রোজা আক্তারের চোখে তখন স্বপ্ন। প্রথম বেতনে কিনতে চান স্মার্টফোনটি। ফেসবুক পেজটির অফারটা অসাধারণ লাগলো – দোকানের দামের চেয়ে প্রায় তিন হাজার টাকা কম! উৎসাহে বুক ভরে গেল তার। বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দিলেন তাড়াহুড়ো করে। ঘণ্টা গড়াল, দিন গড়াল… ফোন এল না। পেজটিও উধাও। হঠাৎ করেই টের পেলেন, কয়েক মাসের কষ্টার্জিত টাকার সাথে সাথে হারিয়ে গেল তার বিশ্বাসও। রোজার মতো হাজারো বাংলাদেশি প্রতিদিন অনলাইন কেনাকাটার সুবিধা নিচ্ছেন, কিন্তু রোজার মতো অনেকেই পরিণত হচ্ছেন প্রতারণার শিকারে।
এই ডিজিটাল যুগে শপিং মল থেকে হাতের মুঠোয় এসেছে কেনাকাটার সুবিধা। কিন্তু এই সুবিধার সাথে জড়িয়ে আছে নানা রকমের ঝুঁকি। অনলাইন শপিংয়ে নিরাপদ থাকুন – এই স্লোগানটি আজকের সময়ের অপরিহার্য দাবি। শুধু সচেতনতাই পারে আপনার কঠোর পরিশ্রমের টাকা এবং ব্যক্তিগত তথ্যকে সুরক্ষিত রাখতে। এই গাইডে আমরা শিখবো কীভাবে সহজেই এড়ানো যায় অনলাইন প্রতারণার ফাঁদ, চিনে নেওয়া যায় বিশ্বস্ত বিক্রেতাকে, এবং জানবো সমস্যায় পড়লে কী করণীয়।
অনলাইন শপিংয়ে ঠকানোর সাধারণ কৌশলগুলো জেনে নিন
অনলাইন জালিয়াতিরা প্রতিনিয়তই তাদের কৌশল বদলাচ্ছে, নতুন নতুন ফাঁদ পেতেছে। কিন্তু কিছু প্রচলিত পদ্ধতি বারবারই ব্যবহৃত হয়। এগুলো চিনতে পারলেই আপনি সুরক্ষিত থাকতে পারবেন অনেকাংশেই।
ভুয়া ওয়েবসাইট ও সোশ্যাল মিডিয়া পেজ:
এটি সবচেয়ে প্রচলিত পদ্ধতি। জালিয়াতিরা জনপ্রিয় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম (যেমন: Daraz, Evaly-র নাম ব্যবহার করা হতো, AjkerDeal) বা ব্র্যান্ডের (Samsung, Apple) হুবহু নকল ওয়েবসাইট বা ফেসবুক পেজ তৈরি করে। ডোমেইন নেমে সামান্য পরিবর্তন থাকে (যেমন:daraz-bd.com
বাsamsunghub.com.bd
)। অসাধারণ ডিসকাউন্টের লোভ দেখিয়ে পেমেন্ট নেওয়া হয়, কিন্তু পণ্য কখনোই ডেলিভারি করা হয় না। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) সাইবার সিকিউরিটি সেলের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে শুধুমাত্র ঢাকাতেই ভুয়া ই-কমার্স সাইট ও পেজের মাধ্যমে প্রতারণার ঘটনা ৩৫% বৃদ্ধি পেয়েছে।প্রি-পেমেন্ট স্ক্যাম (অগ্রিম পেমেন্টের ফাঁদ):
বিক্রেতা আপনাকে প্রলোভন দেখাবে যে পণ্যটি এখনই অর্ডার করতে হবে, নাহলে স্টক শেষ! বা অগ্রিম কিছু টাকা (৫০%, ১০০%) পাঠালেই পণ্য রিজার্ভ হয়ে যাবে। বিশেষ করে ফেসবুক মার্কেটপ্লেস বা ইন্সটাগ্রামে পরিচয়হীন বিক্রেতাদের ক্ষেত্রে এটি বেশি ঘটে। টাকা পাঠানোর পর বিক্রেতার ফোন বন্ধ, মেসেজের উত্তর আসে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (এফআইইউ) বারবারই ভোক্তাদের অপরিচিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানে পেমেন্ট করার আগে যাচাই-বাছাই করার তাগিদ দিয়েছে।ফিশিং লিংক ও ফেক অর্ডার কনফার্মেশন:
আপনি হয়তো একটি ই-মেইল বা এসএমএস পাবেন, যাতে বলা হবে আপনার অর্ডার (যা আপনি দেননি) পেমেন্ট বাকি আছে বা ডেলিভারি সমস্যায় পড়েছে। লিংকে ক্লিক করলেই আপনাকে একটি নকল লগইন পেজে নিয়ে যাওয়া হবে, যেখানে আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) যেমন বিকাশ, নগদ, রকেটের ডিটেইলস চাওয়া হবে। এই তথ্য চলে গেলেই জালিয়াতিরা আপনার অ্যাকাউন্ট খালি করে দিতে পারে। বাংলাদেশ সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশনের তথ্য মতে, ফিশিং আক্রমণে ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে ৫০% বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে।নিম্নমানের বা ভিন্ন পণ্য পাঠানো:
কখনো কখনো পণ্য আসে ঠিকই, কিন্তু অর্ডার দেওয়া ব্র্যান্ডের জায়গায় আসে নিম্নমানের বা পুরোপুরি ভিন্ন কোনো পণ্য। ফোনের বক্সে স্যামসাং লোগো, ভেতরে থাকে নাম না-জানা কোম্পানির সেট! বা ফ্যাশনের জিনিসের ছবি এক, আসল পণ্য সম্পূর্ণ আলাদা। এই ক্ষেত্রে রিটার্ন বা রিফান্ডের প্রক্রিয়াও জটিল করে রাখে অসাধু বিক্রেতারা।- ডেলিভারি চার্জ বা এক্সট্রা ফি’র নামে টাকা আদায়:
পণ্য ডেলিভারির সময় কুরিয়ার পার্সন বা বিক্রেতা ফোন করে অতিরিক্ত টাকার দাবি করতে পারে – যেমন ‘প্যাকেজিং চার্জ’, ‘কাস্টমস ডিউটি’, ‘স্পেশাল হ্যান্ডলিং ফি’ ইত্যাদি নামে। এই ফাঁদে সাধারণত সেইসব গ্রাহকরা পড়েন যারা ইতোমধ্যেই পূর্ণ পেমেন্ট করেছেন বলে ভাবেন।
অনলাইন শপিংয়ে নিরাপদ থাকার প্রমাণিত কৌশল
ঝুঁকি আছে জেনেও অনলাইন শপিং বন্ধ করার দরকার নেই। কিছু সহজ কিন্তু কার্যকরী সতর্কতা মেনে চললেই আপনি নিরাপদে থাকতে পারেন। অনলাইন শপিংয়ে নিরাপদ থাকুন এই মন্ত্রটি মনে রেখে নিচের স্টেপগুলো অনুসরণ করুন:
বিক্রেতার বিশ্বস্ততা যাচাই করুন (গভীরভাবে):
- ওয়েবসাইট: ঠিকানা (About Us, Contact Us) স্পষ্ট আছে? ফিজিক্যাল অ্যাড্রেস ও ফোন নম্বর দেওয়া আছে? গুগল ম্যাপে সেই ঠিকানা চেক করুন। ডোমেইন নেম সঠিক কিনা দেখুন (যেমন:
daraz.com.bd
,chaldal.com
–.com.bd
বা.bd
থাকা ভালো লক্ষণ)।https://
এবং লক (🔒) আইকন আছে কিনা খেয়াল করুন (এটি ডাটা এনক্রিপ্টেড হওয়ার নির্দেশক)। - ফেসবুক/সোশ্যাল মিডিয়া পেজ: পেজ কবে তৈরি হয়েছে? (‘Page Transparency’ চেক করুন)। পেজের রিভিউ বা রেটিং কেমন? সত্যিকারের গ্রাহকদের কমেন্ট আছে কিনা দেখুন। শুধু পেজে পোস্ট করা রিভিউ নয়, ব্যক্তিগত প্রোফাইল থেকে দেওয়া কমেন্ট বিশ্বাসযোগ্য। পেজের ইনবক্সে বিক্রেতার উত্তরদানের স্পিড ও আচরণ দেখুন।
- ই-ক্যাব ভেরিফাইড: বাংলাদেশ ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন (e-CAB) এর ভেরিফাইড মেম্বার কিনা দেখুন। e-CAB ভেরিফাইড মার্চেন্টদের তালিকা তাদের ওয়েবসাইটে (
e-cab.org
) পাওয়া যায়। এটি একটি শক্তিশালী বিশ্বস্ততার সূচক।
- ওয়েবসাইট: ঠিকানা (About Us, Contact Us) স্পষ্ট আছে? ফিজিক্যাল অ্যাড্রেস ও ফোন নম্বর দেওয়া আছে? গুগল ম্যাপে সেই ঠিকানা চেক করুন। ডোমেইন নেম সঠিক কিনা দেখুন (যেমন:
পেমেন্ট পদ্ধতি বেছে নিন বুদ্ধিমত্তার সাথে:
- ক্যাশ অন ডেলিভারি (COD) সর্বোত্তম: যতটা সম্ভব COD-ই বেছে নিন, বিশেষ করে নতুন বা কম পরিচিত বিক্রেতার ক্ষেত্রে। পণ্য হাতে পেয়ে দেখেশুনে তারপর টাকা দিন।
- সিকিওর গেটওয়ে ব্যবহার করুন: অনলাইন পেমেন্ট করতেই হলে শুধুমাত্র বিশ্বস্ত ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের নিজস্ব সিকিওর পেমেন্ট গেটওয়ে (যেমন: Daraz Wallet, চালডাল পেমেন্ট) বা পরিচিত কার্ড/এমএফএস ব্যবহার করুন। কখনোই সরাসরি বিক্রেতার পার্সোনাল বিকাশ/নগদ/রকেট নম্বরে টাকা পাঠাবেন না, যদি না আপনি তাকে ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বস্তভাবে চেনেন।
- ভার্চুয়াল কার্ড (যদি উপলব্ধ হয়): কিছু ব্যাংক (যেমন: ডাচ-বাংলা, ব্র্যাক ব্যাংক) ভোক্তাদের জন্য ভার্চুয়াল কার্ড নম্বর সুবিধা দেয়, যা শুধুমাত্র একটি লেনদেনের জন্য ব্যবহার করা যায় এবং নির্দিষ্ট লিমিটে সেট করা যায়। এটি আপনার মূল কার্ড ডিটেইলস রক্ষা করে।
পণ্যের বিবরণ ও মূল্য যাচাই করুন (বাস্তবসম্মত হওয়া জরুরি):
- অতি লোভনীয় অফার সন্দেহ করুন: মার্কেট প্রাইসের চেয়ে অত্যন্ত কম দাম দেখলে সতর্ক হোন। ‘Too good to be true’ নীতিটি মনে রাখুন – যা খুব ভালো বলে মনে হয়, তা প্রায়ই ঠকবাজির লক্ষণ।
- ফটো ও বিবরণ পড়ুন: পণ্যের ছবিগুলো ভালো করে দেখুন। স্টক ফটো নাকি আসল পণ্যের ছবি? বিবরণে ব্র্যান্ড, মডেল, স্পেসিফিকেশন, ওয়ারেন্টি ইত্যাদি স্পষ্ট করে উল্লেখ আছে কিনা দেখুন।
- মাল্টিপল সোর্স চেক করুন: একই পণ্য অন্য বিশ্বস্ত ওয়েবসাইটে বা দোকানে কত দামে পাওয়া যাচ্ছে, তা দেখে নিন।
আপনার অ্যাকাউন্ট ও ডিভাইস সুরক্ষিত রাখুন:
- শক্তিশালী ও ইউনিক পাসওয়ার্ড: প্রতিটি শপিং সাইটের জন্য আলাদা, জটিল পাসওয়ার্ড ব্যবহার করুন। পাসওয়ার্ড ম্যানেজার ব্যবহার করতে পারেন।
- টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন (2FA): যেখানে সম্ভব, 2FA চালু করুন। এটি লগইনের সময় একটি অতিরিক্ত কোড (এসএমএস বা অথেনটিকেটর অ্যাপের মাধ্যমে) চায়, যা নিরাপত্তা বহুগুণ বাড়ায়।
- সফটওয়্যার আপডেট রাখুন: আপনার স্মার্টফোন, ট্যাবলেট বা কম্পিউটারের অপারেটিং সিস্টেম এবং ব্রাউজার সর্বদা আপ টু ডেট রাখুন। সিকিউরিটি প্যাচগুলো জালিয়াতি থেকে রক্ষা করে।
- পাবলিক Wi-Fi এ সতর্কতা: পাবলিক Wi-Fi নেটওয়ার্কে ব্যাংকিং বা শপিং সাইটে লগইন করা থেকে বিরত থাকুন। এগুলো হ্যাকারদের জন্য সহজ টার্গেট। মোবাইল ডাটা ব্যবহার করুন অথবা VPN ব্যবহার করুন।
- অর্ডার ও ডেলিভারি প্রক্রিয়ায় সতর্কতা:
- অর্ডার কনফার্মেশন ও ট্র্যাকিং: অর্ডার দেওয়ার পর কনফার্মেশন ইমেইল/এসএমএস আসবে। ট্র্যাকিং আইডি নোট করে রাখুন এবং প্ল্যাটফর্ম/বিক্রেতার দেওয়া লিংকে পণ্যের অবস্থান ট্র্যাক করুন।
- প্যাকেট খোলার আগেই পরীক্ষা: ডেলিভারি পার্সন এর সামনেই প্যাকেটটি খুলুন। অর্ডার করা পণ্য, কালার, সাইজ, কন্ডিশন ঠিক আছে কিনা দেখুন। কোন সমস্যা দেখলে কুরিয়ার পার্সনকে তাৎক্ষণিক জানান এবং প্যাকেজ ফেরত দিন। এর প্রমাণ হিসেবে ছবি তুলে রাখুন।
- রিসিপ্ট/চালান রাখুন: অনলাইন ট্রানজেকশনের স্ক্রিনশট, অর্ডার কনফার্মেশন, চ্যাট হিস্ট্রি, পেমেন্ট প্রুফ (ট্রানজেকশন আইডি) সুরক্ষিত রাখুন। ভবিষ্যতে কোন সমস্যা হলে এগুলো প্রমাণ হিসেবে কাজ করবে।
প্রতারণার শিকার হলে কী করবেন?)
যদিও সতর্কতা সর্বোত্তম পন্থা, তবুও যদি আপনি প্রতারিত হনই, তাহলে দ্রুত ও সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
- বিক্রেতার সাথে যোগাযোগ করুন (যদি সম্ভব): প্রথমেই প্ল্যাটফর্ম (যেমন: Daraz, চালডাল) বা বিক্রেতার অফিশিয়াল চ্যানেলে (ইনবক্স, হেল্পলাইন) বিস্তারিত লিখে অভিযোগ করুন। স্ক্রিনশট সহ প্রমাণ দিন। স্পষ্টভাবে বলুন আপনি কী প্রত্যাশা করছেন (রিফান্ড, রিপ্লেসমেন্ট)।
- পেমেন্ট সেবা প্রদানকারীকে জানান:
- মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (বিকাশ, নগদ, রকেট): দ্রুত তাদের হেল্পলাইনে ফোন করুন (বিকাশ: ১৬১২৩, নগদ: ১৬১৬৭, রকেট: ১৬১৬১) অথবা অ্যাপ থেকেই ‘ডিসপিউট’ বা ‘অভিযোগ’ অপশন ব্যবহার করে ট্রানজেকশন আইডি দিয়ে রিপোর্ট করুন। প্রতারণার প্রমাণ দিতে পারলে রিভার্স ট্রানজেকশনের চেষ্টা করা হতে পারে (যদি রিসিভারের অ্যাকাউন্টে টাকা থাকে)।
- ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড: সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কার্ড ডিভিশনে ফোন করুন বা শাখায় যোগাযোগ করে ট্রানজেকশনটি ডিসপিউট/ফ্রড হিসেবে রিপোর্ট করুন। ব্যাংক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
- পেমেন্ট গেটওয়ে (SSLCOMMERZ, bKash PG): সংশ্লিষ্ট গেটওয়ের গ্রাহক সেবায় অভিযোগ করুন।
- সাইবার সেল/পুলিশে অভিযোগ দায়ের করুন:
- জাতীয় হেল্পলাইন ৯৯৯: জরুরি পরিস্থিতিতে কল করুন।
- ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এর অধীনে অভিযোগ দায়ের করুন। নিকটতম থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) বা সরাসরি বাংলাদেশ সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিভিশন (সিসিআইডি) এর সাইবার পুলিশ সেন্টারে যোগাযোগ করুন। তাদের ওয়েবসাইটে (
cybercrime.gov.bd
) অনলাইনেও অভিযোগ দায়ের করা যায়। প্রমাণ হিসেবে সব ধরনের স্ক্রিনশট, চ্যাট হিস্ট্রি, পেমেন্ট প্রুফ, বিক্রেতার প্রোফাইল/পেজের লিংক জমা দিতে হবে। - ঢাকা বাসীদের জন্য: ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) এর সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম ডিভিশনে সরাসরি যোগাযোগ করা যায়।
- ই-ক্যাব (বাংলাদেশ ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন): e-CAB এর একটি গ্রাহক সুরক্ষা উইং আছে। তাদের ওয়েবসাইটে (
e-cab.org
) অভিযোগ করার অপশন রয়েছে। তারা তাদের সদস্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিষ্পত্তিতে সহায়তা করে। - সোশ্যাল মিডিয়ায় সচেতনতা: আপনার অভিজ্ঞতা বিশ্বস্ত ফোরাম বা গ্রুপে (যেগুলো সত্যিকারের ভোক্তাদের জন্য) শেয়ার করুন যাতে অন্যরা সতর্ক হতে পারে। তবে গুজব বা ব্যক্তিগত আক্রমণ থেকে বিরত থাকুন।
স্মরণীয়: দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যত দ্রুত অভিযোগ করবেন, টাকা ফেরত পাওয়া বা জালিয়াতকে চিহ্নিত করার সম্ভাবনা তত বেশি।
ভোক্তা অধিকার ও আইনি সুরক্ষা: আপনার জানা উচি
বাংলাদেশে অনলাইন ক্রেতাদের সুরক্ষায় কিছু আইনি কাঠামো ও অধিকার রয়েছে:
- ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮: এই আইনে কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস বা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে প্রতারণা (ধারা ৩২), পরিচয় প্রতারণা (ধারা ৩৩) গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়, যার শাস্তি জেল ও জরিমানা।
- ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯: যদিও এই আইনটি অনলাইন কেনাকাটাকে পুরোপুরি কভার করার জন্য ডিজাইন করা হয়নি, এর কিছু ধারা প্রযোজ্য হতে পারে, যেমন বিক্রিত পণ্যের বিবরণের সাথে অসঙ্গতি (ধারা ৪৩), প্রতারণামূলক প্রচারণা (ধারা ৪৪)। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ করা যেতে পারে।
- বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা: বাংলাদেশ ব্যাংক মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) এবং ব্যাংকগুলোকে গ্রাহক সুরক্ষা ও প্রতারণা রোধে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে লেনদেনের পূর্বে যাচাইকরণ (টু-ফ্যাক্টর), সহজ অভিযোগ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া ইত্যাদি।
- ই-ক্যাব গাইডলাইন: ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন (e-CAB) তাদের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য কঠোর আচরণবিধি (Code of Conduct) প্রণয়ন করেছে, যাতে গ্রাহকদের স্বার্থ সুরাখা, সঠিক পণ্য বিবরণ, সময়মতো ডেলিভারি এবং সহজ রিটার্ন/রিফান্ড পলিসি অন্তর্ভুক্ত।
জানেন কি? ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে সাইবার অপরাধের তদন্ত ও মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য দেশজুড়ে বিশেষায়িত সাইবার ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে।
অনলাইন শপিংয়ে নিরাপদ থাকুন শুধু একটি সতর্কবাণী নয়, এটি আপনার ডিজিটাল সচেতনতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। সঠিক জ্ঞান, একটু সতর্কতা এবং সন্দেহের দৃষ্টিই পারে আপনাকে রক্ষা করতে জটিল সব প্রতারণার ফাঁদ থেকে। বিশ্বস্ত প্ল্যাটফর্ম বেছে নিন, পেমেন্টে COD-কে অগ্রাধিকার দিন, বিক্রেতার প্রোফাইল গভীরভাবে যাচাই করুন, এবং আপনার ব্যক্তিগত তথ্য কখনোই শেয়ার করবেন না। মনে রাখবেন, আপনার টাকা এবং তথ্যের নিরাপত্তা আপনার হাতেই। স্মার্ট শপিং করুন, সচেতন থাকুন, এবং এই সুবিধাজনক ডিজিটাল বিশ্বকে উপভোগ করুন আত্মবিশ্বাসের সাথে। আপনার নিরাপত্তা হোক প্রতিটি ক্লিকের অগ্রাধিকার।
জেনে রাখুন (FAQs)
প্রশ্ন: অনলাইন শপিংয়ে সবচেয়ে নিরাপদ পেমেন্ট পদ্ধতি কোনটি?
উত্তর: নিঃসন্দেহে ক্যাশ অন ডেলিভারি (COD)। পণ্য হাতে পেয়ে, দেখেশুনে, সন্তুষ্ট হয়ে তারপর টাকা দেওয়া যায়। বিকাশ, নগদ, কার্ডের মতো অনলাইন পেমেন্ট করতেই হলে শুধুমাত্র বিশ্বস্ত ও বড় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মের (ডারাজ, চালডাল ইত্যাদি) নিজস্ব সিকিওর পেমেন্ট গেটওয়েতে করুন। কখনোই অপরিচিত ব্যক্তির পার্সোনাল বিকাশ/নগদ নম্বরে সরাসরি টাকা পাঠাবেন না।প্রশ্ন: ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে কোন পেজ বিশ্বাসযোগ্য কিনা বুঝব কিভাবে?
উত্তর: পেজের ‘Page Transparency’ চেক করুন (সাধারণত পেজের নামের নিচে বা ‘About’ সেকশনে থাকে)। দেখুন পেজ কবে তৈরি হয়েছে? নতুন পেজ (কয়েক মাস বা সপ্তাহ) হলে সতর্ক হোন। পেজের রিভিউ ও রেটিং দেখুন। সত্যিকারের প্রোফাইল থেকে দেওয়া কমেন্ট খুঁজুন, শুধু পেজে পোস্ট করা রিভিউ নয়। পেজে ফিজিক্যাল ঠিকানা ও ফোন নম্বর আছে কি? গুগল ম্যাপে চেক করুন। ই-ক্যাব ভেরিফাইড মার্চেন্ট কি নাe-cab.org
সাইটে চেক করুন।প্রশ্ন: পেমেন্ট করার পর বিক্রেতা আর ফোন ধরছে না বা পেজ ডিলিট করেছে! এখন কী করব?
উত্তর: দ্রুত পদক্ষেপ নিন!
১. পেমেন্ট প্রুফ সংরক্ষণ করুন: ট্রানজেকশন আইডি, স্ক্রিনশট।
২. পেমেন্ট সেবাদাতাকে জানান: বিকাশ/নগদ/রকেট হেল্পলাইনে ফোন করুন (বিকাশ: ১৬১২৩, নগদ: ১৬১৬৭, রকেট: ১৬১৬১) বা অ্যাপ থেকে অভিযোগ করুন। ব্যাংক কার্ড হলে ব্যাংকে ফোন করুন।
৩. অভিযোগ দায়ের করুন:cybercrime.gov.bd
এ অনলাইনে বা নিকটতম থানায়/সিসিআইডি সাইবার সেন্টারে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অভিযোগ করুন। সব প্রমাণ দিন।
৪. ই-ক্যাব-কে জানান: যদি বিক্রেতা তাদের সদস্য হয় (e-cab.org
এ অভিযোগ অপশন আছে)।প্রশ্ন: ডেলিভারির সময় অতিরিক্ত টাকা চাইলে কী করব?
উত্তর: কখনোই দেবেন না, যদি না আপনি আগে থেকেই জানেন এবং রাজি থাকেন (যেমন: কিছু দূরবর্তী এলাকার জন্য বাড়তি ডেলিভারি চার্জ)। আপনি ইতোমধ্যে পূর্ণ পেমেন্ট করে থাকলে, এটি একটি সাধারণ প্রতারণার কৌশল। কুরিয়ার পার্সনকে বলুন আপনি শুধুমাত্র প্ল্যাটফর্ম বা বিক্রেতার কাছ থেকে নির্দেশ পেলে টাকা দেবেন। বিক্রেতার সাথে ফোনে/মেসেজে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হোন। প্রয়োজনে প্যাকেজ ফেরত দিন এবং প্ল্যাটফর্ম/বিক্রেতাকে অভিযোগ করুন।প্রশ্ন: পণ্য ভুল বা নিম্নমানের আসলে কী করণীয়?
উত্তর:
১. ডেলিভারি পার্সন এর সামনে খুলে দেখুন: সমস্যা ধরা পড়লে সাথে সাথে তার কাছে নোটিশ দিন এবং প্যাকেজ ফেরত দিন। ছবি তুলুন।
২. বিক্রেতা/প্ল্যাটফর্মকে জানান: দ্রুত তাদের হেল্পলাইন/ইনবক্সে বিস্তারিত লিখে জানান, স্ক্রিনশট ও পণ্যের ছবি সহ। দাবি করুন রিপ্লেসমেন্ট বা রিফান্ড।
৩. রিটার্ন পলিসি মেনে চলুন: প্ল্যাটফর্মের রিটার্ন গাইডলাইন (কত দিনের মধ্যে করতে হবে, কী প্রক্রিয়া) ফলো করুন।
৪. প্রতিকার না পেলে: e-CAB (যদি সদস্য হয়), ভোক্তা অধিদপ্তর বা সাইবার ক্রাইমে অভিযোগের অপশন খোলা আছে।- প্রশ্ন: অনলাইন শপিং সাইটে অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে আমার কী কী তথ্য সুরক্ষিত?
উত্তর: বিশ্বস্ত প্ল্যাটফর্মগুলো সাধারণত শুধু নাম, ইমেইল, ফোন নম্বর, ডেলিভারি ঠিকানা চায়। কখনোই আপনার পাসপোর্ট/এনআইডি নম্বর, ব্যাংক কার্ডের পিন, জন্ম তারিখের পূর্ণ বিবরণ, বা আপনার এমএফএস অ্যাকাউন্টের লগইন পাসওয়ার্ড কোন অনলাইন শপিং সাইট বা অপরিচিত ব্যক্তিকে দেবেন না। সাইটেhttps://
এবং লক (🔒) আইকন আছে কিনা নিশ্চিত হোন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।