজপত্র নিয়ে তাকে ফোন করে ব্যাংকে যেতে বলেন। পরদিন ব্যাংকে গেলে ম্যানেজার জানান তার একাউন্টে তিন লাখ টাকা কম আছে। পরে ব্যবস্থাপকের কাছে তিন লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করার পর সনি ২৩ জুলাই ওই টাকা তার একাউন্টে জমা করেন।
এ ব্যাপারে ওই ব্যাংকের সাময়িক বরখাস্তকৃত প্রিন্সিপাল অফিসার মো. নজরুল ইসলাম জানান, ক্যাশ অফিসার বদরুল ইসলাম সনি নিজেই গ্রাহকের স্বাক্ষর নকল করে চেক বই উত্তোলন করেছেন। পরে চেকে নিজেই গ্রাহকের স্বাক্ষর দিয়ে টাকা তুলে আত্মসাৎ করেছেন। ওইসব চেক এন্ট্রি করার সময় চেকের নম্বর এন্ট্রি না করেই টাকা তুলে নিয়ে গেছেন সনি। এ ঘটনা ধরা পড়ার পর ম্যানেজার তাকে শাসিয়েছেনও একবার। অনেক সময় গ্রাহক ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে গেলে গ্রাহকের টাকা তার একাউন্টে জমা না করেও তা আত্মসাৎ করেছেন সনি। অর্থাৎ সনি গ্রাহকের টাকা ডেবিট করেও আত্মসাৎ করেছেন আবার ক্রেডিট করেও আত্মসাৎ করেছেন।
নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আগে তাকে আমি অন্ধের মতো বিশ্বাস করতাম। যেকোনো পরিমাণ টাকা উত্তোলন করতে আমার অথরাইজ লাগে। সনি নিজের কম্পিউটারের আইডি লক হওয়ার কথা বলে আমার কম্পিউটার ব্যবহার করে অথবা কৌশল করে সে আমার আইডি ও কম্পিউটার ব্যবহার করে নিজেই অথরাইজ করে গ্রাহকের টাকা নিয়ে গেছে। সম্প্রতি কাপাসিয়া শাখার একজন স্টাফকে এ শাখায় কাজে সহযোগিতার জন্য নিয়ে আসা হয়। এসব বিষয় তার কাছে ধরা পড়ার পরই তিনি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে অবগত করেন। পরবর্তীতে এ ব্যাংকে অডিট কল করে কর্তৃপক্ষ।’
একইভাবে সনি ব্যাংকের ক্যাশ অফিসার দেলেয়ার হোসেনের আইডি ব্যবহার করেও টাকা অথরাইজ করে নিয়ে গেছেন। কাগজে কলমে অথরাইজ করার কাজটিতে দেলোয়ার ও আমার নাম চলে আসায় টাকা আত্মসাতের অভিযোগে দেলোয়ার হোসেন ও আমি সাময়িক বরখাস্ত হয়েছি বলেও জানান তিনি।
তবে নজরুল ইসলামের আইডি ব্যবহার করার কথা অস্বীকার করে বদরুল হাসান সনি বলেন, ‘ব্যাংকের টাকা আমার পক্ষে তুলে নেয়া সম্ভব নয়। টাকা তুলে নিতে চারজনের স্বাক্ষর তথা ভেরিফিকেশন লাগবে। নজরুল ইসলাম আমার সিডি ইনচার্জ। তিনিও আমার কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন।’
সনি গ্রাহকের টাকা তুলে নেয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, শুধু নিজেকে সেভ করার জন্য নিজের জমি বিক্রি করে ও আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে ধার নিয়ে ব্যাংকের ওইসব টাকা শোধ করছি।
তিনি গ্রাহকের চেক বই উত্তোলনের কথাও অস্বীকার করে বলেন, তিনি নিজের চেক বই উত্তোলন করেছেন। অপরাধতো অপরাধই। তিনি যা করেছেন, তা একা করেননি।
বদলিকৃত ব্যাংক ম্যানেজার আব্দুল হালিমের কাছে এ ব্যাপারে জানতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে কথা বলতে রাজি হননি। পরবর্তীতে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের গাজীপুর জোনাল অফিসের উপ-মহাব্যবস্থাপক শামীম আরা সুলতানা গণি সাংবাদিকদের জানান, সম্প্রতি অগ্রণী ব্যাংকের শ্রীপুর শাখায় গ্রাহকদের ব্যাংক হিসাবে সঞ্চিত টাকার গড়মিলের তথ্য জানার পর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরিদর্শনে যান এবং অডিট টিম গঠন করে তদন্ত শুরু করা হয়। প্রাথমিকভাবে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলে গ্রাহকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগে শ্রীপুর শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার মো. নজরুল ইসলাম, ক্যাশ অফিসার বদরুল হাসান সনি ও ক্যাশ অফিসার মো. দোলোয়ার হোসেনকে সাময়িক বরখাস্ত ও শাখার ব্যবস্থাপক আব্দুল হালিমকে ঘটনার ব্যাখ্যা তলব করে অগ্রণী ব্যাংকের ঢাকায় অপসারণ করা হয়েছে। ওই শাখার গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের হিসাবে ব্যালেন্স কনফার্ম করা হচ্ছে। আমরা গ্রাহক এবং এ প্রতিষ্ঠানের যাতে কোনো ক্ষতি না হয় তার জন্য সকল পদক্ষেপ নিয়েছি। আমরা গ্রাহকের টাকা রিফান্ড করার চেষ্টা করছি।