জুমবাংলা ডেস্ক : অপমান আর বঞ্চনার নানা অভিযোগ তুলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অধস্তন আদালতের বিচারকরা। ছোট কোনো ইস্যু, এমনকি ভুল তথ্যের ভিত্তিতে আদালতে ডেকে দাঁড় করিয়ে রাখা, কিছু আইনজীবীর উচ্ছৃঙ্খল আচরণ ও প্রশাসন ক্যাডারের কিছু কর্মকর্তার অসৌজন্যমূলক আচরণের বিচার না পাওয়াসহ তাদের সঙ্গে নানা বৈষম্যের ঘটনা ঘটছে বলে দাবি করেছেন তারা।
সর্বশেষ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ সোহেল রানাকে এক মাসের জেল ঘোষণার রায় যেন ওই ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢেলেছে। ক্ষুব্ধ বিচারকরা ঘটনার দিনই বৃহস্পতিবার (১২ অক্টোবর) রাতে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করে তাদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন।
অধস্তন আদালতের বিচারকদের সংগঠন জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে দুই ঘণ্টাব্যাপী ওই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীসহ আশপাশের এলাকার শতাধিক বিচারক উপস্থিত হন। বৈঠকে উপস্থিত একাধিক বিচারকের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
অতীতের নানা ঘটনা তুলে ধরে বিচারকরা বৈঠকে আইনমন্ত্রীকে বলেছেন, বিভিন্ন সময়ে র্যাব-পুলিশ ও নির্বাহী বিভাগের কর্মকর্তাদের হাতে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা লাঞ্ছিত হয়েছেন। কিন্তু কোনো বিচার হয়নি। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি আইনজীবী সমিতিতে আইনজীবীদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণের শিকার হয়েছেন, তাদেরও বিচার হয়নি। এমনকি কোনো কোনো ঘটনায় আইনজীবী নেতাদের হাইকোর্টে তলব করা হলেও তারা আদালতের কাছে ক্ষমা পর্যন্ত চাননি। প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা ও আইনজীবীরা আদালত অবমাননা করলে ক্ষমা চাওয়ার পর তা মঞ্জুর করা হয়েছে। অথচ সামান্য অপরাধে একজন বিচারক ক্ষমা চাওয়ার পরও তাকে জেলে পাঠানোর আদেশ দেওয়া হলো। অভিভাবক হয়েও নমনীয় দৃষ্টিতে দেখতে পারলেন না বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা।
বৈঠকে বিচারকরা আরও বলেন, অধস্তন আদালতের বিচারকদের কথায় কথায় উচ্চ আদালতে তলব করা হয়। এতে করে সমাজ, পরিবার ও কর্মস্থলে বিচারকদের অপমানিত হতে হয়। এ ছাড়া ভীতসন্ত্রস্ত থাকতে হয়।
বিচারকরা বলেন, তাদের সব সময় কাজের চাপে থাকতে হয়। দিন-রাত পরিশ্রম করতে হয়। এর মধ্যে ভুলভ্রান্তি হতেই পারে। ভুলভ্রান্তি আর অপরাধ এক জিনিস নয়। ভুল করলে ক্ষমা করাটাই স্বাভাবিক। অপরাধ করলে তাকে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারে। ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করতে পারে। কিন্তু এভাবে জেল দিতে পারে না। এ ঘটনায় বিচারকরা নিজেদের অভিভাবকহীন বলে মনে করছেন।
তারা প্রশ্ন রেখে আইনমন্ত্রীকে বলেছেন, কোন আইনের ভিত্তিতে এভাবে বিচারকদের কাঠগড়ায় ডাকা হচ্ছে? ছোটখাটো ইস্যুতে এভাবে তলব করা হলে জুডিশিয়াল অফিসার্স প্রটেকশন অ্যাক্ট রয়েছে কেন? বৈঠকে তারা জুডিশিয়াল অফিসার্স প্রটেকশন অ্যাক্টের বাস্তবায়ন দাবি জানিয়ে বলেছেন, বিচারকদের কথায় কথায় এভাবে তলব করা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া বিচারক সোহেল রানাকে জেল দেওয়ার ঘটনায় কর্মবিরতি পালনের কর্মসূচি ঘোষণার এবং বিবৃতি দেওয়ার জন্য জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান বিচারকরা।
পরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও জুডিশিয়াল অফিসার্স প্রটেকশন অ্যাক্ট বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়ার বিচারকদের দাবির প্রতি সম্মতি জানান। এ ছাড়া গাড়ি নগদায়নের সুবিধা প্রদানসহ নানা সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দেন। তিনি বিষয়গুলো নিয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলবেন বলেও জানান। এসব বিষয়ে জানতে গতকাল সন্ধ্যায় ফোন করা হলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তিনি বলেছেন, ‘এ ব্যাপারে কিছু বলব না। তবে আমি বিষয়টি দেখছি।’ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব সিনিয়র জেলা জজ মোঃ মজিবর রহমানও এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি শুধু বলেছেন, ‘আমরা একটা স্বাস্থ্যকর পরিবেশ চাই।’
এর আগে বৃহস্পতিবার সকালে আদালত অবমাননার দায়ে বিচারক সোহেল রানাকে ৩০ দিনের জেল-জরিমানার আদেশ দেন বিচারপতি মোঃ বদরুজ্জামান ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলনের হাইকোর্ট বেঞ্চ। পরে তার আইনজীবী, হাইকোর্টের একই বেঞ্চের কাছে জামিন চেয়ে আবেদন করেন। পরে জেল দেওয়ার তিন ঘণ্টার মাথায় হাইকোর্টের একই বেঞ্চ আপিলের শর্তে ৩০ দিনের জামিন দেন বিচারক সোহেল রানাকে। এরপর বিচারক সোহেল রানার আইনজীবী হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করেন। বিকেলেই এই আবেদনের শুনানি হয় আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতির আদালতে। শুনানি নিয়ে চেম্বার বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বিচারক সোহেল রানাকে হাইকোর্টের দেওয়া সাজার রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করেন।
জানা যায়, একটি মামলার বিচারিক কার্যক্রম স্থগিত থাকার পরও এক আসামিকে পলাতক ঘোষণার আদেশ দেওয়ায় বিচারক সোহেল রানাকে তলব করা হয়। উচ্চ আদালতের আদেশ উপেক্ষার বিষয়ে অবস্থান ব্যাখ্যা করতে ওই বিচারককে গত ১৪ আগস্ট তলব করেন। ধার্য তারিখে তিনি হাইকোর্টে হাজির হয়ে জবাব দাখিল করেন। তবে জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় গত ২৮ আগস্ট সোহেল রানার প্রতি স্বতঃপ্রণোদিত আদালত অবমাননার রুল দেন হাইকোর্ট।
পাশাপাশি ৯ অক্টোবর তাকে হাইকোর্টে হাজির হতে নির্দেশ দেওয়া হয়। আদালত অবমাননার রুলের পর গত ৩১ আগস্ট সোহেল রানা মামলাটির অভিযোগ গঠনের আদেশ প্রত্যাহার করেন। এ ছাড়া বিচারক সোহেল রানা নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তবে তার ক্ষমা প্রার্থনা গ্রহণ না করে হাইকোর্ট তাকে জেল দেন।
এদিকে বিচারক সোহেল রানাকে জেল দেওয়ার ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশের পরপরই বৃহস্পতিবার দুপুরেই বিচারকরা ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুরু করেন। সেদিন দুপুরের পর ঢাকার বেশকিছু আদালতের বিচারকাজও কিছু সময় বন্ধ ছিল। বিচারকরা কর্মবিরতে যাওয়ার ঘোষণার দাবি তুলেছিলেন বলেও জানা যায়। পরে জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষ থেকে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের আয়োজন করা হয়। সে অনুযায়ী বৃহস্পতিবার রাতে বৈঠক হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিচারকরা জানান, বৈঠকে বেশ কয়েকজন বিচারক তাদের ক্ষোভের কথা বলেন। কয়েকজন বিচারক নিজেদের অভিভাবকহীন বলে মন্তব্য করেন। বৈঠকে উপস্থিত বিচারকরা আইনমন্ত্রীকে বলেন, সুপ্রিম কোর্ট আমাদের অভিভাবক। আমরা বিচার বিভাগের সদস্য। সংবিধান ও আইনের আলোকে বিচারকাজ করাই আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। এ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক সময় আমাদের ভুলভ্রান্তি হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে অভিভাবক হিসেবে সুপ্রিম কোর্ট আমাদের ভুলভ্রান্তিগুলো নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিবেচনা করে সংশোধনের সুযোগ দেবেন, সেটাই প্রত্যাশা করি। যাতে করে ভবিষ্যতে দায়িত্ব পালনে আমরা সচেষ্ট হতে পারি।
বিচারকরা মন্ত্রীকে আরও বলেন, দণ্ডিত বিচারক দুই দফায় নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন। উচ্চ আদালত ক্ষমার আবেদন গ্রহণ করে সংশ্লিষ্ট বিচারককে ক্ষমা করে দিতে পারতেন। এমনকি বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দেওয়ারও সুযোগ হাইকোর্টের সামনে ছিল। জেল ও জরিমানার পরিবর্তে ভিন্ন আদেশ দিলে অধস্তন আদালতের বিচারকরা সবচেয়ে উপকৃত হতেন।
একজন বিচারক বৈঠকে বলেন, বিচারকের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের পর কুষ্টিয়ার এসপি নিঃশর্ত ক্ষমা পান। ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন বার সমিতির সভাপতি-সেক্রেটারিরা উচ্ছৃঙ্খল আচরণ থেকে ক্ষমা পেয়ে যান। আর বিচারকরা মাফ চেয়েও মাফ পান না। এটা অত্যন্ত লজ্জার, অত্যন্ত দুঃখজনক। বিচারকরা যেখানে সংবিধান রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছেন, সেখানে তারা শঙ্কিত, আতঙ্কিত।
দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে উল্লেখ করে একজন বিচারক বৈঠকে বলেন, আর অপমান সহ্য করতে চাই না। কার্যকর পদক্ষেপ চাই। ভুল-ভ্রান্তি হতে পারে। সেই ভুল-ভ্রান্তি থেকে থেকে প্রটেকশনের ব্যবস্থা রয়েছে জুডিশিয়াল অফিসার্স প্রটেকশন অ্যাক্টে। বিচারকের বিচারকাজের জন্য কোনো শাস্তি দেওয়া যাবে না বা বিচারের মুখোমুখি করা যাবে না বলে ওই আইনে উল্লেখ রয়েছে। একই ধরনের সুরক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে দণ্ডবিধির ৭৭ ধারায়ও। বিচারকরা বৈঠকে নিজেদের সুরক্ষা চান।
বৈঠকে নানা বৈষম্য তুলে ধরে বিচারকরা বলেন, ইউএনওদের জন্য ২৬১টি গাড়ি দিতে ৩৮০ কোটি ব্যয় করে সরকার। অথচ গাড়ি নগদায়নের সুবিধা বিচারকদের দীর্ঘদিনের দাবি।
গাড়ি কেনার জন্য মাত্র ৩০ লাখ টাকা ঋণ পান না উল্লেখ করে বিচারকরা বলেন, যে আসামিকে আদালতে আনতে ২০-৩০ জন পুলিশ লাগে, সেসব আসামির বিচার শেষে বিচারককে রিকশায় করে বাসায় ফিরতে হয়। এসব বৈষম্য দূর করার আহ্বান জানান তারা।
পরে আইনমন্ত্রী বিচারকদের উদ্দেশে বক্তব্য দিতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন বলে বৈঠক সূত্রে জানা যায়। মন্ত্রী, বিচারকদের অভয় দিয়ে, নিরপেক্ষভাবে, সতততার সঙ্গে বিচারকাজ পরিচালনা করতে বলেন বিচারকদের। তিনি বিষয়গুলো নিয়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে শনিবার কথা বলবেন বলেও জানান। ৎ
এ ছাড়া বৈঠকে শিগগিরই বিচারকদের গাড়ি নগদায়ন সুবিধার দাবি পূরণ করার ঘোষণা দেন মন্ত্রী। বৈঠকে আইন সচিব মোঃ গোলাম সারওয়ার, অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এএইচএম হাবিবুর রহমান, মহাসচিব ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোঃ মজিবুর রহমানসহ বিচারকরা উপস্থিত ছিলেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।