সম্প্রতি অস্বাভাবিক উত্তপ্ত একটি বামন নক্ষত্র আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা। এই নক্ষত্রটির ভর সূর্যের মাত্র ৮%, কিন্তু এর তাপমাত্রা অনেক বেশি। বাদামি বামন নক্ষত্রদের বলা হয় ব্যর্থ নক্ষত্র। তাহলে এর তাপমাত্রা এত বেশি কেন? মূল ধারার নক্ষত্রগুলো প্রচণ্ড গরম। উত্তপ্ত। বুকের ভেতরে নিউক্লিয়ার চুলো জ্বললে গরম না হয়ে উপায় কী! সাধারণত গ্রহ বা বামন নক্ষত্রের তাপমাত্রা এত বেশি হয় না। সূর্যের তুলনায় সৌরজগতের গ্রহগুলোর তাপমাত্রা যেমন অনেক কম। এটাই নিয়ম। কিন্তু ব্যতিক্রম তো থাকেই। নইলে নিয়মটা আর নিয়ম হবে কী করে? তেমনই হয়েছে ডব্লিউডি০০৩২-৩১৭ বি (WD0032-317 B) নামের একটি বামন নক্ষত্রের ক্ষেত্রে।
নামটা হয়তো বেশ কাঠখোট্টা। তবে গুণে মূল ধারার নক্ষত্রদেরও ছাড়িয়ে গেছে। চিলির ইউরোপিয়ান সাউদার্ন অবজারভেটরির টেলিস্কোপের সংগৃহীত তথ্য থেকে পাওয়া গেছে এ নক্ষত্রের সন্ধান। ইসরায়েলের ওয়েজম্যান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের জ্যোতিঃপদার্থবিদ নামা হাল্লাকউন ও তাঁর দল এ বাদামি বামন নক্ষত্রটির অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন।
বাদামি বামন নক্ষত্ররা আসলে ব্যর্থ নক্ষত্র। অর্থাৎ এরা নক্ষত্র নয়, তবে গ্রহও নয়! কেন? কারণ, নক্ষত্রের বৈশিষ্ট্য হলো, এর কেন্দ্রে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া হয়। এ বিক্রিয়ায় হাইড্রোজেন-হাইড্রোজেন মিলে তৈরি করে হিলিয়াম। এ সময় উৎপন্ন হয় বিপুল শক্তি। এই শক্তিই নক্ষত্রের আলো হিসাবে দেখা যায়। এ শক্তিই উজ্জ্বল অগ্নিগোলকে পরিণত করে নক্ষত্রদের।
কিন্তু বাদামি বামনদের ভর গ্রহের তুলনায় অনেক বেশি হলেও নক্ষত্র হওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। তাই এ ধরনের নক্ষত্রের বুকে হাইড্রোজেনের ফিউশন শুরু হয়েও কিছুকাল পরে বন্ধ হয়ে যায়। ফলে নক্ষত্র হয়ে উঠতে গিয়েও ব্যর্থ হয় এগুলো। তবে এসব নক্ষত্রের ভেতরে ডিউটেরিয়ামের (2H) ফিউশন বিক্রিয়া ঘটতে পারে। এর ফলেও হিলিয়াম নিউক্লিয়াস তৈরি হয়। তবে এটি হিলিয়াম-৪ নয়, হিলিয়াম-৩। এতে দুটি প্রোটন ও একটি নিউট্রন থাকে। তবে এ বিক্রিয়ায় হাইড্রোজেনের ফিউশনের মতো অত শক্তি তৈরি হয় না।
গ্রহরাজ বৃহস্পতির চেয়ে আকারে প্রায় ১৩ থেকে ৮০ গুণ বড় হতে পারে বাদামি বামন। তবে এগুলোর ঘনত্ব অনেক বেশি। বৃহস্পতির আকারের একটি বাদামি বামন নক্ষত্রের ভর গ্রহটি থেকে প্রায় ৮০ গুণ বেশি হতে পারে। সাধারণত বাদামি বামনের তাপমাত্রা হয় ২ হাজার ২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। যেকোনো নক্ষত্রের তুলনায় এ তাপমাত্রা বেশ কম। নক্ষত্রের পৃষ্ঠের স্বাভাবিক তাপমাত্রা থাকে প্রায় ৩ হাজার ৭০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
কিন্তু অবাক করা বিষয় হলো, ডব্লিউডি০০৩২-৩১৭ বি নামের বাদামি বামন নক্ষত্রটির পৃষ্ঠের তাপমাত্রা প্রায় ৭ হাজার ৭০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস! এই তাপমাত্রা আমাদের সৌরপৃষ্ঠের চেয়ে অনেক বেশি। অথচ এই বামন নক্ষত্রটির ভর সূর্যের ভরের মাত্র ৮ শতাংশ। অর্থাৎ এই নক্ষত্রটির তাপমাত্রা অস্বাভাবিক বেশি। সেজন্যই বিষয়টি অবাক করেছে নক্ষত্র গবেষকদের।
সাধারণ একটি বাদামি বামন নক্ষত্রের তাপমাত্রা এত বেশি হওয়ার কথা নয়। গবেষকদের মতে, এর তাপমাত্রা এত বেশি হওয়ার কারণ, এটি এর যুগ্ম জমজ সঙ্গী নক্ষত্রকে (WD 0032-317 A) খুব কাছে থেকে আবর্তন করছে। এই সঙ্গী নক্ষত্রটি একটি শ্বেত বামন নক্ষত্র। এটাকে এটি এত কাছে থেকে আবর্তন করছে যে একবার প্রদক্ষিণ করতে এর সময় লাগে মাত্র ২ দশমিক ৩ ঘণ্টা। অর্থাৎ, পৃথিবীর মাত্র আড়াই ঘণ্টায় ওই গ্রহের এক বছর কেটে যায়।
এই বাদামি বামন নক্ষত্রটির সব অংশের তাপমাত্রা সমান নয়। একপাশের তাপমাত্রা বেশি, অন্য পাশের কম। বিষয়টা একটু বুঝিয়ে বলা দরকার। কোনো মহাজাগতিক বস্তু আরেকটি বস্তুকে খুব কাছ থেকে আবর্তন করলে দুটো বস্তু এমনভাবে আটকে যায় যে তাদের এক পাশ সবসময় পরস্পরের মুখোমুখি থাকে। অন্যপাশটা সবসময় রয়ে যায় দূরে। অনেকটা চাঁদ ও পৃথিবীর মতো। এ বিষয়টাকে বলে টাইডাল লকিং।
এই টাইডাল লকিংয়ের জন্য আমরা সব সময় চাঁদের একপাশ দেখতে পাই। কিন্তু দক্ষিণ মেরু আমরা কখনোই দেখতে পাই না। কারণ, এটা পৃথিবীর উল্টোদিকে। আর পৃথিবী যেমন নিজ অক্ষের ওপর ঘোরে, তেমনি চাঁদও ঘোরে। এক্ষেত্রে বামন নক্ষত্রটি একটি শ্বেত বামনের সঙ্গে টাইডালি লকড। তাই এর একপাশেই শুধু শ্বেত বামনটির আলো পড়ে, অন্য পাশে শ্বেত বামনের আলো পড়ে না। তাহলে যে পাশে আলো পড়ে, সে পাশে নিশ্চয়ই তাপমাত্রা বেশি হবে। হয়ও তাই।
বাদামি বামন নক্ষত্রটির যে পাশ শ্বেত বামনটির দিকে, সে পাশের তাপমাত্রা ৭ থেকে ৯ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু যে পাশ ওই নক্ষত্রের বিপরীত দিকে, সে পাশের তাপমাত্রা অনেক কম। ১ হাজার থেকে ২ হাজার ৭০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো। অর্থাৎ দুই পাশের তাপমাত্রার পার্থক্য দাঁড়ায় প্রায় ৬ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস।
এ বাদামি বামনটি পৃথিবী থেকে ১ হাজার ৪০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এখন পর্যন্ত যতগুলো বাদামি বামনের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা, তার মধ্যে এটির তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি। অদ্ভুত এ আবিষ্কার নক্ষত্রবিজ্ঞানীদের জন্য বেশ কাজে লাগবে। এ ধরনের দানবীয় ব্যর্থ নক্ষত্রগুলো কীভাবে নিজেদের ওপরেই চুপসে যায়, সেই গবেষণা করতে সুবিধা হবে এর মাধ্যমে। ভবিষ্যতে হয়তো এমন আরও অনেক ব্যর্থ নক্ষত্রের সন্ধান পাবেন বিজ্ঞানীরা। তখন এ সব বাদামি বামন নক্ষত্র সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানা যাবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।