জুমবাংলা ডেস্ক: বাংলাদেশের ফ্যাশন সচেতন একটি বড় অংশের নারীর কাছে দিল্লী বুটিক্সের কুর্তি, আনারকলি, অথবা গাউন খুবই পছন্দের ও জনপ্রিয়ও বটে। নান্দনিক ডিজাইনের এইসব পোশাকের সমাহার নিয়ে রেড রোজ ক্রিয়েশন এর যাত্রা শুরু করে ২০১৭ সালের প্রথম দিকে। লিলা রোজারিও এই অনলাইন ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছে তার একাগ্রতা ও প্রচেষ্টা দিয়ে।
তার উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার লিলা রোজারিও। প্রথম প্রশ্নটি ছিল ‘কবে থেকে স্বপ্নটাকে আসলে দেখতে শুরু করেছেন?’ সাবলিল ভাবে উত্তর দিলেন প্রাণবন্ত এই মানুষটি। আসলে সপ্নের শুরু ২০০৯ সালের দিকে যখন আমার সাথে পরিচয় হয় একজন সপ্নবাজ মানুষের সাথে যে আজকে আমার হাজবেন্ড। আমার স্বপ্নগুলো সত্যিকারে রুপ দিতে এই মানুষটি প্রথম দিন থেকে অনুপ্রেরনার জোগান দিয়ে যাচ্ছে তারই ফলসরূপ রেড রোজ এর পথচলা শুরু হয় ২০১৫ সালে।
লিলা রোজারিও বলেন, ‘আমি চেয়েছিলাম এমন কিছু একটা পণ্য নিয়ে কাজ করবো যা এক শ্রেণীর মানুষের কাছে অত্যান্ত জনপ্রিয় এবং ব্যাবসা বান্ধব ও ঘরে বসে পরিচালনা করা যায়। যাত্রা শুরুর প্রথম দিকে কোন ভাবেই আগাতে পারছিলাম না আমাদের কাঙ্খিত লক্ষের দিকে, পরিবার (দুই বাচ্চা), চাকুরি সব মিলিয়ে অনেক চড়াই উত্রাই পার করে ২০১৭ সালের প্রথম দিকে রেড রোজ ক্রিয়েশন তার ব্যাবসায়িক যাত্রা শুরু করল একটি মেলায় অংশগ্রহনের মাধ্যমে, আমি আর আমার কাজিন “মুমু রোজারিও” দুজন মিলে সেই মেলায় একটি স্টল ভাড়া করি, যদিও স্টল ভাড়া আমরা উঠাতে পারিনি সেই মেলা থেকে। থেমে থাকিনি একটার পর একটা করে ৩ বছরে প্রায় ১০০টিরও বেশি মেলা / একজিভিশনে অংশগ্রহন করেছি। কিন্তু ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের পর থেকে আমরা শুধু অনলাইনেই আমাদের ব্যাবসা পরিচালনা করছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নটা আমাকে নাড়া দিয়েছিল যখন আমি ক্লাস নাইন কিংবা টেন পড়ি, তখন থেকে। কেন নাড়া দিয়েছিল এখনও আমার অজানা। তবে তখন থেকেই আমি টাকা খরচ না করে জমাতে পছন্দ করতাম। খুব একটা শান্ত স্বভাবের মানুষ ছিলাম না আমি, কম কথা বলতাম কিন্তু দুরন্ত ছিলাম। কিন্তু চিন্তা করতাম অনেক বেশি, কিভাবে ১ টাকা থেকে ২ টাকা বানানো যায় এসব নিয়ে ভাবতাম অনেক। উদ্যোক্তাই যে হবো এমন কখনও ভাবিনি ছোটবেলায়। কখনো মনে হতো ব্যাংকার হবো, কখনো আবার মনে হতো নিউজ প্রেজেন্টার হবো, আমার এনজিও তে চাকুরি করার অনেক বড় স্বপ্ন ছিল। হয়তো এনজিও তে চাকুরি পাইনি বলেই রেড রোজ ক্রিয়েশনের জন্ম হয়েছে। ’তিনি আরও বলেন, ‘এইসএসসির পাস করার পর থেকেই উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নটাকে একেবারে শক্ত করে আঁকড়ে ধরেছি।’
লিলা রোজারিও জানান, ‘আমার বাবা একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন, তিনি সব সময়ই চাইতেন আমি যেন শুধু পড়াশোনা করি এবং নিজের পায়ে দাড়াতে পারি, তবে পড়াশোনার পাশাপাশি কাজকে আমি অনেক বেশি গুরুত্ব দেই, আমি মনে করি, পড়াশোনা করার পর কেউ যদি কাজ না করেন তাহলে অনেক সময় তাকে ডিপ্রেশনে চলে যেতে হয়, তাই পড়াশোনাকে পাশে রেখে বিভিন্ন অ্যাক্টিভিটিজ করলে পড়াশুনা শেষে কাজ পেতে বা করতে অনেক কাজে দেয়, তা আমি মনেপ্রানে বিশ্বাস করি, এইজন্য আমি যখন অনার্স পড়ি ঠিক তখন থেকেই পার্ট টাইম কাজ করতে শুরু করেছি, এই পর্যন্ত আমি ৪টা কোম্পানিতে কাজ করার সুযোগ পেয়েছি, আমার মনে আছে আমার প্রথম স্যালারি ছিল ৬০০০ টাকা সেখান থেকে আমি ১৫০০ টাকার একটি ডি পি এস করেছিলাম ভবিষ্যতের জন্য, চাকুরি করতে গিয়ে আমি শিখেছি অনেক কিছু তাই হয়তো আজকে নিজের এই ছোট উদ্যোগটাকে আস্তে আস্তে করে আরও বড় করতে সাহস ও শক্তি পাচ্ছি।’
অনুপ্রেরনার উৎস জানতে চাইলে তিনি মুচকি হেসে বলেন, ‘একজনেরই নাম সে হল তার হাজবেন্ড টেড সেতু ঘোষ, যে তার চাকুরির পাশাপাশি উৎসাহ দিয়ে চলেছে আরও স্যামনে এগিয়ে যাওয়ার। যেহেতু সে Marketing Professional তাই আমার সকল Marketing Strategy তার কাছ থেকে ধার করতে হয়, পুরোও Digital Marketing তারই তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। কাজের পাশাপাশি সে আমাকে যে সাপোর্ট টুকু দেন আমার ধারনা এই সাপোর্ট টুকু একজন Wife এর জন্য অনেক বড় পাওয়া। তাছাড়া আমার শ্বশুর, শাশুড়ি, বড় বোন এবং তার হাজবেন্ড আমাকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করে। সবার দেওয়া সাহস এবং সহযোগিতা ছাড়া আসলেই নতুন কিছু সুন্দর ভাবে গুছিয়ে করা সম্ভব না।’
প্রোডাক্ট সম্পর্কে জানতে চাইলে লিলা রোজারিও বলেন, ‘আমরা এখন দিল্লী, জয়পুর, যোধপুর, ব্যাঙ্গালুরু, চেন্নাই এবং লাখনউ থেকে আমাদের প্রোডাক্ট সোর্স করি। আমারা সরাসরি Manufacturer থেকে প্রোডাক্ট Import করি তাই এগুলোর কোয়ালিটি অসাধারণ এবং দামেও বেশ রিজনেবল। Authentic প্রোডাক্টের নিশ্চয়তা আমরা দিচ্ছি Confidence এর সাথে কারন আমরা আমাদের কোয়ালিটি নিয়ে অত্যান্ত একনিষ্ঠ। আগামি দিনে আমরা আমাদের ঝুড়িতে লেডিস ফ্যাশনের পাশাপাশি যোগ করতে যাচ্ছি লাইফস্টাইল, কমেটিক্স, টয়লেট্রজ, মেক-আপ, জুয়েলারি, হেলথ কেয়ার, হোম কেয়ার ও অরগানিক প্রোডাক্টস।’
ভার্চুয়ালি কিভাবে অপারেশন চালাচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অন্যান্যরা যেভাবে Showroom খুলে ব্যাবসা করে আমরা করছি অনলাইনে কারন আমরা আমাদের কাস্টমারের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের Showroom পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে ভিজিট করা যায়। www.redrozcreation.com এবং ওয়েব সাইটের পাশপাশি একটি ফেসবুক পেইজ দিয়ে আমরা আমাদের Operation চালাতে সক্ষম হচ্ছি। https://www.facebook.com/redroz.creation এখন আমাদের ওয়েব সাইটটাকে একটি ই কমার্স ওয়েব সাইটে রূপান্তর করার কাজে হাত দেওয়া হয়েছে।
শো-রুম খোলা নিয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি জানান, আপাততঃ এই রকম চিন্তা ভাবনা আমরাদের নেই, বিশ্বব্যাপি এই করোনা পরিস্তিতি ঠিক হলে এই বিষয়ে আরও ভালও করে চিন্তা করা যাবে।
জমে উঠা আড্ডার এক পর্যায়ে একটি প্রশ্নের দারুণ ভাবে উত্তর মিলে গেলো। প্রশ্নটি ছিল—‘একজন উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য কোন গুণটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন?’
এমন প্রশ্নের জবাবে লিলা রোজারিও বলেন, ‘আমি বলব, সবচেয়ে বেশি যে জিনিসটা প্রয়োজন তা হলো একাগ্রতা, যেকোন কাজকে ভালোবেসে আনন্দের সাথে করা । কারণ অনেকেই ডাক্তারি পাশ করে ডাক্তারি পেশা ছেড়ে অন্য কিছু করছে। আমরা এরকমও দেখেছি যে, অনেকে পাইলট থেকে নায়ক হয়েছেন, মডেলিং করে সফল হয়েছেন। আমি মনে করি, তিনি কী করতে পছন্দ করেন; সেটা তার সবচেয়ে আগে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। তারপর সেই কাজে হাত দেওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে ইচ্ছাশক্তি ও অধ্যবসায় খুব প্রয়োজন। এই দুটি থাকলে যেকোনো কাজ করা সম্ভব।’
আপনার পেজ ঘুরে আপনার লাইভ দেখলাম অভিভূত হলাম আপনার স্মার্ট প্রেজেন্টেশন দক্ষতা দেখে। লাইভ সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা যদি সবাইকে শেয়ার করেন এবার তিনি জোরে হেসে বললেন এর ক্রেডিট সম্পূর্ণই আমার হাজবেন্ডের তার উৎসাহ আমাকে আজকে লাইভে এসে কথা বলতে সাহায্য করেছে, আমি কখনওই ভাবিনি আমি লাইভে এসে কথা বলব। গত বছরের লকডাউনে আমি অনুপ্রাণিত হয় এই অসাধ্য সাধনের জন্য। লকডাউনের সময় আমাদের দুইজন লাইভ আর্টিস্ট কোনভাবেই লাইভ করতে পারছিলেন না তাই তাদের কাজটা নিজেই শুরু করলাম বুঝতে পারলাম লাইভে এসে কথা বলা সহজ কোন বিষয় না। ওদের কাছথেকে লাইভ সম্পর্কে শিখেছি অনেক কিছু। তারপর ও থ্যাঙ্ক ইউ মিঃ হাজবেন্ড আমাকে উতসাহ দিয়ে লাইভ প্র্যাকটিস করানোর জন্য।
তরুণদের উদ্দেশ্যে কিছু বলুন, ‘আমি তরুনদের সম্পর্কে বলবো তাদের স্বপ্নটা আসলে সত্যিকারের স্বপ্ন কি-না, তা তাদেরকে বুঝতে হবে। তাদের উপরে ওঠা সম্বন্ধে কতখানি ধারণা আছে তা তাদের নিজেদেরই জানতে হবে। অনেকের ধারণাই নেই, কতটুকু উপর পর্যন্ত ওঠা যায়। সবাই এখন একটা চাকরি পাওয়ার জন্য উদগ্রীব এবং সবাই সব কিছু পারে এমনই মনোভাব সবার ভেতরে। কিন্তু কি পারে না তার কোন ধারনা নেই, তাই তরুনদের এই ধারনাটাও থাকতে হবে। আমি লিলা রোজারিও যে জিনিসটা বিশ্বাস করি তা হল তরুণ প্রজন্মের জানা উচিত সর্বোচ্চ কোন জায়গা পর্যন্ত যাওয়া যেতে পারে। সর্বোচ্চ কতখানি পরিশ্রম করলে সফল হওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে তরুণদের বলবো, যারা অনেক কাজ করছেন, কাজের পাশাপাশি বিশ্রাম ও বিনোদনেরও প্রয়োজন তাই বিশ্রাম ও বিনোদন নিতে কার্পন্য করা যাবে না। তরুণ প্রজন্মের অনেক গুণের মধ্যে আমি ইচ্ছাশক্তি দেখতে চাই, পরিশ্রম দেখতে চাই, সততা দেখতে চাই। ইচ্ছাশক্তি, পরিশ্রম ও সততা হল সাফল্যের চাবিকাঠি।
আমাদের দেশে আরও বেশি তরুন উদ্যোক্তার প্রয়োজন। বিগত ৩ বছরে আমি দেশের অনেক নারী উদ্যোক্তাদের সাথে বিভিন্ন প্রোগ্রামে / মেলায় মিলিত হয়েছি। আমি দেখেছি তাদের ইচ্ছা ও উৎসাহের বহিঃ প্রকাশ তাই সবসময় আমি চাই ঘরে ঘরে অন্তত একজন নারি উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখুক, হয়ে দেখাক এক এক জন সফল উদ্যোক্তা। ধীরে ধীরে বড় উদ্যোক্তা তৈরি হলেই একসময় আমাদের দেশ আরও বেশি স্বনির্ভর হবে আর তখন আমাদের পেছনে ফিরে তাকাতে হবে বলে আমার মনে হয় না।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।