কবরের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা এক তরুণীর গল্প দিয়ে শুরু করি। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে ফেলছিল তার কান্না—জীবনের প্রতি সমস্ত হতাশা, অপূর্ণতা আর বোঝা মনে হচ্ছিল অসহ্য। হাতে ছিল একটি ফোন, যেখানে ডায়াল করা হয়েছিল ন্যাশনাল হেল্পলাইন নম্বর। সেই এক ফোন কলই ছিল এক জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার সূচনা। আজ সে বেঁচে আছে, সংগ্রামী, এবং জানায়: “মৃত্যু নয়, সাহায্য চাওয়াই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে সাহসী সিদ্ধান্ত।” আত্মঘাতী চিন্তা শুধু ব্যক্তিগত যন্ত্রণা নয়; এটি সমাজের প্রতিটি স্তরে এক নীরব মহামারী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) ২০২৩ সালের প্রতিবেদন বলছে, প্রতি বছর ৭ লক্ষেরও বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেন—প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন! বাংলাদেশে পরিস্থিতি আরও উদ্বেগজনক: ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব মেন্টাল হেলথের জরিপে (২০২২) উঠে এসেছে, দেশের ১৬-৪০ বছর বয়সী প্রতি ১০০ জনে ৮ জন গুরুতর আত্মঘাতী চিন্তার শিকার। কিন্তু আশার কথা—আত্মঘাতী চিন্তা বন্ধের জরুরি উপায় জানা থাকলে, এই যাত্রা থামানো সম্ভব। এই লেখাটি আপনার বা আপনার প্রিয়জনের জীবন বদলে দিতে পারে।
আত্মঘাতী চিন্তা থেকে মুক্তির ৫টি কার্যকরী উপায়
আত্মঘাতী চিন্তা দেখা দিলে তাৎক্ষণিক কী করবেন? এই প্রশ্নটিই হাজারো মানুষের গুগল সার্চের বিষয়। বিশেষজ্ঞরা একমত—আত্মঘাতী চিন্তা বন্ধের জরুরি উপায় প্রায়োগিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত কৌশলের সমন্বয়। চলুন, জেনে নিই জীবন রক্ষাকারী সেই পদ্ধতিগুলো:
তাত্ক্ষণিক সাহায্য চাওয়া: জীবনরক্ষাকারী প্রথম ধাপ
ঢাকা মেডিকেল কলেজের মনোরোগ বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. তাজুল ইসলামের মতে, “আত্মঘাতী চিন্তা আসলে মস্তিষ্কের এক জরুরি সংকেত—এটি কখনোই দুর্বলতার লক্ষণ নয়। সাহায্য চাওয়াই প্রথম ও সবচেয়ে জরুরি পদক্ষেপ।”- হেল্পলাইনগুলো আপনার অপেক্ষায়: বাংলাদেশে ৯৯৯ এ কল করে জরুরি মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা পাবেন। এছাড়াও কাজ করে
কেয়ার বাংলাদেশ
(০৮০০০০৮৮৮৮৮) এবংজাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট হেল্পলাইন
(০১৭৮০৪৪৫৫০০)। রাত ২টোয়ও কেউ ফোন ধরবে। - কাছের মানুষকে খুলে বলা: “আমার খুব খারাপ লাগছে, তোমার সাহায্য দরকার”—একটি বাক্যই পরিস্থিতি বদলে দিতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা বলছে, সামাজিক সমর্থন আত্মঘাতী চিন্তার ঝুঁকি ৫০% পর্যন্ত কমায়।
- জরুরি ক্লিনিকে যাওয়া: ঢাকার পিজি হাসপাতাল, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট বা বেসরকারি হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যান। সেখানে প্রশিক্ষিত কর্মীরা তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপ করেন।
- হেল্পলাইনগুলো আপনার অপেক্ষায়: বাংলাদেশে ৯৯৯ এ কল করে জরুরি মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা পাবেন। এছাড়াও কাজ করে
সুরক্ষা পরিকল্পনা (Safety Plan) তৈরি: নিজের জন্য একটি লাইফলাইন
মনোবিদ ড. ফারহানা মান্নান (সহযোগী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) ব্যাখ্যা করেন, “আত্মঘাতী চিন্তা আসলে ঢেউয়ের মতো—একবার উঠে আবার নামে। সুরক্ষা পরিকল্পনা সেই ঢেউ সামলানোর জন্য আপনার ব্যক্তিগত ‘লাইফ জ্যাকেট’।” কীভাবে তৈরি করবেন?- চিহ্নিত করুন ট্রিগারগুলো: কোন পরিস্থিতি (যেমন: সম্পর্কে ভাঙন, চাকরি হারানো, তীব্র রাগ) আত্মঘাতী চিন্তা বাড়ায়? লিখে রাখুন।
- স্ব-শান্ত করার কৌশল: গান শোনা, গভীর শ্বাস নেওয়া, ঠান্ডা পানিতে মুখ ধোয়া—কী আপনাকে সাময়িক শান্ত করে?
- বিভ্রান্তির তালিকা: প্রিয় সিনেমা, পোষা প্রাণীর ছবি, সন্তানের হাতের লেখা চিঠি—যেসব জিনিস আপনাকে জীবনের দিকে টানে।
- যোগাযোগের ধাপ: প্রথমে কাকে ফোন করবেন? সাহায্য না পেলে পরের ব্যক্তি কে? সর্বশেষ হাসপাতালে যাওয়ার পরিকল্পনা রাখুন।
- পরিবেশ নিরাপদ রাখুন: ওষুধ, ধারালো জিনিস, কীটনাশক ইত্যাদি হাতের নাগালের বাইরে রাখুন।
পেশাদার চিকিৎসা ও থেরাপি: মস্তিষ্কের রসায়নে ইতিবাচক পরিবর্তন
আত্মঘাতী চিন্তা প্রায়শই অবহেলিত মানসিক রোগের (ডিপ্রেশন, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, PTSD) লক্ষণ। পাবনা মেন্টাল হসপিটালের মনোচিকিৎসক ডা. সুমাইয়া রহমান জোর দেন, “ওষুধ ও থেরাপির সমন্বয় আত্মঘাতী চিন্তা বন্ধের জরুরি উপায় গুলোর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর।”- ওষুধ (যদি প্রয়োজন): অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস মস্তিষ্কে সেরোটোনিন, নোরেপাইনফ্রাইন-এর ভারসাম্য ফেরায়, যা আত্মঘাতী চিন্তা কমাতে ভূমিকা রাখে। চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে নিন।
- কগনিটিভ বিহেভিয়ারাল থেরাপি (CBT): এই থেরাপি নেতিবাচক চিন্তার প্যাটার্ন চিহ্নিত করে তা বাস্তবসম্মত চিন্তায় রূপান্তর করতে সাহায্য করে। গবেষণায় দেখা গেছে, CBT আত্মঘাতী চিন্তার পুনরাবৃত্তি ৬০% কমাতে পারে।
- ডায়ালেক্টিক্যাল বিহেভিয়ার থেরাপি (DBT): আবেগ নিয়ন্ত্রণ, সংকট মোকাবেলা এবং আত্ম-সামলানোর কৌশল শেখায়। এটি বিশেষভাবে কার্যকর যাদের আবেগের তীব্রতা বেশি।
দৈনন্দিন রুটিন ও স্ব-যত্ন: ছোট ছোট বিজয়ের শক্তি
মানসিক সংকটে পড়লে ঘুম, খাওয়া, কাজের রুটিন ভেঙে পড়ে—এটি আত্মঘাতী চিন্তাকে আরও শক্তিশালী করে। পুনর্গঠনে প্রয়োজন ছোট লক্ষ্য:- ঘুমের নিয়ম: প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যান ও উঠুন। WHO সুপারিশ করে ৭-৯ ঘণ্টা ঘুম।
- পুষ্টিকর খাবার: ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড (মাছ), ফলিক অ্যাসিড (শাকসবজি), ভিটামিন ডি (সূর্যালোক) মস্তিষ্কের সুস্থতায় ভূমিকা রাখে। ঢাকার পুষ্টিবিদ ড. সৈয়দা সালমা সুলতানা পরামর্শ দেন, “প্রতিদিন একবাটি রঙিন সবজি আর একমুঠো ফল আত্মঘাতী চিন্তা কমাতে সহায়ক।”
- শারীরিক সক্রিয়তা: দিনে ৩০ মিনিট হাঁটা, যোগব্যায়াম বা সাইকেল চালানো এন্ডোরফিন হরমোন নিঃসরণ বাড়ায়, যা প্রাকৃতিক মুড বুস্টার।
- প্রিয় কাজে সময়: গান শোনা, বই পড়া, বাগান করা—যে কাজে আনন্দ পাবেন, তাতে প্রতিদিন ১৫ মিনিট ব্যয় করুন।
- দীর্ঘমেয়াদি সংযোগ ও উদ্দেশ্য গড়ে তোলা: জীবনের নতুন অধ্যায়
একাকীত্ব ও অর্থহীনতার অনুভূতি আত্মঘাতী চিন্তার প্রধান ইন্ধন। সমাধান গড়ে উঠতে পারে সংযোগ ও উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়ে:- সামাজিক নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করুন: পরিবার, বন্ধুদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন। গ্রুপ থেরাপি বা সাপোর্ট গ্রুপে (যেমন:
মাইন্ড কেয়ার সোসাইটি, ঢাকা
) যোগ দিন। - স্বেচ্ছাসেবী কাজ: এতিমখানা, বৃদ্ধাশ্রম বা পরিবেশ সংরক্ষণে কাজ করা আত্মমর্যাদা বাড়ায়। গবেষণা বলে, স্বেচ্ছাসেবায় জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে আত্মঘাতী চিন্তার হার উল্লেখযোগ্যভাবে কম।
- ছোট লক্ষ্যে বড় সাফল্য: জীবনের বৃহৎ উদ্দেশ্য নয়, প্রতিদিনের ছোট লক্ষ্য (যেমন: একটা নতুন রেসিপি রান্না করা, কাউকে সাহায্য করা) অর্জনের আনন্দ অনুভব করুন।
- আধ্যাত্মিকতা বা ধ্যান: প্রার্থনা, মেডিটেশন বা প্রকৃতির সাথে সময় কাটানো আত্মিক শান্তি দিতে পারে, যা আত্মঘাতী চিন্তা থেকে দূরে রাখে।
- সামাজিক নেটওয়ার্ক শক্তিশালী করুন: পরিবার, বন্ধুদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন। গ্রুপ থেরাপি বা সাপোর্ট গ্রুপে (যেমন:
কখন বুঝবেন আপনার বা আপনার কাছের কারো আত্মঘাতী চিন্তা হচ্ছে? সতর্কতা লক্ষণগুলো চিনুন
আত্মঘাতী চিন্তা প্রায়ই নীরবেই আসে। সচেতন দৃষ্টি অনেক জীবন বাঁচাতে পারে। মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মেহের আফরোজ চৌধুরী (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়) সতর্ক করেন, “কেউ যদি সরাসরি আত্মহত্যার কথা না-ও বলে, তবে কিছু আচরণ ‘নীরব চিৎকার’ হিসেবে দেখা দেয়।” সতর্ক হবেন যদি কেউ:
- প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ উক্তি: “আর পারছি না,” “তোমাদের কষ্ট দিয়ে যেতে চাই না,” “যদি আমি না থাকতাম,” “মরার উপায় খুঁজছি।”
- আচরণগত পরিবর্তন: হঠাৎ প্রিয় জিনিস দান করা, উইল লেখা, শেষবারের মতো দেখা করতে আসা, আগের আত্মহত্যার চেষ্টার ইতিহাস।
- মানসিক অবস্থা: তীব্র হতাশা, উদ্বেগ, রাগ, অপমানবোধ; দীর্ঘদিনের দুঃখের পর হঠাৎ শান্ত হওয়া (যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ইঙ্গিত)।
- সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: বন্ধু, পরিবার থেকে দূরে সরে যাওয়া, কাজ বা পড়াশোনায় আগ্রহ হারানো।
- আত্ম-ক্ষতির প্রবণতা: নিজেকে কাটা, পোড়ানো বা অন্যান্যভাবে শারীরিক ক্ষতি করা।
জরুরি পদক্ষেপ: এই লক্ষণ দেখলে সরাসরি জিজ্ঞাসা করুন, “আপনি কি আত্মহত্যা সম্পর্কে ভাবছেন?” প্রশ্নে উৎসাহিত করে না, বরং সাহায্যের দরজা খোলে। তাদের একা রেখো না। সাহায্য চাওয়াতে উৎসাহিত করো এবং পেশাদার সহায়তার ব্যবস্থা করো। বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা কীভাবে পাবেন? (Internal Link)
আত্মঘাতী চিন্তা প্রতিরোধে বাংলাদেশে সহায়তা ও সেবা: কোথায় পাবেন হাতের মুঠোয় সাহায্য?
আত্মঘাতী চিন্তা বন্ধের জরুরি উপায় জানার পাশাপাশি সহায়তা নেটওয়ার্ক চিনতে পারা জরুরি। আশার কথা, বাংলাদেশে সহায়তার পরিকাঠামো ধীরে ধীরে গড়ে উঠছে:
- সরকারি সেবা:
- জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা: বহির্বিভাগ, জরুরি সেবা ও ভর্তির সুবিধা। হেল্পলাইন: ০১৭৮০৪৪৫৫০০।
- জেলা সদর হাসপাতালগুলো: ৬৪ জেলার প্রায় সব হাসপাতালে এখন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা কাউন্সেলরের ব্যবস্থা রয়েছে।
- কমিউনিটি ক্লিনিক: গ্রামীণ পর্যায়ে প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্য পরামর্শ দেয়।
- ৯৯৯: জরুরি পরিস্থিতিতে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও অ্যাম্বুলেন্সের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য সংকটে সাহায্য করে।
- বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিও:
- কেয়ার বাংলাদেশ: টোল-ফ্রি হেল্পলাইন (০৮০০০০৮৮৮৮৮), কাউন্সেলিং, সচেতনতামূলক কার্যক্রম।
- মানসিক স্বাস্থ্য সোসাইটি, বাংলাদেশ: প্রশিক্ষণ, ওয়ার্কশপ, রেফারেল সার্ভিস প্রদান করে।
- প্রতিষ্ঠান (PRATYAY): তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে, হেল্পলাইন ও অনলাইন কাউন্সেলিং সুবিধা আছে।
- আঁধার (AANCHAL): বিশেষ করে নারী ও শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দেয়।
- অনলাইন রিসোর্স:
- মনের খবর (www.monerkhabor.com): মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ক তথ্য, বিশেষজ্ঞের আর্টিকেল এবং থেরাপিস্ট খোঁজার ডাটাবেজ।
- জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ওয়েবসাইট: সেবা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য।
- টেলিকনসাল্টেশন: ডক্টোলা, প্র্যাকটো, চিলডক-এর মতো প্ল্যাটফর্মে অনলাইনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ পাওয়া যায়।
আত্মঘাতী চিন্তা নিয়ে ভুল ধারণা ও সত্য: কুসংস্কার ভাঙুন, জীবন বাঁচান
আত্মঘাতী চিন্তা নিয়ে সমাজে প্রচুর ভুল ধারণা রয়েছে, যা সাহায্য চাওয়াকে বাধা দেয়। আসুন, সত্য মিথ্যা চিনে নিই:
- ভুল ধারণা: “যারা আত্মহত্যার কথা বলে, তারা আসলে করে না।”
সত্য: অধিকাংশ আত্মহত্যাকারীই পূর্বে কোন না কোন ভাবে তাদের কষ্ট বা ইচ্ছার কথা জানিয়েছিল। প্রতিটি উল্লেখ গুরুত্ব সহকারে নিন। - ভুল ধারণা: “আত্মঘাতী চিন্তা আছে এমন ব্যক্তি কখনোই সুস্থ হবে না।”
সত্য: সঠিক চিকিৎসা, থেরাপি ও সমর্থনে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া সম্ভব। অনেকেই এই সংকট কাটিয়ে সুখী ও উৎপাদনশীল জীবনযাপন করছেন। - ভুল ধারণা: “সুইসাইডাল থটস মানে দুর্বলতা বা মন খারাপ।”
সত্য: এটি একটি জটিল মানসিক স্বাস্থ্য অবস্থা, যার জৈবিক (মস্তিষ্কের রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতা), মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক কারণ রয়েছে। দুর্বলতার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। - ভুল ধারণা: “কাউকে জিজ্ঞাসা করলে তাকে উৎসাহিত করা হবে।”
সত্য: সরাসরি কিন্তু সহানুভূতিশীলভাবে জিজ্ঞাসা করা ব্যক্তিকে স্বস্তি দেয় এবং সাহায্যের পথ দেখায়। এটি প্রথম আত্মঘাতী চিন্তা বন্ধের জরুরি উপায় গুলোর একটি। - ভুল ধারণা: “শুধু মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা।”
সত্য: এটি একটি জীবন-মরণ বিষয়ের প্রতি আহ্বান। এমন কোন ‘চেষ্টা’ কখনোই অবহেলা করার বিষয় নয়।
আত্মঘাতী চিন্তা কোনও ভাগ্য বা দুর্বলতার ফল নয়—এটি একটি প্রতিরোধযোগ্য মানসিক স্বাস্থ্য সংকট। আপনার বা আপনার পরিচিত কেউ যদি এই অন্ধকার যুদ্ধে লড়াই করে, মনে রাখুন: সাহায্য আছে, আশা আছে, বাঁচার পথ আছে। আত্মঘাতী চিন্তা বন্ধের জরুরি উপায় জানা এবং প্রয়োগ করা শুধু একটি জীবনই নয়, একটি পরিবার, একটি সমাজকে বদলে দিতে পারে। আজই সেই সাহায্যের হাতটি বাড়িয়ে দিন—হেল্পলাইন নম্বরে কল করুন, কাছের মানুষকে বলুন, পেশাদারের শরণাপন্ন হোন। প্রতিটি জীবন অমূল্য। প্রতিটি মুহূর্ত নতুন শুরু করার সুযোগ। আপনি একা নন—সাহায্য কাছেই আছে।
জেনে রাখুন: আত্মঘাতী চিন্তা বিষয়ে প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন
আত্মঘাতী চিন্তা আসলে কি?
আত্মঘাতী চিন্তা বা সুইসাইডাল থটস হল মৃত্যু কামনা করা, নিজের জীবন নেওয়ার কথা ভাবা, বা সেই বিষয়ে পরিকল্পনা করা। এটি সাধারণ মন খারাপ বা দুঃখবোধ থেকে ভিন্ন—এটি তীব্র মানসিক যন্ত্রণা থেকে উদ্ভূত একটি জটিল অবস্থা, যেখানে ব্যক্তি মৃত্যুকেই একমাত্র মুক্তি বলে মনে করে। এটি প্রায়ই গুরুতর অবসাদ, উদ্বেগ বা অন্যান্য মানসিক রোগের লক্ষণ হিসেবে দেখা দেয়।আত্মঘাতী চিন্তা কাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়?
যে কোন বয়স, লিঙ্গ বা পেশার মানুষই আত্মঘাতী চিন্তার শিকার হতে পারেন। তবে কিছু ঝুঁকিগুচ্ছ রয়েছে: তীব্র অবসাদ বা বাইপোলার ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যক্তি, আগে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন যারা, মাদকাসক্তি আছে যাদের, দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক যন্ত্রণা বা রোগে ভোগা ব্যক্তি, মারাত্মক আঘাত (যেমন: প্রিয়জনের মৃত্যু, সম্পর্ক ভাঙন, চাকরি হারানো) পাওয়া মানুষ, এবং যারা একাকীত্ব বা সামাজিক বিচ্ছিন্নতায় ভোগেন তাদের মধ্যে এই ঝুঁকি বেশি।আত্মঘাতী চিন্তা থেকে মুক্তির উপায় কি শুধু ওষুধ?
না, শুধু ওষুধ নয়। আত্মঘাতী চিন্তা বন্ধের জরুরি উপায় হল একটি সমন্বিত পদ্ধতি: পেশাদার মনোচিকিৎসা বা থেরাপি (যেমন: CBT, DBT), প্রয়োজনে ওষুধ, সামাজিক সমর্থন (পরিবার-বন্ধুর সাহায্য), দৈনন্দিন স্ব-যত্ন (ঘুম, খাদ্য, ব্যায়াম), সুরক্ষা পরিকল্পনা তৈরি এবং দীর্ঘমেয়াদে জীবনযাপনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা। প্রত্যেকের জন্য উপযুক্ত সমাধান আলাদা হতে পারে।কেউ আত্মহত্যার কথা বললে কি সাথে সাথে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে?
সবসময় নয়, তবে সতর্কতা জরুরি। প্রথমে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করুন (ধারালো জিনিস সরান)। ব্যক্তির কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন, বিচার বা তিরস্কার করবেন না। জিজ্ঞাসা করুন তারা কি পরিকল্পনা করেছে। যদি তাৎক্ষণিক ঝুঁকি থাকে (যেমন: ওষুধ জমা আছে), তাহলে জরুরি হেল্পলাইন (৯৯৯ বা ০৮০০০০৮৮৮৮৮) কল করুন বা নিকটবর্তী হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান। ঝুঁকি কম মনে হলে দ্রুত মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে যোগাযোগ করান।আত্মঘাতী চিন্তা প্রতিরোধে সরকারের কোন উদ্যোগ আছে কি?
হ্যাঁ, বাংলাদেশ সরকার মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দিচ্ছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট প্রধান কেন্দ্র। জেলা হাসপাতালগুলোতে মনোরোগ বিভাগ সম্প্রসারিত হচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্য সেবাকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চলছে। ২০১৮ সালে প্রণীত “মানসিক স্বাস্থ্য আইন” আত্মহত্যা প্রচেষ্টাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে, যা সাহায্য চাওয়াকে উৎসাহিত করে। তবে আরও ব্যাপক বাজেট ও জনবল নিয়োগ প্রয়োজন।- আমার মনে মাঝে মাঝে মৃত্যুর কথা আসে, কিন্তু আমি কখনো কিছু করব না। এটা কি বিপজ্জনক?
মাঝে মাঝে অস্থায়ীভাবে “জীবন থেকে পালাতে ইচ্ছে করা” বা “যদি না থাকতাম” ধরনের ভাবনা অনেকেরই আসতে পারে, বিশেষ করে চাপের মুহূর্তে। তবে, যদি এই চিন্তাগুলো ঘন ঘন আসে, দীর্ঘস্থায়ী হয়, বা আপনার দৈনন্দিন জীবনকে ব্যাহত করে, তবে তা অবশ্যই গুরুত্ব দেবার বিষয়। এমনকি যদি আপনি কাজে রূপান্তরিত করার ইচ্ছা না-ও রাখেন, তবুও এই নেতিবাচক চিন্তার প্রবাহ আপনাকে দুর্বল করে দিতে পারে। একজন কাউন্সেলর বা থেরাপিস্টের সাথে কথা বলা ভালো, যাতে এই চিন্তাগুলো শক্তিশালী না হয়। কিভাবে ডিপ্রেশন মোকাবেলা করবেন? (Internal Link)
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।