কোনো কিছুর তাপমাত্রা বাড়ানো সহজ। যে বস্তুর তাপমাত্রা বাড়াতে চান, সেটা বেশি তাপমাত্রার কোনো বস্তু বা তাপের উৎসের কাছে রাখলেই হলো। স্বাভাবিক নিয়মে বেশি তাপমাত্রার অঞ্চল থেকে কম তাপমাত্রার অঞ্চলে তাপ প্রবাহিত হয়। তাপগতিবিদ্যার শূন্যতম সূত্র থেকে এটা জানা যায়। এ জন্য আলাদা করে কাজ করতে হয় না। এর মানে, উষ্ণ পরিবেশ বা কাছাকাছি কোনো উত্তপ্ত বস্তু বা তাপীয় উৎস থাকলে ঠান্ডা বস্তু উষ্ণ হবে স্বাভাবিকভাবেই।
কিন্তু কোনো বস্তু ঠান্ডা করা বেশ ঝামেলার। এমনিতে পরিবেশের তাপমাত্রার চেয়ে বস্তুর তাপমাত্রা বেশি হলে সমস্যা নেই। সেই তাপ আপনাতেই ছড়িয়ে পড়বে পরিবেশে। কিন্তু পরিবেশের তাপমাত্রা বস্তুর চেয়ে কম না হলে সেই বস্তু ঠান্ডা করা স্বাভাবিকভাবে অসম্ভব। অর্থাৎ আপনাতেই সেটা হবে না।
কারণটা তো বুঝতেই পারছেন—উত্তপ্ত বস্তুতে শক্তি বেশি থাকে, তাই বস্তুটি তা চারপাশে ছেড়ে দিয়ে একটা ভারসাম্যে আসতে চেষ্টা করে। অন্যদিকে শীতল বস্তুর শক্তি কম। সেটার তাপমাত্রা বাড়ানোর মানে, তাকে শক্তি দিতে হবে বাইরে থেকে। মহাবিশ্বের মৌলিক নিয়মগুলোর একটি এটি।
স্বাভাবিকভাবে না হলেও বিজ্ঞানের কল্যাণে এখন আমরা ঘরের মধ্যেই পরিবেশের চেয়ে কম তাপমাত্রা তৈরি করতে পারি। এয়ার কন্ডিশনিং, ফ্রিজ বা রেফ্রিজেটরের সাহায্যে এটা এখন আর বড় কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু, আগেই যা বলেছি, এসব যন্ত্রের মাধ্যমে বস্তুকে ঠান্ডা করার জন্য প্রয়োজন বাড়তি শক্তি।
বাইরে থেকে অতিরিক্ত শক্তি দেওয়ার মাধ্যমে বস্তুকে পরিবেশের চেয়ে ঠান্ডা করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে একটি সর্বনিম্ন তাপমাত্রা আছে। বেশির ভাগ এয়ার কন্ডিশনিং যন্ত্র সর্বনিম্ন ২০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা মাইনাস ৬.৬৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার কম তাপমাত্রা তৈরি করতে পারে না। ফ্রিজের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা মাইনাস ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
দৈনন্দিন জীবনে এর চেয়ে বেশি ঠান্ডা করার দরকার পড়ে না। তবে বৈজ্ঞানিক নানা গবেষণায় তা দরকার হয়। যেমন ধরুন, কোনো অণু বা পরমাণুকে অনেক শীতল করতে হবে। কী করা যায়? রসিকতা করে কেউ ভাবতেই পারেন, কেন, বিশেষ ফ্রিজে রাখলেই তো হয়! ভাবতে থাকুন, আমরা আগে বিষয়টা একটু বুঝে নিই।
১৮ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ব্রিটিশ পদার্থবিদ উইলিয়াম টমসন (আরেক নাম, লর্ড কেলভিন) গ্যাসের আয়তন এবং তাপমাত্রার সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে তাপমাত্রা নির্ণয়ের নতুন একধরনের মানদণ্ড উদ্ভাবন করেন। এ মানদণ্ড বা স্কেলের নাম কেলভিন স্কেল। এ স্কেলের ০ ডিগ্রি তাপমাত্রাকে বলা হয় পরম শূন্য তাপমাত্রা।
কারণ এ তাপমাত্রায় আদর্শ গ্যাসের আয়তন শূন্য হয়ে যাওয়ার কথা। এর চেয়ে কম তাপমাত্রায় পৌঁছানোর আর উপায় থাকে না তখন। তাত্ত্বিকভাবে অতি শীতল এ তাপমাত্রার অস্তিত্ব থাকলেও বাস্তবে কোনোভাবেই পরম শূন্য তাপমাত্রা অর্জন করা যায় না।
বস্তুর তাপমাত্রা হলো এতে থাকা পরমাণুগুলোর নড়াচড়া বা কম্পন শক্তির (বা পরমাণুর গতিশক্তির) পরিমাপ। তাত্ত্বিকভাবে পরম শূন্য তাপমাত্রায় বস্তুর মধ্যে থাকা পরমাণু এবং পরমাণুতে থাকা কণার গতি একেবারে থেমে যাওয়ার কথা। কিন্তু হাইজেনবার্গের বিখ্যাত কোয়ান্টাম অনিশ্চয়তার নীতি থেকে দেখা যায়, তাত্ত্বিকভাবে পরম শূন্য তাপমাত্রায় কখনোই পৌঁছানো সম্ভব নয়। একটু ব্যাখ্যা করা যাক।
পরমাণু এবং পরমাণুতে থাকা কণাগুলোর গতি শূন্য হলে এদের অবস্থান ও গতি—দুটোই একসঙ্গে নির্ণয় করা যাবে নিশ্চিতভাবে। কিন্তু হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি অনুযায়ী, এটি পুরোপুরি অসম্ভব। এটা শুধু যান্ত্রিক সীমাবদ্ধতা নয়, প্রকৃতির মৌলিক নিয়ম। তা ছাড়া পরমাণুর জগত বা কোয়ান্টাম সিস্টেম একটি সর্বনিম্ন শক্তির ওপর ভিত্তি করে টিকে থাকে। কোনো পরমাণু একদম নিশ্চল হয়ে পড়ার অর্থ, এর শক্তি একদম শূন্য হয়ে যাওয়া। এ কারণেই পরমাণুর নড়াচড়া বা কম্পন একদম শূন্য করে ফেলা যায় না।
পরম শূন্য তাপমাত্রা তৈরি করা না গেলেও এর কাছাকাছি তাপমাত্রায় পৌঁছাতে পারেন বিজ্ঞানীরা। এ জন্য পরমাণু ও এর ভেতরের কণাগুলোর গতি কমিয়ে আনা হয়। গতি কমানোর কাজে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র। চৌম্বকক্ষেত্র ব্যবহার করে পরমাণুর নিউক্লিয়াসে থাকা নিউট্রন প্রোটনের স্পিন বা ঘূর্ণন নিয়ন্ত্রণ করা হয়। ফলে কমানো যায় পরমাণু এবং এতে থাকা কণাগুলোর গতি।
আর গতি কমা মানেই তাপমাত্রা কমে আসা। যে যন্ত্রের সাহায্যে চৌম্বকক্ষেত্র দিয়ে পরমাণুর ভেতরের উপপারমাণবিক কণাগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয়, তা একটি নিউক্লিয়ার বা পারমাণবিক রেফ্রিজারেটর। (ভাবছেন, রসিকতাটা এভাবে সত্যি হয়ে গেল!) এভাবে রোডিয়াম ধাতুর তাপমাত্রা কমিয়ে ০.০০০০০০০০১ কেলভিনে নামিয়ে আনেন যুক্তরাষ্ট্রের অল্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক। সেটা ২০১৩ সালের ঘটনা।
বিজ্ঞানীরা গবেষণার কাজে প্রায়ই এমন শীতল তাপমাত্রা তৈরি করেন। এখন পর্যন্ত মানুষের তৈরি সর্বনিম্ন তাপমাত্রা হলো এক কেলভিনের ৩৮ ট্রিলিয়নের ভাগের এক ভাগ বা ৩৮ পিকোকেলভিন (৩৮-১৫ কেলভিন)। আর ২০২১ সালে এ তাপমাত্রা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন জার্মানির ব্রেমেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।