কিংবদন্তি অভিনয়শিল্পী আনোয়ার হোসেনের দশম প্রয়াণ দিবস ছিল গত ১৩ সেপ্টম্বর। ২০১৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
আনোয়ার হোসেন পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে পাঁচ শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। মঞ্চ, টিভিতে অভিনয় করেছে। ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন অমায়িক ও প্রচার বিমুখ। আনোয়ার হোসেনকে নিয়ে ফিল্ম আর্কাইভ থেকে বেরিয়েছে তাঁর জীবন ও কর্মনিয়ে গবেষণাধর্মী বই।
বইটির লেখক ইসমত জেরিন স্মিতা বলেন, গবেষণার জন্য আনোয়ার হোসেন শিল্পী সম্পর্কে জানতে অনেকের কাছে গেছি। সবার মতামতে জানা গেছে তিনি ছিলেন একজন মাটির মানুষ। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই যে কোন চরিত্রকে আয়ত্ব করতে পারতেন তিনি। একজন সহজাত অভিনেতা। সহজ সরল এবং সাবলীল অভিনয়ের জন্য দেশের সর্বস্তরের মানুষের মন জয় করেছিলেন।
তিনি আরও বলেন, প্রথম জীবনে খলনায়কহিসেবে জনপ্রিয়তার পাশাপাশি সিরাজউদ্দৌলা চলচ্চিত্রে নায়ক হিসেবে অভিনয় করে পেয়েছেন নবাব উপাধি। তবে মধ্য বয়স থেকে বড় ভাই, বাবা এবং শেষ জীবনে দাদা-নানার চরিত্রেও মুগ্ধতা ছড়িয়ে গেছেন তিনি। মোটকথা এই ধরনের মাটি ও মানুষের অভিনয়শিল্পী আর দ্বিতীয়টি আসবেনা বলেই আমি বিশ্বাস করি।’
আনোয়ার হোসেন ১৯৩১ সালের ৬ নভেম্বর জামালপুর জেলার মুরুলিয়া গ্রামের মিয়াবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা এ কে এম নাজির হোসেন ছিলেন জেলা সাব-রেজিস্টার। মায়ের নাম সাঈদা খাতুন। নজির-সাঈদা দম্পতির তৃতীয় সন্তান আনোয়ার হোসেন। তিনি ১৯৪০ সালে দেওয়ানগঞ্জ প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হন এবং ১৯৫১ সালে তিনি জামালপুর স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। স্কুল জীবনেই সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়েছিলেন আনোয়ার হোসেন। পরবর্তীতে ভর্তি হন ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজে। এরপর কলেজে ভর্তি হয়ে নাট্যদলে যোগ দেন। কলেজের প্রথম বর্ষে আসকার ইবনে শাইখের ‘পদক্ষেপ’ নাটকে অভিনয় করেন। কলেজে প্রথম বর্ষের পরীক্ষা দিয়েই ১৯৫৭ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। এ বছর নাসিমা খানমকে বিয়ে করেন।
আনোয়ার হোসেন ১৯৫৯ সালে ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে ননী দাস নির্দেশিত ‘এক টুকরো জমি’নাটকে অভিনয় করেন। পরে তিনি ঢাকা বেতারে অডিশন দেন এবং ‘হাতেম তাই’ নাটকে একটি অপ্রধান চরিত্রে কাজ করেন। ধীরে ধীরে তিনি মঞ্চ নাটকে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। এক পর্যায়ে ‘ঝিনুক’ পত্রিকার সম্পাদক আসিরুদ্দিনের সহযোগিতায় মিনার্ভা থিয়েটার গঠন করেন। এই থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হোন সৈয়দ হাসান ইমাম, ফতেহ লোহানী, মেহফুজ, সুভাষ দত্ত, চিত্রা সিনহাসহ অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব।
১৯৬১ সালে মহিউদ্দিন পররিচালিত ‘তোমার আমার’ চলচ্চিত্রে খল চরিত্রে অভিনয়ের সুযোগ পান। পরে সালাহউদ্দিন পরিচালিত ‘সুর্যস্নান’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে নায়ক চরিত্রে আনোয়ার হোসেনের যাত্রা শুরু। তবে ১৯৬৭ সালে নির্মিত ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ চলচ্চিত্রটি আনোয়ার হোসেনকে তারকাখ্যাতি এনে দিয়েছিল। বাংলার শেষ নবাবের জীবন অবলম্বনে নির্মিত এই চলচ্চিত্র দেশের সমস্ত প্রান্তে জনপ্রিয়তা লাভ করে।
এরপর তিনি ‘জোয়ার এলো’ (১৯৬২), ‘কাঁচের দেয়াল’ (১৯৬৩), ‘নাচঘর’ (১৯৬৩), ‘দুই দিগন্ত’ (১৯৬৬), ‘বন্ধন’ (১৯৬৪), ‘একালের রূপকথা’ (১৯৬৫) চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। তার ও সুমিতা দেবী অভিনীত ‘দুই দিগন্ত’ চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে ঢাকার বলাকা সিনেওয়ার্ল্ডের উদ্বোধন হয়েছিল। তার অভিনীত প্রথম উর্দু ভাষার চলচ্চিত্র ‘উজালা’। এটি ১৯৬৬ সালে মুক্তি পায়।
১৯৬৭ সালে ‘নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা’ চলচ্চিত্রে নাম ভূমিকায় অভিনয় করে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি অর্জন করেন’। তিনি ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক, নাট্যধর্মী, লোককাহিনীভিত্তিক, পোশাকি ফ্যান্টাসি, সাহিত্যনির্ভর, শিশুতোষ, পারিবারিক মেলোড্রামা, বক্তব্যধর্মীসহ বিভিন্ন ধরনের চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। ঢাকার চলচ্চিত্রের এই কিংবদন্তী অভিনেতা ৫২ বছরের অভিনয় জীবনে পাঁচ শতাধিক চলচ্চিত্রে কাজ করেছেন।
এক সাক্ষাৎকারে নিজের অভিনয় জীবনের শুরুর কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন ‘ছোটবেলায় স্কুলের নাটকে অভিনয় করতে গিয়েই অভিনয়ের প্রতি আমার আসক্তি। এরপর তখনকার রূপালী জগতের তারকা ছবি বিশ্বাস, কাননদেবী এদের বিভিন্ন ছবি দেখতে দেখতেই রূপালী জগতে আসার ইচ্ছাটি প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে ওঠে। পঞ্চাশ দশকের শেষের দিকে সিদ্ধান্ত নিলাম অভিনয় করবো সারাজীবন। সুতরাং অন্য কোন জীবিকার সন্ধান না করে সরাসরি চলে গেলাম পরিচালক মহিউদ্দিন সাহেবের কাছে। তিনি আমাকে নিয়ে শুরু করলেন ‘তোমার আমার’ ছবিটির কাজ। এখানে আমাকে নির্বাচন করা হলো খল- নায়কের চরিত্রে। আমার রূপালী পর্দায় অভিষেক হলো ‘বীরেন’ হিসেবে।’
অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র : ‘সূর্যস্নান’, ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘জয় বাংলা’, ‘অরুণোদ্বয়ের অগ্নিসাক্ষী’, লাঠিয়াল’, ‘পালঙ্ক’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘সুন্দরী’, ‘সখিনার যুদ্ধ’, ‘নাজমা’, ‘সূর্যগ্রহণ’, ‘সূর্য সংগ্রাম’, ‘দায়ী কে’, ‘সত্য মিথ্যা’, ‘নয়নমণি’, ‘ভাত দে’, ‘চাকর’, ‘অনন্ত ভালোবাসা’, ‘অচেনা’, ‘তোমার আমার’, ‘কাচের দেয়াল’, ‘বন্ধন’, ‘রাজা সন্ন্যাসী’, ‘অপরাজেয়’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘রংবাজ’, ‘ধীরে বহে মেঘনা ‘, ‘লাঠিয়াল’, ‘পালঙ্ক’, ‘রূপালী সৈকতে’, ‘নয়নমনি’, ‘কুয়াশা’, ‘নাগরদোলা’, ‘বড় ভাল লোক ছিল’, ‘ভাত দে’, ‘জোয়ার এলো’, ‘নাচঘর’, ’দুই দিগন্ত’, ‘পরশমণি’, ‘শহীদ তিতুমীর’, ‘ঈশা খাঁ’, ‘অরুণ বরুণ কিরণমালা’, ‘চাকর’, ‘অনন্ত ভালবাসা’ প্রভৃতি ।
আনোয়ার হোসেন ছিলেন প্রথম অভিনেতা, যিনি অভিনয়ের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং একুশে পদক লাভ করেছিলেন। বর্ণাঢ্য জীবনে তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং একবার আজীবন সম্মাননা পান তিনি।
‘নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে নিগার পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৫ সালে তিনি নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ‘লাঠিয়াল’ চলচ্চিত্রে কাদের লাঠিয়াল চরিত্রে অভিনয় করেন। ১৯৭৫ সালে ‘লাঠিয়াল’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে প্রথমবারের মত আয়োজিত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এই কাজের জন্য তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের প্রথম আয়োজনে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার পুরস্কার লাভ করেন। অভিনেতাদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি আমজাদ হোসেনের ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদানের জন্য তাকে একুশে পদক প্রদান করা হয়।
২০১০ সালে আনোয়ার হোসেনকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয়।এছাড়াও একাধিকবার বাচসাস চলচ্চিত্র পুরস্কার, মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন।
যতদিন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র থাকবে ততদিন আনোয়ার হোসেনের নাম অমর হয়ে থাকবে। তিনি ছিলে মাটি ও মানুষের শিল্পী। প্রচার বিমুখ থাকার পরেও তিনি অভিনয় দক্ষতার মাধ্যমে সবার মন জয় করে নিয়েছিলন। তিনি নবাব হিসেবে যেমন সফর তেমনি লাঠিয়াল হিসেবেও ছিলেন সার্থক। তাঁর প্রতি রইলো শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।