জুমবাংলা ডেস্ক : তথাকথিত অতি আধুনিকতা, অবাধ তথ্য-প্রযুক্তির নেতিবাচক ব্যবহার ও নানা ধরনের মাদকসহ আরো কিছু অসুস্থ প্রবণতায় জড়িয়ে পড়ছে কিশোর ও তরুণ প্রজন্ম। উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত পর্যন্ত সব শ্রেণীর কিশোর ও তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে নানা অপসাংস্কৃতি।
এর ধারাবাহিকতায় নতুন প্রজন্ম ঢুকে পড়ছে অনিয়ন্ত্রিত যৌনাচরণের মারাত্মক আসক্তিতে। দিনে দিনে এ পরিস্থিতি আরো ভয়ানক হয়ে উঠছে, যা দেশের এইডস-এইচআইভির ঝুঁকি আগের তুলনায় বহুমাত্রায় বাড়িয়ে তুলেছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা। উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরা এ জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কিছু কার্যক্রম ও বাণিজ্যিক বিশৃঙ্খল অবস্থাকে দায়ী করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. ফাতেমা রেজিনা পারভিন বলেন, মূলত পারিবারিক ও সামাজিক অনুশাসনের গলদ থাকায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। তরুণ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের অনেকেই ব্যক্তিস্বাধীনতা ও অধিকারবোধের অপব্যবহার ঘটাচ্ছে। অনেকেই যেভাবে বন্ধুত্বের আবরণে অবাধ জীবনাচারে জড়িয়ে পড়ছে, তা অবশ্যই শঙ্কার বিষয়। এর দায় প্রথমত পরিবার এবং পরে সমাজকেই নিতে হবে।
এদিকে গত এক বছরে দেশে এইডস রোগীর সংখ্যা বেড়েছে এক হাজারের বেশি; যাদের মধ্যে ১০০ জন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মানুষ হলেও বাকিরা দেশের সাধারণ মানুষ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র থেকে জানা গেছে, এইচআইভি/এইডস নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে গত কয়েক বছরে সচেতনতা বাড়লেও আক্রান্ত শনাক্তের হার বাড়েনি। অনেকেই হয়তো পারিবারিক ও সামাজিক নানা রকম ভয়ে নিজে এইচআইভি পজিটিভ জেনেও বিষয়টি শুধু নিজের মধ্যে চেপে রেখেছে। এ ছাড়া অনেকে হয়তো পরীক্ষাও করায় না ধরা পড়ার ভয়ে। এ কারণে এখনো প্রায় ৫৫ শতাংশ এইডস রোগীই রয়ে গেছে শনাক্তকরণের বাইরে। মাত্র ৪৫ শতাংশ রোগীকে শনাক্ত করা গেছে।
দেশে প্রথম এইডস রোগী শনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে। এর পর থেকে এ পর্যন্ত ছয় হাজার ৪৫৫ জন এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছে। আর এ পর্যন্ত মারা গেছে এক হাজার ২০০ জনের বেশি; যদিও দেশে এইচআইভি সংক্রমিত মানুষের সংখ্যা ১৪ হাজারের বেশি হবে বলে জানানো হয়েছে বিশেষজ্ঞদের পর্যায় থেকে।
একই সূত্রের তথ্য অনুসারে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে এখন পর্যন্ত দেশে নতুন এইচআইভি পজিটিভ এক হাজার ২০ জনকে শনাক্ত করা গেছে, যা ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত শনাক্ত হয়েছিল ৮৬৯ জন। ওই সময়ে মারা গেছে ১৪৮ জন। তবে গত এক বছরে দেশে কতজন এইডস রোগীর মৃত্যু ঘটেছে বা নতুন অন্যান্য সংখ্যা কত, তা আজ বিশ্ব এইডস দিবসের অনুষ্ঠানে আনুষ্ঠনিকভাবে প্রকাশ করবেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, বিভিন্ন অনিয়ন্ত্রিত জীবনাচারের কারণে অপেক্ষাকৃত কিশোর ও তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অনিরাপদ যৌন আসক্তি বেড়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যেমন পারিবারিক নজরদারি ও অনুশাসনের ঘাটতি রয়েছে, তেমনি অবাধে পিল বেচাকেনার মতো কিছু বাণিজ্যও এই প্রজন্মকে নিরাপত্তার নামে উসকে দিচ্ছে। বিশেষ করে, সাম্প্রতিক সময়ে দেশে অনেক কম্পানি বাজারে নানা ধরনের জন্মনিরোধক পিল ছেড়েছে। ওই কর্মকর্তা উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, এখন বিভিন্ন চ্যানেলে একটি বিজ্ঞাপন দেখা যাচ্ছে। ওই বিজ্ঞাপনচিত্রে এক কিশোরী বা তরুণী বন্ধুদের সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে হঠাৎই বিরক্ত প্রকাশ করে। তখন একটি ইমার্জেন্সি পিল পেয়ে বিরক্তি ঝেড়ে আবার আনন্দে মেতে ওঠে। এ ধরনের বিজ্ঞাপনচিত্র আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কতটা উপযুক্ত, তা খতিয়ে দেখা দরকার। এসব বিজ্ঞাপন তৈরি বা প্রচারের আগে স্বাস্থ্য খাতের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো অনুমতি নেওয়া হয় কি না, সেটিও দেখা জরুরি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এমন আরো বেশ কিছু পিল বাজারজাতের আওতায় টেলিভিশন চ্যানেলসহ বিভিন্ন মাধ্যমে কিশোর-তরুণ প্রজন্মকে আকৃষ্ট করার মতো বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে অবাধে। এসব পিল বাণিজ্য ও প্রচারণা থেকে দেশের কিশোর ও তরুণ প্রজন্মকে অকালগর্ভধারণে সুরক্ষার নামে এইডস-এইচআইভির ঝুঁকির জায়গায় পুরোপুরি অরক্ষিত করে দেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (এইডস-এইচআইভি) অধ্যাপক ডা. সামিউল ইসলাম সাদী বলেন, ‘এমনিতে আমাদের তরুণ প্রজন্ম এখন এক ধরনের সামাজিক অস্থির অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যেভাবে অবাধে পিল ও যৌন উত্তেজক নানা উপাদানের প্রসার ঘটছে, তাতে এই প্রজন্মকে উল্টো নতুন করে ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।’ ওই কর্মকর্তা বলেন, পিলে হয়তো অকালগর্ভধারণ বন্ধ হতে পারে; কিন্তু এইডস-এইচআইভির ঝুঁকি তো আর বন্ধ হচ্ছে না। এখন যদি কেউ ওই পিলের ওপর ভরসা করে যখন-তখন, যেখানে-সেখানে অনিরাপদ যৌনাচারণে জড়িয়ে পড়ে, সেটি ভয়ানক বিপদের কথা। তিনি বলেন, ‘শুধু পেশাদার যৌনকর্মী কিংবা মাদকগ্রহীতারাই যে এইডস-এইচআইভির ঝুঁকিতে আছে, তা কিন্তু নয়। আমাদের কাছে যে চিত্র আসে, তাতে কিন্তু পেশাদার যৌনকর্মীদের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের এক শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে যৌনতা এখন নেশার মতো আসক্তিতে পরিণত হয়েছে।’
অধ্যাপক ড. ফাতেমা রেজিনা পারভিন বলেন, যেসব পরিবার সময়মতো তাদের সন্তানকে সঠিকভাবে দেখভাল করতে পারছে, তাদের সন্তানরা সাধারণত বিপথগামী হয় না; কিন্তু যেসব পরিবারে সন্তানরা অতিরিক্ত স্বাধীনতার নামে রাতভর কম্পিউটার-ল্যাপটপ-মোবাইল ফোনে ডুবে থাকে, সময়মতো ঘুম-খাওয়াদাওয়া-গোসল করে না কিংবা ইচ্ছামতো বাইরে যাতায়াত করে, মা-বাবা ঠিকভাবে সন্তানকে সময় দেন না, তারাই কোনো না কোনো পর্যায়ে গিয়ে বিপথগামী হয়। কেউ মাদক ও যৌন আসক্তিতে আটকে যায়, কেউ বা সন্ত্রাসী কার্যক্রমে যুক্ত হয়। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘অনেক পরিবারই সন্তানকে অধিক স্বাধীনতা দিয়ে ফেলে বন্ধুদের সঙ্গে ঘোরাফেরার ক্ষেত্রে। এতে যে শুধু নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা কিন্তু নয়, অন্যরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেকে এমন অভিমতকে রক্ষণশীলতা বলে বিদ্রুপ করার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আসলেই আমাদের দেশের তরুণ প্রজন্মের একটি অংশ আধুনিকতার অপপ্রয়োগ ঘটাচ্ছে। এইচআইভির মতো রোগের দিক থেকেও তারা কিন্তু ঝুঁকিমুক্ত নয়।’
যৌনকর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও এইচআইভি চিকিৎসা-সচেতনতা নিয়ে কাজ করা সংগঠন লাইট হাউসের উপনির্বাহী প্রধান কে এম এস তারিক বলেন, ‘আমরাও দেখতে পাচ্ছি যৌনকর্মীদের মধ্যে তারুণ্যের আধিক্য বেশি। তবে এই শ্রেণির মধ্যে যারা শুধু দরিদ্র পর্যায়ের তারাই আমাদের আশ্রয়ে আসে স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন সুরক্ষা পেতে। বাকিরা কিন্তু কারোরই নিয়ন্ত্রণে নেই। তাদের কোনো সঠিক হিসাবও নেই। লাইট হাউস ৬৮টি কেন্দ্রের মাধ্যমে যৌনকর্মীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে।’
অন্যদিকে বাংলাদেশ সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্কের সাধারণ সম্পাদক আলেয়া আক্তার বলেন, ‘সর্বশেষ হিসাব অনুসারে দেশে পেশাদার যৌনকর্মীর সংখ্যা আড়াই লাখের মতো। এর মধ্যে নারী যৌনকর্মী এক লাখ দুই হাজার ২৬০ জন, পুরুষ যৌনকর্মী (দুজনই পুরুষ হিসাবে) এক লাখ ৩২ হাজার, তৃতীয় লিঙ্গের ১০ হাজার ১৯৯ জন। ২৯টি সংগঠনের মাধ্যমে এসব যৌনকর্মীর স্বাস্থ্য ও অন্যান্য সুরক্ষায় আমরা কাজ করছি। এ ক্ষেত্রে যৌনকর্মীরা প্রতিনিয়তই স্বাস্থ্য পরীক্ষায় নানা ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। সরকারি-বেসরকারি কোথাও তাদের স্বাভাবিকভাবে চিকিৎসার জন্য গ্রহণ করা হয় না। এতে তারা আরো ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়। যদিও সরকারি ও দাতা সংস্থার উদ্যোগে যেসব আলাদা সেবা কেন্দ্র আছে, সেগুলোই এসব যৌনকর্মীর স্বাস্থ্য সুরক্ষার বড় ভরসা হয়ে আছে।’ সূত্র : কালের কন্ঠ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।