আন্তর্জাতিক ডেস্ক : অক্টোবরের ৭ তারিখ সকাল ৭টার দিকে ইসরাইলকে লক্ষ্য করে হামাসের আক্রমণের পর প্রশ্ন উঠছে ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’ পরিকল্পনা ও তত্ত্বাবধান কারা করেছে? কারণ এই অপারেশন ইসরাইলকে চমকে দিয়েছে বলে মনে করছেন পর্যবেক্ষক ও সামরিক বিশ্লেষকরা।
গাজা নিয়ন্ত্রণকারী ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী হামাসের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের অনেকেই মিডিয়ায় মুখোশ পরে উপস্থিত হন। অন্যদিকে কেউ কেউ ইসরাইলের হত্যাচেষ্টা থেকে বাঁচতে তাদের জীবনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেছেন।
এখানে আমরা বর্তমানে হামাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও ইজ আল-দিন আল-কাসাম ব্রিগেডসের সামরিক কমান্ডারদের দিকে নজর দিচ্ছি।
মোহাম্মাদ দেইফ
তিনি মোহাম্মদ দিয়াব আল-মাসরি। তার ডাক নাম ‘আবু খালেদ’ ও ‘আল-দেইফ’।
তিনি হামাস আন্দোলনের সামরিক শাখা ইজ আল-দিন আল-কাসাম ব্রিগেডের নেতৃত্ব দেন। তিনি ১৯৬৫ সালে গাজায় জন্মগ্রহণ করেন।
ফিলিস্তিনিদের কাছে তিনি ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে এবং ইসরাইলিদের কাছে ‘মৃত্যুর মানুষ’ বা ‘নয়টি জীবন নিয়ে জন্মানো যোদ্ধা’ হিসেবে পরিচিত।
তিনি ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব গাজা থেকে জীববিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। সেখানে তিনি অভিনয় ওথিয়েটার প্রতি আগ্রহের জন্য পরিচিত ছিলেন। আর সেখানে তিনি একটি শিল্পী দল গঠন করেছিলেন।
যখন হামাসের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করা হয়, তিনি বিনা দ্বিধায় এই দলে যোগ দেন। ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ তাকে ১৯৮৯ সালে গ্রেফতার করে, আর হামাসের সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে কাজ করার অভিযোগে বিনা বিচারে ১৬ মাস কারাগারে কাটিয়েছেন।
কারাবাসের সময় জাকারিয়া আল-শোরবাগি এবং সালাহ শেহাদেহর সাথে মিলে ইসরাইলি সৈন্যদের বন্দী করার লক্ষ্যে হামাস থেকে আলাদা একটি আন্দোলন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সম্মত হন দেইফ, যা পরে আল-কাসাম ব্রিগেডস হয়ে ওঠে।
দেইফ কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ইজ আল-দিন আল-কাসাম ব্রিগেডস একটি সামরিক সংগঠন হিসেবে আবির্ভূত হয়, যেখানে অন্য কাসাম নেতাদের সাথে এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে দেইফ অগ্রভাগে ছিলেন।
দেইফ গাজা থেকে হামাস যোদ্ধাদের ইসরাইলে প্রবেশের জন্য নির্মিত টানেলের প্রকৌশলী ছিলেন এবং একইসাথে বড় সংখ্যক রকেট উৎক্ষেপণের কৌশল গ্রহীতাদের একজন ছিলেন।
তবে তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ হলো, হামাসের বোমা প্রস্তুতকারক ইয়াহিয়া আইয়াশকে হত্যার পর প্রতিশোধমূলক অভিযানের ধারাবাহিক পরিকল্পনা ও তত্ত্বাবধান। একটি বাসে তার ছোঁড়া বোমা হামলায় ১৯৯৬ সালের শুরুতে ৫০ জন ইসরাইলি নিহত হয়েছিল এবং ১৯৯০ দশকের মাঝামাঝি সময়ে তিনজন ইসরাইলি সেনার বন্দী ও হত্যার সাথেও তিনি জড়িত ছিলেন।
ইসরাইল তাকে ২০০০ সালে গ্রেফতার ও বন্দী করে। কিন্তু ‘দ্বিতীয় ইন্তিফাদা’র শুরুতে তিনি বন্দীদশা থেকে পালাতে সক্ষম হন। তারপর নিজের খুব সামান্য ছাপই তিনি ফেলে গেছেন।
দেইফের তিনটি ছবি রয়েছে: একটি খুব পুরনো, দ্বিতীয়টি মুখোশ পরা ও তৃতীয়টি তার ছায়ার ছবি।
তাকে হত্যা করার সবচেয়ে গুরুতর প্রচেষ্টা হয়েছিল ২০০২ সালে, যেটা থেকে তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে গেলেও নিজের একটি চোখ হারান।
ইসরাইলের তথ্যমতে, তিনি তার একটি পা ও একটি হাতও হারিয়েছিলেন এবং বেশ কয়েকবার হত্যা প্রচেষ্টার পর বেঁচে থাকলেও তার কথা বলতে অসুবিধা হয়।
গাজা উপত্যকায় ২০১৪ সালে ৫০ দিনেরও বেশি সময় ধরে চলা ইসরাইলের আক্রমণে দেশটির সেনাবাহিনী দেইফকে হত্যা করতে ব্যর্থ হলেও তার স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যা করে।
‘দ্য ক্লাউন’ নামক একটি নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি ‘আবু খালেদ’ ডাকনামে পরিচিত হন, যেখানে তিনি মধ্যযুগের প্রথম দিককার উমাইয়া ও আব্বাসীয় আমলের ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ‘আবু খালেদের’ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন।
আরবি দেইফ শব্দটির অর্থ ‘অতিথি’। এই ডাকনামটি বেছে নেয়ার কারণ ছিল তিনি ইসরাইলিদের হাত থেকে বাঁচতে একটি জায়গায় বেশিক্ষণ থাকতেন না। আর প্রতি রাতে নতুন কোনো জায়গায় ঘুমাতেন।
মারওয়ান ইসা
‘ছায়া মানুষ’ এবং মোহাম্মদ দেইফের ডান হাত নামে পরিচিত মারওয়ান ইসা ইজ আল-দিন আল-কাসাম ব্রিগেডসের ডেপুটি কমান্ডার-ইন-চিফ এবং হামাস আন্দোলনের রাজনৈতিক ও সামরিক ব্যুরোর সদস্য।
খুব কম বয়সে হামাসের কার্যকলাপের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ‘প্রথম ইন্তিফাদা’ চলাকালীন ইসরাইলি বাহিনী তাকে আটক করার পর পাঁচ বছর আটকে রেখেছিল।
ইসরাইল বলছে, যত দিন তিনি জীবিত থাকবেন, হামাসের সাথে তার ‘মস্তিষ্কের যুদ্ধ’ অব্যাহত থাকবে। তারা তাকে ‘কথা নয়, কাজের লোক’ হিসেবে বর্ণনা করে এবং বলে, তিনি এতটাই চালাক যে কোনো ‘প্লাস্টিককেও ধাতুতে পরিণত করতে পারেন’।
তিনি একজন বিশিষ্ট বাস্কেটবল খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিতি পেলেও ক্রীড়া তার পেশা ছিল না। কারণ ১৯৮৭ সালে হামাস আন্দোলনে যোগ দেয়ার অভিযোগে ইসরাইল তাকে গ্রেফতার করে।
পরে ১৯৯৭ সালে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ তাকে গ্রেফতার করে এবং ২০০০ সালের ‘আল-আকসা ইন্তিফাদা’র আগ পর্যন্ত তাকে মুক্তি দেয়া হয়নি।
কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ইসা আল-কাসসাম ব্রিগেডসের সামরিক ব্যবস্থার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ইসরাইল মারওয়ান ইসাকে ‘কথা নয়, কাজের লোক’ হিসেবে বর্ণনা করে আর বলে তিনি এতটাই চালাক যে কোন ‘প্লাস্টিককে ধাতুতে পরিণত করতে পারেন’।
আন্দোলনে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কারণে তিনি ইসরাইলের মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় জায়গা করে নেন। ২০০৬ সালে দেইফ ও আল-কাসাম ব্রিগেডসের প্রধান নেতাদের সাথে সাধারণ কর্মীদের একটি বৈঠকের সময় ইসরাইলিরা তাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল। তিনি আহত হলেও ইসরাইলের তাকে নির্মূল করার লক্ষ্য অর্জিত হয়নি।
২০১৪ এবং ২০২১ সালে গাজা আক্রমণের সময় ইসরাইলি যুদ্ধবিমানগুলো তার বাড়িও দুবার ধ্বংস করেছে। সেই আক্রমণে তার ভাই মারা যায়।
২০১১ সালে ইসরাইলি সেনা গিলাদ শালিতের বিনিময়ে মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দীদের অভ্যর্থনা করার সময় তোলা একটি গ্রুপ ছবির আগে তার চেহারা কারো জানা ছিল না।
নম-দে-গুয়েরে আবু আল-বারা নামেও পরিচিত ইসা ২০১২ সালের ‘শেল স্টোনস’ থেকে ২০২৩ সালের ‘আল-আকসা বন্যা’ পর্যন্ত বিভিন্ন যুদ্ধের পরিকল্পনায় তার ভূমিকা স্পষ্ট: এতে মাঠপর্যায়ের শক্তি, গোয়েন্দা ও প্রযুক্তি বাহিনী, সংগঠিত ও সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার পরিধি এবং বসতি ও নিরাপত্তা সদর দফতরের ওপর বিশেষ নজর দেয়া- সবকিছুই তার জড়িত থাকার ইঙ্গিত দেয়।
ইয়াহিয়া সিনওয়ার
হামাস আন্দোলনের নেতা ও গাজা উপত্যকার রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান ইয়াহিয়া ইব্রাহিম আল-সিনওয়ার ১৯৬২ সালে জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি ‘মাজদ’ নামে পরিচিত হামাসের নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠাতা। এটি মূলত সন্দেহভাজন ইসরাইলি এজেন্টদের বিষয়ে তদন্ত পরিচালনা এবং ইসরাইলি গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার কর্মকর্তাদের ট্র্যাক করার মতো অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার বিষয় পরিচালনা করে।
সিনওয়ারকে তিনবার গ্রেফতার করা হয়েছে, যার মধ্যে ১৯৮২ সালে প্রথমবার আটকের পর ইসরাইলি বাহিনী তাকে চার মাস প্রশাসনিক কারাগারে রাখে।
১৯৮৮ সালে সিনওয়ারকে তৃতীয়বার গ্রেফতার করা হয় এবং চারটি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। সিনওয়ার যখন কারাবাসে ছিলেন, তখন ইসরাইলি সৈনিক গিলাদ শালিতের ট্যাঙ্কটি হামাসের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার শিকার হয় এবং ওই ইসরাইলি সৈন্যকে জিম্মি করা হয়।
শালিতকে বলা হত ‘সবার মানুষ’। তাই ইসরাইলকে তার মুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু করতে হয়েছিল।
‘মুক্তির আনুগত্য’ নামে একটি বন্দী বিনিময় চুক্তির মাধ্যমে এটা ঘটে, যেখানে ফাতাহ ও হামাস আন্দোলনের অনেক বন্দীদের সাথে ইয়াহিয়া সিনওয়ারও ছিলেন। ২০১১ সালে তিনি মুক্তি পান।
মুক্তির পর সিনওয়ার হামাস আন্দোলনের একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা এবং এর রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য হিসেবে তার অবস্থানে ফিরে আসেন।
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিনওয়ারের নাম ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের’ কালো তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।
ইসমাইল হানিয়াহের উত্তরসূরি হিসেবে ২০১৭ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি সিনওয়ার গাজা উপত্যকার রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান নির্বাচিত হন।
আব্দুল্লাহ বারঘৌতি
বারঘৌতি ১৯৭২ সালে কুয়েতে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৯০ সালে দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধের পর জর্ডানে চলে যান।
জর্ডানের নাগরিকত্ব পাওয়ার আগে তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন বছর ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াশোনা করেন। যার ফলে তিনি বিস্ফোরক তৈরি করতে শিখেছিলেন। ফিলিস্তিনে প্রবেশের অনুমতি পাওয়ার কারণে তিনি পড়াশোনা শেষ করেননি।
এক দিন চাচাতো ভাই বিলাল আল-বারগৌথিকে পশ্চিম তীরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়ে যায় এবং তার দক্ষতা দেখানোর আগ পর্যন্ত তার আশেপাশের কেউই বিস্ফোরক তৈরির বিষয়ে তার দক্ষতা সম্পর্কে জানত না।
বিলাল তার কমান্ডারকে এ বিষয়ে বলার পর আবদুল্লাহ বারগৌথিকে কাসাম ব্রিগেডসের দলে যোগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়।
ডেটোনেটর তৈরির পাশাপাশি আলু থেকে বিস্ফোরক যন্ত্র এবং বিষাক্ত পদার্থ তৈরিতে কাজ করেছিলেন এই ‘ইঞ্জিনিয়ার’। বারঘৌতি তার শহরের একটি গুদামে সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনের জন্য বিশেষ কারখানা স্থাপন করেছিলেন।
ইসরাইলি বিশেষ বাহিনী ২০০৩ সালে আকস্মিকভাবে বারঘৌতিকে গ্রেফতার করার পর তাকে তিন মাস জিজ্ঞাসাবাদে রাখা হয়।
বারঘৌতিকে কয়েক ডজন ইসরাইলির মৃত্যুর জন্য দায়ী মনে করা হয় আর তার দ্বিতীয়বার বিচারের সময় অনেক নিহতদের পরিবারের সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
তাকে ৬৭টি যাবজ্জীবন এবং পাঁচ হাজার ২০০ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়, যা ইসরাইলের ইতিহাসে দীর্ঘতম সাজা। এটি সম্ভবত মানব ইতিহাসেও সর্বোচ্চ।
তাকে কিছু সময়ের জন্য নির্জন কারাগারে রাখা হয়েছিল। কিন্তু তার অনশনে যাবার কারণে এটি বন্ধ করা হয়।
বারঘৌতিকে ‘ছায়ার রাজপুত্র’ নামে ডাকা হয়। কারণ কারাগারে থাকার সময় তিনি এই নামে এই বই লিখেছিলেন। বইটিতে তিনি তার জীবন ও অন্য বন্দীদের সাথে যে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন তার বিশদ বিবরণ দিয়েছেন। কিভাবে তিনি ইসরাইলি সামরিক চেকপোস্টের মাধ্যমে বিস্ফোরক পেয়েছিলেন, কিভাবে অনেক দূরে বোমা হামলা পরিচালনা করেছিলেন সে বিষয়ে বর্ণনা দিয়েছেন।
ইসমাইল হানিয়ে
আবু আল-আবদ ডাকনামের ইসমাইল আবদেল সালাম হানিয়ে জন্মেছিলেন ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরে। তিনি হামাস আন্দোলনের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান এবং ফিলিস্তিন সরকারের দশম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ২০০৬ সাল থেকে তিনি ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ইসরাইল ১৯৮৯ সালে তাকে তিন বছর বন্দী করে রাখে। এরপর তাকে মারজ আল-জুহুর নামের ইসরাইল এবং লেবাননের মধ্যকার একটি নো-ম্যানস-ল্যান্ডে নির্বাসিত করা হয়।
সেখানে তিনি ১৯৯২ সালে বেশ কয়েকজন হামাস নেতার সাথে অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে একটি পুরো বছর কাটিয়েছিন।
নির্বাসনে থাকার পর তিনি গাজায় ফিরে আসেন এবং ১৯৯৭ সালে হামাস আন্দোলনের আধ্যাত্মিক নেতা শেখ আহমেদ ইয়াসিনের অফিসের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন, যা তার অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করে।
২০০৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি হামাস তাকে ফিলিস্তিনের প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করে এবং একই মাসের ২০ তারিখ তাকে নিযুক্ত করা হয়।
এক বছর পর ফিলিস্তিনের জাতীয় কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস হানিয়ে তার পদ থেকে বরখাস্ত করেন। কারণ ইজ আল-দিন আল-কাসাম ব্রিগেডস গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নেয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে আব্বাসের ফাতাহ আন্দোলনের প্রতিনিধিদের বহিষ্কার করে। সেই সহিংসতায় অনেকে মারা যায়।
হানিয়ে তার বরখাস্তকে ‘অসাংবিধানিক’ বলে প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘তার সরকার দায়িত্ব অব্যাহত রাখবে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি তাদের জাতীয় দায়িত্ব ছেড়ে যাবে না।’
হানিয়ে এর পর বেশ কয়েকবার ফাতাহ আন্দোলনের সাথে সমঝোতার আহ্বান জানিয়েছে। ২০১৭ সালের ৬ মে তিনি হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান নির্বাচিত হন। ২০১৮ সালে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর হানিয়েকে সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে।
খালেদ মেশাল
খালেদ মেশাল ‘আবু আল-ওয়ালিদ’ ১৯৫৬ সালে সিলওয়াদের পশ্চিমতীরের একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারসহ কুয়েতে চলে যাওয়ার আগে তিনি সেখানেই প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। আর কুয়েতে যাওয়ার পর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন।
মেশাল হামাস আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এর রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য।
১৯৯৬ এবং ২০১৭ সালের মধ্যে তিনি রাজনৈতিক ব্যুরোর সভাপতিত্ব গ্রহণ করেন এবং ২০০৪ সালে শেখ আহমেদ ইয়াসিনের মৃত্যুর পর এর নেতা নিযুক্ত হন।
ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ১৯৯৭ সালে মেশালকে হত্যার জন্য গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের প্রধানকে নির্দেশ দেন। তিনি এই হত্যাকাণ্ড চালানোর জন্য একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত করতে বলেছিলেন।
মোসাদের ১০ জন এজেন্ট কানাডার জাল পাসপোর্ট নিয়ে জর্ডানে প্রবেশ করে ওই সময়ে জর্ডানের নাগরিক খালেদ মেশালকে রাজধানী আম্মানের একটি রাস্তায় হাঁটার সময় বিষাক্ত পদার্থ দিয়ে ইনজেকশন দেয়া হয়।
জর্ডানের কর্তৃপক্ষ হত্যা প্রচেষ্টার সন্ধান পায় এবং জড়িত দুই মোসাদ সদস্যকে গ্রেফতার করে।
জর্ডানের মরহুম রাজা হুসেইন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর কাছে মেশালকে যে বিষাক্ত পদার্থের ইনজেকশন দেয়া হয়েছিল তার প্রতিষেধক চান। কিন্তু নেতানিয়াহু প্রথমে ওই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের হস্তক্ষেপে নেতানিয়াহুকে প্রতিষেধক সরবরাহ করতে বাধ্য করায় এই হত্যা প্রচেষ্টা একটি রাজনৈতিক মাত্রা নেয়।
মেশাল ২০১২ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো গাজা উপত্যকায় যান। ১১ বছর বয়সে তিনি চলে যাওয়ার পর ফিলিস্তিনি অঞ্চলে এটাই তার প্রথম সফর ছিল। রাফাহ ক্রসিংয়ে পৌঁছানোর পর বিভিন্ন দল ও জাতীয় পর্যায়ের ফিলিস্তিনি নেতারা তাকে অভ্যর্থনা জানায় এবং গাজা শহরে পৌঁছনো পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের তাকে অভ্যর্থনা জানাতে রাস্তার ধারে ভিড় করে।
২০১৭ সালের ৬ মে আন্দোলনের শুরা কাউন্সিল ইসমাইল হানিয়াহকে রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান হিসাবে নির্বাচিত করে।
মাহমুদ যাহার
মাহমুদ জাহার ১৯৪৫ সালে গাজার একজন ফিলিস্তিনি বাবা ও একজন মিশরীয় মায়ের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন এবং মিশরের ইসমাইলিয়া শহরে তার শৈশব কাটান।
গাজাতেই তিনি প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ১৯৭১ সালে কায়রোর আইন শামস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জেনারেল মেডিসিনে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৭৬ সালে জেনারেল সার্জারিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। স্নাতকের পর তার রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ তাকে বরখাস্ত করার আগ পর্যন্ত তিনি গাজা ও খান ইউনিসের হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে কর্তব্যরত ছিলেন।
জাহারকে হামাসের অন্যতম প্রধান নেতা এবং আন্দোলনের রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
হামাস আন্দোলনের প্রতিষ্ঠার ছয় মাস পর ১৯৮৮ সালে মাহমুদ জাহারকে ছয় মাস ইসরাইলি কারাগারে রাখা হয়েছিল। ১৯৯২ সালে ইসরাইল থেকে মারজ আল-জুহুরে নির্বাসিত ব্যক্তিদের মধ্যে তিনিও ছিলেন, যেখানে তিনি পুরো এক বছর কাটিয়েছেন।
২০০৫ সালে হামাস আন্দোলন আইনসভা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর থেকে প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ফিলিস্তিন সরকারকে বরখাস্ত করার আগ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ইসমাইল হানিয়াহর সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন যাহার।
ইসরাইল ২০০৩ সালে গাজা শহরের রিমাল এলাকায় যাহারের বাড়িতে এফ-১৬ বিমান থেকে অর্ধটন ওজনের একটি বোমা ফেলে তাকে হত্যার চেষ্টা করে। হামলায় তিনি সামান্য আহত হলেও তার বড় ছেলে খালেদের মৃত্যু হয়।
২০০৮ সালের ১৫ জানুয়ারি গাজার পূর্বে ইসরাইলি অভিযানে নিহত ১৮ জনের একজন ছিলেন তার দ্বিতীয় ছেলে হোসাম। হোসাম কাসাম ব্রিগেডের সদস্যও ছিলেন।
‘দ্য প্রবলেম অফ আওয়ার কনটেম্পরারি সোসাইটি… আ কোরআনিক স্টাডি’ বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর লেখা বইয়ের প্রতিক্রিয়ায় ‘নো প্লেস আন্ডার দ্য সান’ এবং ‘অন ফুটপাথ’ নামের উপন্যাসসহ যাহারের বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক কাজ রয়েছে।
সূত্র : বিবিসি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।