সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের রাইস বিশ্ববিদ্যালয় ও জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউটের একদল তাত্ত্বিক পদার্থবিদ নতুন একধরনের কণার কথা বলছেন, যার বৈশিষ্ট্য আমাদের চেনা-জানা বোসন বা ফার্মিয়ন কণার সঙ্গে মেলে না। কণাদের নতুন এ ধরনটির নাম দেওয়া হয়েছে প্যারাপার্টিকেল। ৮ জানুয়ারি নেচার জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে এ কণার বিস্তারিত বর্ণনা উঠে এসেছে।
প্যারাপার্টিকেল নির্ণয়ের গাণিতিক মডেলটির সাহায্যে কোয়ান্টাম কম্পিউটারে আরও অনেক পরীক্ষানিরীক্ষা করা সম্ভব। গবেষণাটি বলছে, প্রকৃতিতে প্যারাপার্টিকেলের অস্ত্বিত থাকতে পারে, যা আমরা এখনও শনাক্ত করতে পারিনি। নতুন ধরনের মৌলিক কণা নিয়ে গবেষণা অবশ্য এটাই প্রথম নয়। এর আগে গত বছর শেষের আদিকে সায়েন্স জার্নালে প্রকাশিত হয় অ্যানিয়ন কণাবিষয়ক গবেষণাপত্র। কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে ভার্চ্যুয়াল একমাত্রিক জগতে সে কণার সন্ধান পান বিজ্ঞানীরা। এ গবেষণারও আগে দ্বিমাত্রিক সিস্টেমে অ্যানিয়ন কণা শনাক্ত করা হয়েছিল। প্যারাপার্টিকেলের মতো অ্যানিয়নের বৈশিষ্ট্যও বোসন বা ফার্মিয়ন কণার মতো নয়।
যা-ই হোক, অ্যানিয়ন এবং প্যারাপার্টিকেলের মতো অস্বাভাবিক আচরণের কণাগুলো ভবিষ্যতে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ভুল করার প্রবণতা আরও কমাবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। প্রায় ১০০ বছর আগে পদার্থবিজ্ঞানীরা যখন পরমাণুর গঠন বুঝতে শুরু করলেন, তখন অস্ট্রিয়ান পদার্থবিদ উলফগ্যাং পাউলি হাজির হন তাঁর বিখ্যাত বর্জন নীতি নিয়ে। এ নীতিতে বলা হয়, দুটি ইলেকট্রন কখনো একই দশায় থাকতে পারবে না। দুটি ইলেকট্রনকে একই দশায় রাখার চেষ্টা করা হলে সেখানে একটি প্রতিক্রিয়া বলের সৃষ্টি হবে। এর ফলে ইলেকট্রনগুলো সর্বনিম্ন শক্তিস্তরে যাওয়ার পরিবর্তে পরমাণুতে নিউক্লিয়াসের চারপাশে সুসজ্জিতভাবে থাকে।
পাউলি ও অন্য বিজ্ঞানীরা খুব দ্রুতই বুঝতে পারেন, এ নীতি কেবল ইলেকট্রনের বেলায় নয়, প্রোটন-নিউট্রনসহ বেশির ভাগ ভরযুক্ত বস্তুর কণার ক্ষেত্রেও খাটে। এসব কণাকে বর্তমানে আমরা ‘ফার্মিয়ন’ নামে চিনি। অন্যদিকে যেসব কণা নিজেদের মধ্যে একসঙ্গে একই দশায় থাকতে পারে, তাদেরকে ‘বোসন’ কণা বলা হয়। আরও সহজ করে বললে, মূলত বলবাহী কণাগুলোই বোসন। ফোটন এ ধরনের একটি কণা। লেজার রশ্মিতে অসংখ্য ফোটন কণা একই দশায় থাকতে পারে খুব সহজেই। পাউলি ও তার দল সে সময়ে আরও আবিষ্কার করেন, কণার ফার্মিয়ন বা বোসন হওয়ার বিষয়টি এর কৌণিক ভরবেগ বা স্পিনের সঙ্গে জড়িত।
গাণিতিকভাবে ফার্মিয়নের মৌলিক বৈশিষ্ট্য হলো, যখন দুটি কণা নিজের মধ্যে অবস্থান পরিবর্তন করে, তখন তাদের তরঙ্গ ফাংশনের চিহ্ন উল্টে যায়। অর্থাৎ (-১) দিয়ে গুণ করতে হয়। কিন্তু বোসনের ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতিতে তরঙ্গ ফাংশন অপরিবর্তিত থাকে। তবে প্রথম দিককার তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানীরা জানতেন, নীতিগতভাবে আরও বিভিন্ন ধরনের কণা থাকা উচিত, যেগুলোর অবস্থান পরিবর্তনের কারণে তরঙ্গ ফাংশন বেশ জটিলভাবে পরিবর্তিত হবে। ১৯৭০-এর দশকে অ্যানিয়ন আবিষ্কার করেন বিজ্ঞানীর। কেবল এক বা দ্বিমাত্রিক মহাবিশ্বেই এই অ্যানিয়নের অস্তিত্ব সম্ভব।
জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনস্টিটিউট ফর কোয়ান্টাম অপটিক্সের পদার্থবিদ ঝিউয়ান ওয়াং এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাইস বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাডেন হ্যাজার্ড তাঁদের বর্তমান গবেষণায় এমন একটি মডেল তৈরি করেছেন, যেটা যেকোনো মাত্রায় থাকা প্যারাপার্টিকেল (বোসন বা ফার্মিয়নের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মেলে না, এমন কণা) শনাক্ত করতে পারে। এ কণাগুলো সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের পাউলীর বর্জন নীতি মেনে চলে। যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব ইয়র্কের গাণিতিক পদার্থবিদ কাসিয়া রিজনার এ গবেষণা প্রসঙ্গে বলেন, এটি অসম্ভব কোনো কিছু নয়, তবে বিষয়টা খুবই চমৎকার।
পদার্থবিদ ওয়াংয়ের মতে, প্যারাপার্টিকেলের মডেল তৈরি তাঁর জীবনের একটি স্মরণীয় ঘটনা। কঠিন হলেও কোয়ান্টাম কম্পিউটারের সাহায্যে এসব কণার দশা শনাক্ত করা হয়তো সম্ভব। তেমনটা হলে পদার্থবিজ্ঞানে যেমন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে, তেমনি নতুনভাবে জানা যাবে প্রকৃতিকে। সরাসরি কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ভুলের পরিমাণ যে উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনা যাবে, তা তো আগেই বলেছি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।