রিমা চৌধুরীর চোখে অশ্রু জমে উঠেছিল স্কুলের বার্ষিক মঞ্চনাটকের দিন। তার আট বছরের মেয়ে নাবা, যে কিনা ঘরেও কথা বলতে সংকোচ বোধ করত, মঞ্চে দাঁড়িয়ে দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলেছিল, “আমি পারবো, কারণ মা বলে—ভুল করলেও শেখার সুযোগ আসে।” ঢাকার ধানমন্ডি লিটল স্টার স্কুলের সেই মুহূর্ত শুধু নাবার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়নি, রিমার হৃদয়েও প্রশ্ন জাগিয়েছিল: আত্মবিশ্বাসী সন্তান গড়ে তোলার কার্যকরী কৌশল আসলে কী? বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুধু প্যারেন্টিং নয়, এক প্রজন্মকে ভবিষ্যৎ-প্রস্তুত করার দায়িত্ব। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা বলছে, দক্ষিণ এশিয়ার ৬০% শিশু আত্মসন্দেহে ভোগে—এই চক্র ভাঙতে হলে শুরু করতে হবে পরিবার থেকেই।
আত্মবিশ্বাসী সন্তান গড়ে তোলার কৌশল: শিকড়ে যেখানে যত্ন দিতে হবে
মনোবিজ্ঞানী ড. তানভীর হায়দারের মতে, “আত্মবিশ্বাসের বীজ রোপিত হয় শূন্য থেকে পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে।” বাংলাদেশে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশুকে দৈনিক অন্তত ৩০ মিনিট অবাধ খেলার সুযোগ দেওয়া হয়, তাদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ৪০% বেশি। চট্টগ্রামের হালিশহরে বসবাসকারী সুমাইয়া ও রাশেদুলের সন্তান আরিয়ান (৪) প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাবা-মায়ের সঙ্গে মাটির পাত্রে চারা রোপণ করে। এই সহজ কাজটিই তাকে শেখায়: দায়িত্ব পালনই আত্মমর্যাদার প্রথম সিঁড়ি।
গুরুত্বপূর্ণ কৌশল:
- ভুলকে ‘শেখার উৎস’ হিসেবে উপস্থাপন: “তুমি ভুল করেছ” না বলে বলুন, “এবার কী শিখলে?”
- ক্ষুদ্র সাফল্যের স্বীকৃতি: পড়া মুখস্থ করা নয়, সময়মতো ঘুম থেকে ওঠার জন্যও প্রশংসা করুন।
- দৈনিক রুটিনে ‘নির্বাচনের অধিকার’ দিন: “আজ নীল জামা পরবি নাকি সবুজ?”—এমন প্রশ্ন আত্মনিয়ন্ত্রণ শেখায়।
বাংলাদেশ প্রাইমারি এডুকেশন অ্যাডভান্সমেন্ট প্রোগ্রামের (BPEAP) রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, গ্রামীণ এলাকায় ৭০% অভিভাবক এখনও “বাচ্চাকে শাসন করবো না তো বখে যাবে” এই ধারণায় আটকে আছেন। কিন্তু সিলেটের জৈন্তাপুরে একটি কমিউনিটি প্রোজেক্ট দেখিয়েছে, যেসব পরিবারে শিশুদের মতামত নেওয়া হয়, তাদের স্কুলে উপস্থিতি ২৭% বেড়েছে। এখানেই লুকিয়ে আছে আত্মবিশ্বাস গড়ার মূলমন্ত্র: সম্মান ও শোনার সংস্কৃতি।
শৈশব থেকে কৈশোর: আত্মবিশ্বাসের ভিত মজবুত করার ধাপগুলো
কথা বলার শৈলী: শব্দই তৈরি করবে অদম্য মানসিকতা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইল্ড সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. ফারহানা রহমানের পর্যবেক্ষণ: “বাংলাদেশি অভিভাবকরা অজান্তেই ‘তুই পারবি না’ বা ‘ওটা তোর দ্বারা হবে না’ জাতীয় বাক্য ব্যবহার করেন, যা শিশুর মস্তিষ্কে ‘নেগেটিভ সেলফ-টক’ তৈরি করে।” রাজশাহীর একটি পরিবারের উদাহরণ নিন—সাদিয়া যখন তার মেয়ে তিশাকে বলে, “গণিতের সূত্রটা বুঝতে সমস্যা হচ্ছে? চলো একসাথে খুঁজে বের করি,” তখন তিশা শেখে সমস্যা সমাধান সম্ভব।
কীভাবে কথা বলবেন:
- “করো” নয়, “চেষ্টা করো”: আদেশ নয়, উৎসাহ দিন।
- ভবিষ্যৎ-কেন্দ্রিক প্রশ্ন: “পরীক্ষায় কম নম্বর পেলে কী করবে?” না বলে বলুন, “পরেরবারের জন্য কী প্ল্যান করছ?”
- শারীরিক ভাষার গুরুত্ব: হাসি, চোখে চোখ রেখে কথা বলা, মাথা হেলানো—এগুলোই শিশুর মনে বোধ করে “আমার কথা গুরুত্বপূর্ণ।”
স্বাধীনতা ও দায়িত্ব: আত্মনির্ভরতার দুই ডানা
খুলনার দৌলতপুরে বেড়ে ওঠা আদনান (১৪) প্রতিদিন তার ছোট ভাইকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে যায়। এই দায়িত্ব তাকে শিখিয়েছে নেতৃত্বের গুণাবলী। মনোবিজ্ঞানী আলবার্ট বান্দুরার “সোশ্যাল লার্নিং থিওরি” অনুযায়ী, দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে শিশুরা নিজেদের সক্ষমতা আবিষ্কার করে। বাংলাদেশে ইউনিসেফের এক সমীক্ষা মতে, ১০-১৪ বছর বয়সী শিশুরা যারা ঘরের ছোট কাজ (যেমন: গাছের পরিচর্যা, বাজার করা) করে, তাদের মধ্যে আত্মনির্ভরশীলতা ৫০% বেশি।
দায়িত্ব দেওয়ার স্মার্ট উপায়:
- বয়স অনুপাতে কাজ: ৫-৭ বছর: নিজের জামা গুছানো, ৮-১০ বছর: পোষা প্রাণীর খাবার দেওয়া, ১১+: বাজেট করে ছোট খরচ করা।
- ‘ভুলের জায়গা’ রাখুন: প্রথমে বাজেট ভুল করলে তিরস্কার নয়, বলুন: “এবার কীভাবে করলে ঠিক হবে?”
- সাপ্তাহিক ‘দায়িত্ব মিটিং’: সন্তানের কাজের মূল্যায়ন করুন, পরামর্শ দিন।
স্কুল ও সমাজ: আত্মবিশ্বাসের দ্বিতীয় ঘাঁটি
বরিশালের কৃতি স্কুলের প্রধান শিক্ষক রওনক জাহানের কথায়, “শিক্ষকরা শুধু পাঠদান করেন না, তারা শিশুর আত্মসম্মানবোধের স্থপতি।” তার স্কুলে ‘ভালো কাজের ডায়েরি’ নামে একটি প্রকল্প চালু আছে—যেখানে প্রতিদিন একটি ইতিবাচক কাজ (যেমন: সহপাঠীর পেনসিল দেওয়া) লিখতে হয়। এই ছোট রেকর্ডই শিশুর মনে বদ্ধমূল করে: আমার কাজের মূল্য আছে।
স্কুল-বান্ধব পরিবেশ তৈরিতে অভিভাবকের ভূমিকা:
- শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ: শুধু খারাপ রিপোর্টের সময় নয়, সন্তানের উন্নতির সময়ও শিক্ষককে ধন্যবাদ দিন।
- সহপাঠীদের সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক: বাড়িতে সন্তানের বন্ধুদের ডাকুন, দলগত কাজে উৎসাহ দিন।
- শখের প্রতি সমর্থন: নাচ, গান বা ছবি আঁকায় পারদর্শিতা একাডেমিক রেজাল্টের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।
বাস্তব উদাহরণ: ময়মনসিংহের ত্রিশালে ‘আলোর পাঠশালা’ নামে একটি কমিউনিটি লাইব্রেরিতে শিশুরা সপ্তাহে একদিন গল্প বলার প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। অংশগ্রহণকারী ৯৫% শিশুর অভিভাবক জানিয়েছেন, তাদের সন্তান এখন গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সামনে কথা বলতে ভয় পায় না।
ডিজিটাল যুগে আত্মবিশ্বাসের চ্যালেঞ্জ: সামাজিক মাধ্যম ও বাস্তবতার ভারসাম্য
ফেসবুক, টিকটকের যুগে বাংলাদেশি কিশোর-কিশোরীদের ৬৮% নিজের চেহারা বা সামর্থ্য নিয়ে সন্দিহান—এই তথ্য দিয়েছে ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সি অব বাংলাদেশ। কুমিল্লার এক কলেজছাত্র রাফিদ (১৬) বললেন, “অনলাইনে সবার জীবন এত সুন্দর দেখায়, আমারটা যেন অপূর্ণ।” এখানেই অভিভাবকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ: বাস্তব সাফল্য ও ডিজিটাল বিশ্বাসযোগ্যতা-র মধ্যে পার্থক্য বোঝানো।
ডিজিটাল যুগে আত্মবিশ্বাস রক্ষার কৌশল:
- স্ক্রিন টাইম নয়, স্ক্রিন কনটেন্ট মনিটর করুন: সন্তান কী দেখছে, তা নিয়ে আলোচনা করুন।
- ‘লাইক’ নয়, ‘লার্নিং’-এ জোর দিন: অনলাইনে কারুশিল্প শেখা বা কোর্স করার মতো কাজে উৎসাহিত করুন।
- ডিজিটাল ডিটক্স: সপ্তাহে একদিন ‘নো-স্ক্রিন ডে’ রাখুন, পরিবারের সবাই মিলে বোর্ড গেম খেলুন বা প্রকৃতিতে সময় কাটান।
গবেষণা লিঙ্ক: জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের শিশু বিকাশ সংক্রান্ত গাইডলাইন
যখন আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ে: পুনরুদ্ধারের পথ
২০১৯ সালে সাভারে একাদশ শ্রেণির ছাত্রী প্রীতি (ছদ্মনাম) পরীক্ষায় খারাপ করায় আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোহিত কামালের থেরাপি তাকে ফিরিয়ে এনেছিল জীবনে। তার মতে, “আত্মবিশ্বাস ভাঙলে প্রথমেই শারীরিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, তারপর খুঁজে বের করতে হবে—অভিভাবক বা সমাজের কোন চাপ তাকে ভেঙে দিয়েছে।”
সঙ্কটকালীন পদক্ষেপ:
- শুনুন, বিচার করবেন না: “এতো小事 নিয়ে এত ভয়?” না বলে বলুন, “তোমার অনুভূতি আমি বুঝতে পারছি।”
- পেশাদার সাহায্য নিন: বাংলাদেশ ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি সোসাইটি থেরাপিস্ট রেফারেল দেয়।
- সাফল্যের নতুন সংজ্ঞা দিন: পড়ালেখা বা ক্যারিয়ার নয়, মানবিক গুণাবলীকেও সাফল্য হিসেবে তুলে ধরুন।
সতর্কতা: কোনো অবস্থাতেই শিশুর আবেগকে “অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা” বলে উড়িয়ে দেবেন না। দীর্ঘমেয়াদী হতাশা, খাওয়া-ঘুমে অনিয়ম বা আত্ম-ক্ষতির চিহ্ন দেখলে অবিলম্বে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
জেনে রাখুন
১. আত্মবিশ্বাসী শিশু গড়ে তোলার উপায় কী?
আত্মবিশ্বাস গড়ে তোলার মূল উপায় হলো শিশুর মতামতকে সম্মান করা, ছোট সাফল্যে উৎসাহ দেওয়া এবং ভুলকে শেখার সুযোগ হিসেবে দেখা। দৈনিক অন্তত ১৫ মিনিট একান্ত সময় দেওয়া, যেখানে শিশু তার মনের কথা বলবে। বাংলাদেশি প্রেক্ষাপটে পারিবারিক সিদ্ধান্তে শিশুর অংশগ্রহণ বাড়ানো (যেমন: ঘরের রঙ পছন্দ) বিশেষভাবে কার্যকর।
২. সন্তানের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য অভিভাবক হিসেবে আমার কী ভূমিকা থাকা উচিত?
আপনার প্রধান ভূমিকা হবে ‘সুপারিশকারী’ না হয়ে ‘সমর্থনকারী’ হওয়া। শিশুর প্রচেষ্টার প্রশংসা করুন, ফলাফলের নয়। নিজে আত্মবিশ্বাসী আচরণ করুন—কারণ শিশুরা অনুকরণে শেখে। বাংলাদেশে অনেক অভিভাবক সন্তানের সামনে আর্থিক বা পেশাগত হতাশার কথা বলেন, যা শিশুর মনে অনিরাপত্তা সৃষ্টি করে।
৩. স্কুলে বুলিং হলে সন্তানের আত্মবিশ্বাস রক্ষা কীভাবে করব?
প্রথমেই শিশুর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করুন এবং শিশুকে বুলিং মোকাবিলার কৌশল শেখান, যেমন: দৃঢ়ভাবে “না” বলা, শিক্ষকের সাহায্য চাওয়া। বাংলাদেশে “শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিটি” (Child Rights Protection Committee) বুলিং রোধে কাজ করে।
৪. ডিজিটাল মাধ্যম কীভাবে সন্তানের আত্মবিশ্বাসে প্রভাব ফেলে?
অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার শিশুর আত্মমর্যাদাবোধকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে, কারণ তারা নিজেদের সঙ্গে অসম্ভব ‘ফিল্টারড রিয়ালিটি’র তুলনা করে। এর থেকে রক্ষা পেতে সন্তানের স্ক্রিন টাইম সীমিত করুন এবং বাস্তব জীবনের দক্ষতা (যেমন: বাগান করা, রান্না শেখা) বিকাশে সাহায্য করুন।
৫. শিশুর আত্মবিশ্বাস কমে গেলে কী কী লক্ষণ দেখা দেয়?
বেশি চুপচাপ থাকা, সহজ কাজেও দ্বিধা করা, ঘন ঘন “আমি পারব না” বলা, স্কুলে যেতে অনীহা, ঘুম বা খাওয়ায় অনিয়ম—এগুলো প্রধান লক্ষণ। বাংলাদেশি পরিবারে প্রায়ই এই লক্ষণগুলো “বয়সের দোষ” বলে উপেক্ষা করা হয়, যা মারাত্মক ভুল।
৬. আত্মবিশ্বাসী সন্তান গড়তে কী ধরনের খেলাধুলা সহায়ক?
দলগত খেলা যেমন: ক্রিকেট, ফুটবল বা ব্যাডমিন্টন সহযোগিতা ও নেতৃত্ব শেখায়। একক খেলা যেমন: দাবা বা দৌড় ধৈর্য্য বাড়ায়। ঢাকার রমনা পার্ক বা চট্টগ্রামের ফয়েজ লেকে সপ্তাহে একদিন পারিবারিক খেলার আয়োজন করুন।
আত্মবিশ্বাসী সন্তান গড়ে তোলার কার্যকরী কৌশল কোনো এককালীন প্রক্রিয়া নয়—এটি একটি চলমান প্রেম ও যত্নের সম্পর্ক, যেখানে প্রতিটি ভুল, প্রতিটি ছোট বিজয়, প্রতিটি উৎসাহ আপনার সন্তানকে ভবিষ্যতের জন্য অদম্য করে গড়ে তোলে। আজই শুরু করুন: আপনার সন্তানের চোখে তাকিয়ে বলুন, “তোমার মধ্যে যে শক্তি আছে, আমি তা দেখতে পাচ্ছি।” কারণ, আপনার বিশ্বাসই তার পাখা মেলার প্রথম হাওয়া। শেয়ার করুন এই গাইডলাইনটি—সবাই মিলে গড়ে তুলি আত্মবিশ্বাসে ভরপুর একটি প্রজন্ম।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।