স্পোর্টস ডেস্ক: মধ্যপ্রাচ্যের গরম ঠেকাতে গিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারল কাতার। বিশ্বকাপ আয়োজনে খেলোয়ার ও দর্শকদের জন্য গরম সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে দেশটি এমন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে যে, শুধু স্টেডিয়ামনগুলোই শীতল হয়নি, ভবিষ্যতে উষ্ণায়নের হাত খেলার স্টেডিয়ামগুলোকে শীতল রাখার পথ দেখাচ্ছে।
কাতার বিশ্বকাপের অন্যতম বড় একটি বাধা ছিল অতিরিক্ত গরম। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ হওয়ায় কাতারের তাপমাত্রা এমনিতেই বেশি, আর ইউরোপীয়দের কাছে তো এ তাপমাত্রা অসহ্য বলেই মনে হবে। কিন্তু সে সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে দেশটি। স্টেডিয়ামে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা বসিয়েছে তারা। আর তা-তেই দিব্যি খেলা হয়ে গেল প্রায় বড় কোনো অসুবিধা ছাড়াই। আমাদের এ পৃথিবীর উষ্ণতা ক্রমাগত বাড়ছে। তাহলে ভবিষ্যতের পৃথিবীতে খেলার স্টেডিয়ামগুলোকে কি পথ দেখাবে কাতারের এ উদ্ভাবন? বিস্তারিত জানিয়েছে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস।
সৌদ ঘানি পড়ান কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার উপাধিটাও চমৎকার: প্রফেসর অ্যান্ড চেয়ার অব এয়ার কন্ডিশনিং। থার্মাল ডায়নামিক্স বিশেষজ্ঞ এ উদ্ভাবক একদল সহযোগী বিশেষজ্ঞ নিয়ে কাতার বিশ্বকাপের আটটি স্টেডিয়ামে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার তত্ত্বাবধানে ছিলেন।
‘মানুষ ভাবে, আমাদের অনেক টাকা আছে আর তার জোরে আমরা ঠান্ডা বাতাস ঢালার ব্যবস্থা করেছি। কিন্তু টাকাইতো সব নয়। মানুষের সমালোচনা নিয়ে আমাদের কি-ই-বা করার আছে। তবে কেউ যদি এ উদ্ভাবন বুঝতে চায়, তাহলে তাদেরকে আমার এখানে শতভাগ স্বাগতম জানাই,’ ঘানি বলেন।
কাতারের বিশ্বকাপ স্টেডিয়ামে এয়ার-কন্ডিশনিং বসানোর এ যাত্রা পদে পদে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। তার মধ্যে ভিন্নধর্মী দুটি প্রশ্ন ছিল: ঘানি আর তার লোকেরা গবেষণাগারে বসে যা করলেন, তা কি উষ্ণ পৃথিবীর স্টেডিয়াম নকশার ভবিষ্যতকে বদলে দিতে যাচ্ছে এবং পরিবেশের তাপমাত্রা যতই থাকুক না কেন, এ ধরনের স্টেডিয়ামগুলোতে নিরবচ্ছিন্নভাবে কক্ষ তাপমাত্রা ধরে রাখা আদৌ কি সম্ভব?
প্রথম প্রশ্নের উত্তরে কাঁধ ঝাঁকালেন ঘানি। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তের হ্যাঁ বললেন তিনি।
৫২ বছর বয়সী ঘানির জন্ম সুদানে। ইংল্যান্ডের নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্য়ালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন তিনি। ২০০৯ সালে কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে আসেন তিন সন্তানের এ বাবা। ওই সময়ই বিশ্বকাপ আয়োজনের নিলামে অংশ নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছিল কাতার।
একদিন কাতারের শীর্ষ কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ডাক আসে ঘানির। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, তিনি কি এমন স্টেডিয়ামের নকশা করতে পারবেন যা দোহার তীব্র গরমেও মানুষকে শীতল রাখবে। বিশ্বকাপ আয়োজনের সুযোগ পাওয়া হয়তো এর ওপরই নির্ভর করবে।
নিশ্চয়ই, উত্তর দিয়েছিলেন ঘানি। দোহা এমন এক শহর, যেখানে সর্বত্রই শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে। এ শহরে সারাক্ষণ যেন এয়ার কন্ডিশনিং মেশিনের কলতান শোনা যায়।
কাতারের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এ আটটি স্টেডিয়ামের মধ্যে কেবল একটিকে খুলে ফেলা হবে বিশ্বকাপের পর। বাকি সাতটি অন্য খেলা, ইভেন্ট ইত্যাদি আয়োজনের জন্য ব্যবহার করা হবে। এদিকে কাতারে বছরের নয় মাসই তীব্র গরম থাকে। তাই স্রেফ বার্ষিক তিন মাস ব্যবহারের জন্য এত অর্থ খরচ করে এতগুলো স্টেডিয়াম তৈরি করার কোনো মানেই হয় না। সেজন্যই স্টেডিয়ামগুলোতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ করাটা আবশ্যকীয় হয়ে পড়েছিল।
১৩ বছর ধরে প্রকল্পটি নিয়ে কাজ করেছেন ঘানি ও তার দল। কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে বেশিরভাগ কাজ করেছেন তিনি। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ধাঁধা হিসেবে দেখেছেন তিনি এ প্রকল্পকে। নিজের কাজের জন্য এক সাংবাদিক তাকে উপাধি দিয়েছিলেন ‘ডক্টর কুল’। অবশ্য নিজেকে সেভাব দেখেন না ঘানি।
প্রকল্পটির সার্বিক ধারণাটি অবশ্য খুবই সাদাসিধা ছিল: উষ্ণ বাতাস ওপরে উঠে যায়, শীতল বাতাস নিচে নেমে আসে।
ঘানিকে স্টেডিয়মের প্রতিটি ইঞ্চি শীতল করার কথা ভাবতে হয়নি। বরং খেলোয়াড়দের খেলার মাঠের ভূমি থেকে ছয় ফুট উঁচুতে ও দর্শকদের বসার জায়গা ঠান্ডা রাখতে পারাটাই যথেষ্ট ছিল। তত্ত্বীয়ভাবে এ শীতল বাতাস সেখানেই অবস্থান করার কথা।
স্টেডিয়ামকে ঠান্ডা রাখার জন্য ঠান্ডা বাতাসের প্রয়োজন। ঘানি তার ব্যবস্থা করলেন স্টেডিয়ামের পাশে একটি ঠান্ডা পানির ট্যাংক রেখে। কয়েক হাজার গ্যালন পানির ওই ট্যাংক স্টেডিয়ামের বাইরে মানুষের দৃষ্টির বাইরে লুকানো। এর ভেতরে থাকা ঠান্ডা পানি ব্যবহার করেই স্টেডিয়ামের বাতাস শীতল করার ব্যবস্থা করা হলো।
খেলা শুরুর আগে রাতের বেলা এ ট্যাংকের পানি ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ঠান্ডা করা হয়। আর এ কাজের জন্য যে বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়, তা আসে দোহার বাইরে থাকা সৌরবিদ্যুৎ ফার্ম থেকে।
গাড়ির রেডিয়েটরের মতো প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্টেডিয়ামের ভেতরের গরম বাতাসকে বাইর এনে শীতল করে তা স্টেডিয়ামের ভেতরে পাঠানো হয়।
তবে স্টেডিয়ামের ভেতরে শীতল বায়ু প্রবাহের ক্ষেত্রেও নিগূঢ়তার আশ্রয় নিয়েছেন ঘানি। তিনি চাননি খোলা কোনো নলের মুখ দিয়ে সবার চোখের সামনে বাইরে থেকে ঠান্ডা বাতাসের প্রবাহ সশব্দে স্টেডিয়ামের ভেতরে প্রবেশ করুক।
এর জন্য ঘানি স্টেডিয়ামের আসন ও ব্লিচারগুলোর নিচে নির্গমনপথের ব্যবস্থা রাখলেন। কয়েক হাজার নির্গমনপথ দিয়ে স্টেডিয়ামের ভেতর শীতল বায়ু প্রবেশ করল বেশিরভাগ দর্শকের অলক্ষ্যে।
তবে সব জায়গায় সব সময় একই পরিমাণ শীতল বাতাস দেওয়া হলো না। ইনফ্রারেড ক্যামেরা ও সেন্সর ব্যবহার করে প্রয়োজন অনুসারে স্টেডিয়ামের বিভিন্ন অংশে নির্দিষ্ট পরিমাণ ঠান্ডা বাতাস সরবরাহ করার ব্যবস্থা রাখা হলো।
খলিফা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামের কুলিং ফ্যান। ছবি: পল চাইল্ডস/রয়টার্স
অবশ্য এত এত প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের পরও সবাই সন্তুষ্ট ছিলেন না। ব্রাজিল দলের এক খেলোয়াড় অভিযোগ করেছেন, এয়ার-কন্ডিশনিংয়ের কারণে তার দল অসুস্থবোধ করছে। অনেকে স্টেডিয়ামের আবহাওয়াকে খুব গরম বা খুব শীতল হওয়ার অভিযোগও করেছেন।
আহমদ বিন আলি স্টেডিয়ামে ওয়েলস ও ইরানের মধ্যকার এক বিকেলের খেলায় তাপমাত্রা ছিল ৯০ ডিগ্রি ফরেনহাইটের বেশি। সেদিনের ম্যাচ স্টেডিয়ামের এক প্রান্তের দর্শকেরা ঘামে ভিজতে ভিজতে রোদে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন।
কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের এক পাশে নতুন একটি বড় ভবন তৈরি করা হয়েছে। কাতারি কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে এটি ঘানি ও তার দলের জন্য উপহার বলে মন্তব্য করেন ঘানি। এখানেই ঘানির অফিস ও এয়ার-কন্ডিশনিং নিয়ে বিভিন্ন গবেষণাগার স্থাপন বা স্থানান্তর করা হবে।
ভবিষ্যৎ বিশ্বকাপ আসরগুলো নিয়েও ভাবেন সৌদ ঘানি। ২০২৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, ও কানাডা একত্রে বিশ্বকাপের আয়োজন করবে। ঘানি ভাবেন, মিয়ামি, কানসাস সিটি, ফিলাডেলফিয়া বা মেক্সিকোর তিনটি স্বাগতিক শহরে মধ্যগ্রীষ্মে বাইরে অবস্থিত এ স্টেডিয়ামগুলোতে খেলতে গিয়ে কতটা ‘নাতিশীতোষ্ণ’ অনুভব করবেন দর্শক ও খেলোয়াড়েরা।
ঘানি মনে করেন, পৃথিবী যেভাবে ক্রমান্বয়ে উষ্ণ হয়ে উঠছে, সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতে ফুটবল বা অলিম্পিকের মতো এ ধরনের বড় ক্রীড়া আসরগুলো আরামদায়ক ও নিরাপদভাবে যথাসময়ে ও যথাস্থানে অনুষ্ঠিত করতে চাইলে তাপমাত্রার ব্যাপারটি নিয়ে এখন থেকেই গুরুত্ব সহকারে চিন্তা করা উচিত।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।