‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য, একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না’—ভূপেন হাজারিকার এই অবিস্মরণীয় গানের কথা মানুষের চরম সংকটে মনে পড়াটাই স্বাভাবিক। করোনা পরিস্থিতিতে দেশের সর্বস্তরের মানুষ যখন অনেকটাই দিশেহারা অবস্থায়, নিম্ন মধ্যবিত্তরা কর্মস্থান, উপার্জন, বাসাভাড়া নিয়ে অনেকেই যখন চিন্তিত তখন ‘মানুষ মানুষের জন্য’ এই মানবতা বোধ নিয়ে সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন কিছু বাড়িওয়ালা। পাঁচ নিম্নবিত্ত পরিবারের বাসাভাড়া মওকুফ করেছেন রাজধানীর হাজারীবাগের দিলরুবা রহমান নামের এক বাড়িওয়ালা।
জানা যায়, হাজারীবাগের বেড়িবাঁধের ভূঁইয়া স্টেটে অবস্থিত ওই বাড়িতে নিম্নবিত্ত পাঁচ পরিবার বসবাস করে আসছে। যাঁরা ব্যক্তিগত গাড়িচালক, দিনমজুর ও রংমিস্ত্রির কাজ করেন। গত শনিবার দিলরুবা রহমান তাঁদের দুই মাসের বাসাভাড়া মওকুফের কথা জানান।
দিলরুবার ছেলে মহিব রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘করোনাভাইরাসের আতঙ্কের মধ্যে নিম্নবিত্তের মানুষের সংকটটা বেশি। বাসাভাড়া মওকুফ করায় যদি তাঁদের কিছু উপকার হয়, সে জন্য মা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’ তিনি অন্যদেরও এভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
ঢাকার হাজারীবাগের শেখ শিউলি হাবিব নামের এক ভবন মালিকও নিজের ভাড়াটিয়াদের চলতি মাসের ভাড়া মওকুফ করেছেন।
গত শনিবার একই এলাকার মুহিব রহমান নামে আরেক বাড়িওয়ালা তাঁর ফেসবুক ওয়ালে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে ভাড়া মওকুফের বিষয়টি জানান। তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ এলাকার বাসায় যেখানে নিম্নবিত্তরা ভাড়া থাকেন তাঁদের জন্য আজকে কিছু করার চেষ্টা করলাম। আইডিয়াটা ইন্টারনেট থেকে পাওয়া। আমরা সবাই কী এ ধরনের শো অফ করতে পারি না? আমি এই বাড়িভাড়ার ওপর নির্ভরশীল না বলেই এটা করতে পেরেছি। সবার কাছেই এটা আশা করা বোকামি। অনেকের সংসার চলেই বাড়ি ভাড়ার টাকায়।’
গত ২১ মার্চ পোস্ট-এর সঙ্গে এ বিষয়ে একটি নোটিশে মুহিব রহমান উল্লেখ করেছেন, ‘প্রিয় ভাড়াটিয়াগণ, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে আপনাদের আগামী দুই মাসের ভাড়া মওকুফ করা হলো। বিশেষ অনুরোধ—১. ভাড়ার টাকা দিয়ে পারলে কারও সাহায্য করুন। ২. ইলেকট্রিক বিল সময়মতো নিজ দায়িত্বে পরিশোধ করুন। ৩. কিছুক্ষণ পর পর সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নেবেন। ৪. অপ্রয়োজনে বাসার বাইরে যাবেন না।’
মুহিব রহমান গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমি ইচ্ছা করেই নোটিশের ছবি ফেসবুকে দিয়েছি যেন এটা মানুষ দেখে। কারণ আমি দেখছি, মানুষ শুধু অভিযোগই করছে। কেউ নিজের কাজটা করার চেষ্টা করছে না। এটা একটা যুদ্ধ, করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। আমাদের সবদিক থেকে এ রোগের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। সরকার একা কিছুই করতে পারবে না। বলতে গেলে, বিশ্বের কোনো দেশের সরকারই এটার বিরুদ্ধে কিছু করার জন্য প্রস্তুত ছিল না। আমার চেষ্টা হলো, মানুষের মধ্যে একটু ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে আসা। ফেসবুকে নেতিবাচক বিষয় দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি।’
ঢাকার বাইরেও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। ফেনীর নিজাম উদ্দিন পুলক নামে এক ভবন মালিক নিজের বাড়ির ভাড়াটিয়াদের এক মাসের ভাড়া (এপ্রিল মাস) মওকুফ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। গত শনিবার তিনি তাঁর ফেসবুক ওয়ালে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে লেখেন, ‘ফেনী শহরের প্রত্যেক বাড়ির মালিকের প্রতি আবেদন—করোনার প্রভাবে মানুষ একটু সমস্যায় আছে, তাই বেশি না হোক অন্তত (এক মাস-এপ্রিল মাসের) বাড়ি ভাড়া মওকুফ করে দেন। আমিও ২১ পরিবার থেকে নিচ্ছি না। মানুষ মানুষের জন্য। আসুন সবাই মিলে অন্তত এইটুকু করি।’
আমাদের ফেনী প্রতিনিধি জানান, নিজাম উদ্দিন পুলক একজন প্রবাসী ব্যবসায়ী। পাশাপাশি শহরের দাউদপুর এলাকায় পুলক বিদ্যা নিকেতন নামের একটি স্কুলেরও তিনি প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। ফেনী সদরের পাঠানবাড়ী সড়কে পুলকের পাঁচতলা বাড়ি। মোট ২১টি বাসা রয়েছে ওই ভবনে। ভবনের ভাড়াটিয়াদের মধ্যে আছেন প্রবাসী, চাকুরে ও নানা শ্রেণির ব্যবসায়ী। সৌদি আরবপ্রবাসী পুলকের পৈতৃক বাড়ি ফেনী সদর উপজেলার ধলিয়ায়। কয়েক বছর আগে ফেনী শহরের পাঠানবাড়ী এলাকায় বাড়ি তৈরি করে এখানে পরিবার নিয়ে বাস করছেন তিনি।
পুলক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘করোনার প্রভাবে ব্যবসা ভালো যাচ্ছে না। শহরে লোকজনের আগমন কমে গেছে। তাই দোকানপাটের বিক্রিও কম। আবার প্রবাসে যাঁরা ছোটখাটো ব্যবসা করতেন তাঁরাও আছেন নানা সংকটে। তাই সবদিক বিবেচনা করে আমরা এক মাসের ভাড়া মওকুফের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’ এতে ভাড়াটিয়ারা আনন্দিত বলে জানান তিনি।
ওই ভবনের ভাড়াটে আখতার উল ইসলাম বলেন, ‘আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বেচাকেনা কমে গেছে। সামনে এ সংকট আরো বাড়তে পারে। এমন পরিস্থিতিতে এক মাসের ভাড়া মওকুফ হওয়ায় আমাদের উপকার হবে।’
কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়ার ব্যারিস্টার সোহরাব হোসেন চৌধুরী গতকাল রবিবার তাঁর ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, ‘করোনাভাইরাসে এ পর্যন্ত দুজন মারা গেছে। অনেকেই আক্রান্ত। সময়টা বেশ খারাপ। বিশ্বের একই অবস্থা। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে মানুষ ঘর থেকেই বের হতে পারছে না। অনেকের তো আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছে। তবে যত সংকটই আসুক, তা মোকাবেলায় মানুষের জন্য তো মানুষকেই এগিয়ে আসতে হবে।’ সামর্থ্যবানদের মানবতার সেবায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে ব্যারিস্টার সোহরাব জানিয়েছেন, ঢাকার হাতিরপুল ও তেজকুনিপাড়ায় তাঁর দুটি বাড়িতে বসবাসরত ভাড়াটিয়াদের মার্চ মাসের ভাড়া তিনি মওকুফ করেছেন।
ব্যারিস্টার সোহরাব হোসেন চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মানুষ তো মানুষের জন্য, জীবন তো জীবনের জন্য। আমার ক্ষুদ্র সামর্থ্যের মধ্যে আমি এ কাজটি করলাম। দেশের অন্যান্য বাড়ির মালিকও যদি একইভাবে এগিয়ে আসেন তাহলে দেশের অসংখ্য সাধারণ মানুষের জন্য কিছুটা হলেও সহায়তা হবে বলে আমি মনে করি।’ তিনি আরো বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে দেশের অর্থনীতিতে কিছুটা বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এক শ্রেণির সুবিধাবাদী ব্যবসায়ী পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এ অবস্থায় আমি আমার সাধ্যের মধ্যে কিছু মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।