রঞ্জু খন্দকার, গাইবান্ধা থেকে : একসময় উত্তরাঞ্চলে কার্তিক মাসে কৃষকের হাতে কাজ থাকত না। সেই সময় দিন যেন কাটতই না। স্থানীয় ভাষায় একে বলা হতো ‘আকাল’। কার্তিকের পরেই পেট ভরা ফসল নিয়ে হাজির হতো অঘ্রান। মনের সুখে আমন ধান কেটে আঁটি বেঁধে উঠোন ভরাতেন কৃষক। কিন্তু যাঁদের জমি নেই? তাঁরাও দলবেঁধে হাজির হতেন মাঠে। কৃষকের ফেলে যাওয়া বিরান মাঠে ধানের শীষ কুড়োতেন তাঁরা।
এই শীষ কুড়ানির দল কি এখনো আছে? এখনো কি ফসল নিয়ে যাওয়ার পর দলবেঁধে মাঠে নামেন তাঁরা? শীষ কুড়ানোর পাশাপাশি ইঁদুরের গর্ত খুঁড়ে ধান বের করেন কেউ? নাকি উন্নয়নের তোড়ে ভেসে গেছেন তাঁরা?
সম্প্রতি গাইবান্ধার পলাশবাড়ী ও গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কয়েকটি মাঠে দেখা মিলল শীষ কুড়ানি কয়েকজনের।
গোবিন্দগঞ্জের ডুমুরগাছা গ্রামের বগার বিলে আমনের খেতে একমনে শীষ কুড়োচ্ছিলেন শারমিন আক্তার ও স্বপ্না খাতুন (ছদ্মনাম)। ওদের বয়স ১৪-১৫ বছর। দুই বোন। স্থানীয় হাইস্কুলে নবম ও দশম শ্রেণিতে পড়ে ওরা। এখন বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। দুপুরে পরীক্ষা শেষ করে বিকেলে গামলা নিয়ে শীষ কুড়োতে এসেছে ওরা।
শারমিন বলে, বাবা শহরে থাকে। অনেক কষ্ট করে সামান্য কিছু টাকা পাঠায়। তা দিয়ে কী-ই বা হয়। বসে থাকলে তো ভাত পাওয়া যায় না। তাই শীষ কুড়োতে এসেছে ওরা।
জানা গেল, ওদের বাবা নারায়ণগঞ্জ শহরে ভ্যান চালান। দুই ভাইও একই শহরে থাকেন। এক ভাই পোশাক কারখানার কর্মী, অন্যজন ফেরিওয়ালা। ওদের সংসার আছে। বাড়িতে ওরা দুই বোন, সঙ্গে মা। বাবার পাঠানো টাকায় টানাটানি কাটে না। তাই সময় বের করে ধান কুড়োতে এসেছে ওরা।
স্বপ্না বলল, দুই ভাইয়ের সংসারেও অভাব। এক ভাইয়ের ছেলেও হয়েছে। বাড়িতে খাওয়া খরচের পাশাপাশি পড়ালেখারও খরচ আছে। সামান্য যা ধান পাওয়া যায়, সেটুকুই বা কোথায় পাওয়া যায়?
একটু দূরেই কোদাল হাতে দেখা মিলল ওদের মায়ের। নাম ছকিনা বেগম (ছদ্মনাম)। বয়স পঞ্চাশও হতে পারে, চল্লিশও। তবে শরীরে দম আছে বোঝা যায়। কোদাল চালিয়ে ইঁদুরের গর্তের অনেকখানিই খুঁড়ে ফেলেছেন তিনি। কিন্তু পর্যাপ্ত ধান মিলল না।
ছকিনা বললেন, আজকাল নানা পদ্ধতি বের হওয়ায় খেতে ইঁদুর কম লাগে। এতে কৃষকের তো অবশ্যই লাভ হয়। শুধু তাঁদের মতো গরিবের ভাগে কম পড়ে।
শীষ কুড়ানোর এই দলটি জানায়, আগে তাঁদের নিজেদের জমি ছিল। অভাবের কারণে বেচে-কিনে তা শেষ হয়ে গেছে। সংসারের কর্তা বাড়িতে থাকলে তবু জমি বর্গা নিয়ে চাষ করা যেত। এখন সেটাও করা হয় না।
শুধু জমিহীন এই পরিবারটি নয়, পলাশবাড়ীর কুমারগাড়ী গ্রামের নাটোগাড়ী বিলে নিজের জমিরই শীষ কুড়োচ্ছিলেন সামিরুলের পরিবার। তাঁর দুই ছেলে শিহাব ও সৈকত শীষ কুড়ানোর পাশাপাশি ইঁদুরের গর্তও খুঁড়ছিল।
শিহাব ও সৈকতের বয়স ১০-১১ বছর হবে। ওরা জানায়, ওদেরও বার্ষিক পরীক্ষা চলছে। দুপুর পর্যন্ত পরীক্ষা দিয়ে এখন শীষ কুড়োতে এসেছে। শীষ কুড়িয়ে যে ধান পাওয়া যাবে তা ওদের নিজের, বলে দিয়েছেন বাবা। এই ধান বেচে ওরা বাজার থেকে মিষ্টি কিনে খাবে।
নিজের কষ্টের ধান নষ্ট না করতে এই কৌশল নিয়েছেন বলে জানালেন সামিরুল। তিনি বললেন, তাঁর খুব বেশি জমি নেই। অন্যের জমি ইজারা নিয়ে আবাদ করেছেন। নিজেই মেহনত করে আবাদ করেন। সেই জমির ধান পড়ে থাকলে খারাপ লাগে। তাই ছেলেদের বুঝিয়েছেন, কুড়িয়ে যা ধান পাওয়া যাবে, তা ওদের নিজের। সেই ধান বেচে ওদের মিষ্টি খাওয়া তো চলবে!
এসব বিষয়ে কথা হয় গাইবান্ধার আহম্মদ উদ্দিন শাহ শিশু নিকেতন স্কুল এন্ড কলেজের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক আহসান হাবীব মণ্ডলের সঙ্গে। তিনি বলেন, ছোটবেলায় তিনিও নিজেদের জমিতে শীষ কুড়িয়েছেন। ইঁদুরের গর্ত থেকে ধান বের করেছেন। এটা মজার স্মৃতি। কালের বিবর্তনে দেশের উন্নয়ন ঘটেছে। অভাবও কমেছে। তবুও কিছু মানুষ এখনো শীষ কুড়ান। গর্ত খুঁড়ে ধান বের করেন। এটা স্মৃতি হিসেবে যত মজারই হোক, অভাব থেকেই করা হয়। তবে এতে অপচয় কম হয়। পরে যাওয়া ধানও নষ্ট কম হয়। দেশের অর্থনীতিতে সামান্য হলেও কিছু যোগ হয়।
ওয়ালটন বাংলাদেশকে গর্বিত ও সম্মানিত করেছে : এনবিআর চেয়ারম্যান
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।