নেশার টাকার জন্যই বৃদ্ধ মা খুকি খাতুনকে (৬৫) পুড়িয়ে হত্যা করে মাদকাসক্ত, ভবঘুরে ও বখাটে বগুড়ার ধুনটের সোহানুর রহমান খোকন মণ্ডল (৩২)।
রোববার বিকালে ধুনট উপজেলার চিকাশী ইউনিয়নের গজারিয়া গ্রামের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
সোমবার স্থানীয় লোকজন, জনপ্রতিনিধি, পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ সব তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেশীরা জানান, গজারিয়া গ্রামের আবদুস সামাদ মণ্ডল ও খুকি খাতুন দম্পতির দুই ছেলে ও তিন মেয়ে। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। বাড়িতে বৃদ্ধা বাবা-মা ছাড়াও ছেলে জাকির হোসেন মণ্ডল ও সোহানুর রহমান খোকন মণ্ডল পরিবার নিয়ে থাকে।
খোকন ছোট হওয়ায় সে পরিবারের সবার প্রিয়। অতি আদরের কারণে স্কুলের গণ্ডি পেরুতে পারেনি। অসৎ সঙ্গের কারণে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে। সংসারি করতে তাকে বিয়ে করানো হয়।
দাম্পত্য জীবনে দুটি মেয়ে সন্তানের জন্ম হয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও তাকে কোনো কাজে ঢোকানো যায়নি। ব্যবসা, খামার ও বিভিন্ন কাজ শুরুর নামে পরিবার থেকে দফায় দফায় টাকা নিলেও তা মাদক সেবনে ব্যয় হয়েছে।
এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে স্ত্রীও নির্যাতনের শিকার হন। বাধ্য হয়ে তিনি দুই মেয়েকে নিয়ে এক বছর আগে বাপের বাড়ি চলে গেছেন।
প্রতিবেশীরা আরও জানান, খোকন প্রায়ই নেশার টাকার জন্য বাবার কাছে বায়না ধরত। কিন্তু টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে মাকে ঘরের মধ্যে জিম্মি করে অস্ত্র দেখিয়ে বাবাকে ভয় দেখাত। বাধ্য হয়ে আব্দুস সামাদ মণ্ডল টাকা সংগ্রহ করে ছেলের কাছ থেকে স্ত্রী খুকি খাতুনকে উদ্ধার করতেন।
গত বছর মাদক সেবনের অভিযোগে খোকন মণ্ডলকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। কয়েকদিন কারাভোগের পর বাড়ি ফিরে আবারও মাদকসেবন শুরু করে। সে ইয়াবা, গাঁজা, ফেনসিডিলসহ বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য সেবনে অভ্যস্ত।
মাদকাসক্ত ছেলের হাত থেকে নিজেদের নিরাপত্তার উদ্যোগ নিয়েছিলেন আব্দুস সামাদ মণ্ডল। ২০১৮ সালে কৌশলে খোকনকে পুলিশে ধরিয়ে দেন তিনি। কিন্তু কারাগারে সাক্ষাতের সময় স্বজনদের হুমকি ও ভয়ভীতি দেখালে আব্দুস সামাদ বাধ্য হয়ে জমি বিক্রি করে খোকনের জামিনের ব্যবস্থা করেন। ছেলের মাদকসেবনের ব্যয় মিটাতে তিনি প্রায় ৫ বিঘা জমি খুইয়েছেন।
সর্বশেষ রোববার বিকালে খোকন ধারালো অস্ত্র ধরে মা খুকি খাতুনকে জিম্মি করে বাবার কাছে ৫ হাজার টাকা দাবি করে। বাবা টাকা দিতে রাজি না হলে হাসুয়া দিয়ে ভয় দেখায়। তখন বাবা বাধ্য হয়ে টাকা সংগ্রহের জন্য প্রতিবেশীদের কাছে যান।
টাকা না পাওয়ায় সামাদ মণ্ডল বাড়িতে ফিরতে দেরি হওয়ায় খোকন আরও ক্ষিপ্ত হয়। সে নিজের মোটরসাইকেল থেকে পেট্রল বের করে ঘরে যায়। উচ্চ শব্দে সাউন্ডবক্সে মিউজিক চালিয়ে দেয়। প্রথমে মা খুকি খাতুনের মুখে কাপড় গুজিয়ে দেয়। এরপর রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলে।
মাকে ঘরের মেঝেতে ফেলে দিয়ে গায়ের ওপর কম্বল বিছিয়ে দেয়। পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে আগুন খুকি বেগমের পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। মুখের মধ্যে কাপড় থাকায় তিনি আর্তনাদ বা চিৎকার করতে পারেননি।
এ সময় খোকন ঘর থেকে দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করে। ঘরের মধ্যে আগুন জ্বলতে দেখে প্রতিবেশীরা খোকনকে আটক করেন। তারা ঘরের ভিতর খুকি খাতুনকে দগ্ধ অবস্থায় দেখেন। ক্ষিপ্ত জনগণ খোকনকে মারপিট এবং অচেতন মা খুকিকে উদ্ধার করে বগুড়া শজিমেক হাসপাতালের দিকে পাঠান।
পুলিশ এসে খোকনকে আটকের পর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে দেয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে পথিমধ্যে গাবতলীর গোলাবাড়ি এলাকায় খুকি মারা যান। পরে তার লাশ বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়।
ধুনট থানা পুলিশ সোমবার সকালে খুকির লাশ বগুড়া শজিমেক হাসপাতাল মর্গে পাঠায়। ময়নাতদন্ত শেষে সোমবার বাদ আসর খুকির লাশ দাফন করা হয়েছে।
বগুড়ার ধুনটের চিকাশী ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য রোকনুজ্জামান বিপ্লব জানান, নেশার টাকা না পেয়ে খোকন একাই তার মাকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। গ্রামবাসী খোকনের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।
বগুড়ার শেরপুর ও ধুনট সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গাজিউর রহমান জানান, প্রাথমিক তদন্তে পাওয়া গেছে, ছেলে খোকন মণ্ডলই নেশার টাকা না পেয়ে মা খুকি খাতুনকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। আলামত হিসেবে হাত-পা বাঁধার রশি, মুখে গুজিয়ে দেয়া কাপড়, পোড়া কম্বল সংগ্রহ করা হয়েছে। খোকন মণ্ডল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন রয়েছে। সেখান থেকে ছাড়া হলে তাকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
তিনি বলেন, হত্যার দায় স্বীকার না করলে আদালতে হাজির করে রিমান্ডের আবেদন করা হবে।
এদিকে নিহত খুকির বড় ছেলে জাকির হোসেন মণ্ডল সোমবার সন্ধ্যায় ধুনট থানায় ছোট ভাই খোকনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
খোকনের বিরুদ্ধে ধুনট থানায় আরও দুটি মাদকের মামলা রয়েছে বলে জানা গেছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।