মোঃ নাজমুল হক বিপ্লব : বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে বহুমত এবং বহুদলের লোকজনের বসবাস। আপনি একটি নির্দিষ্ট মতের হয়ে বিপরীত মতকে কিভাবে দমায় রাখবেন এখানে? অন্যের চিন্তা চেতনার স্বাধীনতাকে হরণ করলে কিংবা তাদেরকে মানসিকভাবে সংকটাপন্ন করে রাখলে প্রকৃতিগত কারণে তারা কোনও না কোনও সময় জেগে উঠবে-এটাই স্বাভাবিক।
আমাদের চিন্তা চেতনাগুলোকে নতুন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে সাজাতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে এখানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে হবে। দেশ ও জাতি এই সুন্দর দেশটাকে আর পিছনের সারিতে দেখতে চায় না। জনগণ এখন উন্নত সমৃদ্ধ ও পরিশুদ্ধ বাংলাদেশের বাস্তবায়ন চায়। দেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য রাজনীতিবিদদের জনগণের মনের ভাষা বুঝতে হবে।
একটি দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার বড় কারণ হলো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দুর্বলতা ও পরমতসহিষ্ণুতার অভাব। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য দরকার সকলের অংশগ্রহণে অবাধ, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পাশাপাশি সামাজিক অস্থিরতাও বৃদ্ধি পায়। ফলে অর্থনীতির সংকট উত্তরণ কঠিন হয়ে পড়ে। আর গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে বিদেশীরাও বিনিয়োগ করতে আসে, স্থানীয় লোকেরা কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে, অর্থনীতির অন্যান্য খাতগুলো সচল হতে শুরু করে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে দেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চলে আসবে।
অর্থনীতির বর্তমান যে সংকট তা একদিনে তৈরি হয়নি। এটি এখন আর নির্দিষ্ট খাতেও সীমাবদ্ধ নেই। সব খাতে এ সংকট ছড়িয়ে পড়েছে। আমরা জানি সামষ্টিক অর্থনীতির চলকগুলো একটি অন্যটির ওপর নির্ভরশীল। একটি খারাপ হলে অন্যগুলোর উপরেও এর প্রভাব পড়ে। তবে আপাতত ৩টি সমস্যা মোকাবিলা করা জরুরি। এগুলো হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, রিজার্ভ পরিস্থিতিতে স্বস্তি আনা। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের ওপর নজর দেওয়া প্রয়োজন।
বিগত সরকারের সময় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে, ব্যাংকিং কার্যক্রমকে যেভাবে বিঘ্নিত করা হয়েছে এবং পছন্দের ব্যক্তিদেরকে নির্দিষ্ট জায়গায় বসিয়ে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে প্রমোশন দিয়ে দুর্নীতির যে মহাকাব্য রচনা করা হয়েছে যা আজ জাতির সামনে উন্মোচিত।
বিগত সরকারের সময় রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি, প্রমোশন বৈষম্য এবং বিপক্ষ দল-মতকে দমন ও পীড়নের কারণে রাষ্ট্রীয় প্রায় সবপ্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে যায়। আর এসবের কারণে জনগণকে সেবা দানের স্বাভাবিক কার্যক্রমও বাধাগ্রস্থ হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধান দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা তাদের অধীনস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা সংকুচিত করে তারা তাদের নিয়োগ কর্তাদের খুশি রাখতে এবং তাদের ফরমায়েশ পালনে ব্যস্ত ছিলেন। ফলে রাষ্ট্রীয় প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নিয়ম শৃংখলা ভেঙ্গে গিয়েছিল। সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে মানুষ বঞ্চনা ও নিগ্ৰহের শিকার হতেন। পট পরিবর্তনের পর এখন সময় এসেছে সংশ্লিষ্টদেরকে জনগণের পালস বুঝে দায়িত্ব পালন করা। নতুন করে আর যাতে কোনও অন্যায় অবিচার না হয় সে বিষয়ে সজাগ থাকা। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বৃত্তায়ন এখনই বন্ধ করার উপযুক্ত সময়।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেভাবে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সেবার সাথে যুক্ত করে বৃহত্তর অর্থনীতিতে অবদান রাখার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশ থেকে রেমিট্যান্স আহরণে বিভিন্ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে সেভাবে তাদের কখনই মূল্যায়ন করা হয়নি।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহকর্মরত জনবল প্রায় ষাট হাজারের অধিক। এই বিশাল জনবলের পদোন্নতি এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে বিগত সরকার তেমন কোনও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ফলে পদোন্নতি এবং অন্যান্য প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন অনেকেই। প্রশাসন ক্যাডারে কর্মরতরা দু-এক বছর বঞ্চিত হলেই তারা তাদের পদোন্নতি নীতিমালা অনুযায়ী পদোন্নতি পেয়ে যান। কিন্তু ব্যাংকারদের অনেকেই আট-দশ বছর পর্যন্ত একই পদে কর্মরত আছেন। তাদের জন্য নেই কোনো কার্যকর অর্গানোগ্রাম বা জনবল কাঠামোর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। অর্থাৎ এখানে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক থেকে অফিস সহকারী পর্যন্ত কোন স্তরে কত সংখ্যক জনবল থাকবে, কতটি স্তর হবে, কোন কর্মকর্তা কিভাবে প্রমোশন পাবে এবং কতদূর পর্যন্ত প্রমোশন পেয়ে যেতে পারবে-এই সকল বিষয়ে উল্লেখ থাকার কথা। এখানে জনবল কাঠামো আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে পরিবর্তন করা হয়নি। ফলে একের পর এক সার্কুলার /প্রজ্ঞাপন জারি করেও পদোন্নতির নামে হয়রানি করা হয়েছে। অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বছরের পর বছর প্রমোশন না দিয়ে কালক্ষেপণ করা হয়েছে এতে করে অনেক মেধাবী, সৎ ও যোগ্য ব্যাংকার তাদের কর্মস্পৃহা এবং মনোবল হারিয়ে ফেলেছেন। তারা এখন হতাশায় ভুগছেন। এমনকি তাদের ভবিষ্যৎ নিয়েও তারা শঙ্কায় আছেন। চোখের কোনে জল আর বুকভরা দীর্ঘশ্বাসই এখন তাদের সঙ্গী।
দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তির এসব কারিগরদের আর কতদিন দাবায়ে রাখবেন এবং তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করবেন। এখন সময় এসেছে অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে কর্মরত কর্মকর্তা- কর্মচারীদের জন্য আধুনিক যুগোপযোগী বর্তমান জনবলের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সুপার নিউমারারি পদোন্নতি অথবা জরুররি ভিত্তিতে অর্গানোগ্রাম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে ঢেলে সাজানো। এখানে কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া যাবে না। সেইসাথে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউকে তাদের দায়িত্ব এবং তদারকি সঠিকভাবে পালন করতে পারে সেটা নিশ্চিত করা। দায়সারা ভাব ঝেড়ে ফেলতে হবে সবাইকে। ভঙ্গুর এই আর্থিক খাতকে পুনরুজ্জীবিত ও সুসংগঠিত করতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করছি।
লেখক : সরকারী ব্যাংক কর্মকর্তা
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।