মো: মোস্তাফিজুর রহমান : সাধারণত গীত ও সংগীত একে অন্যের পরিপুরক। কাব্যের সঙ্গে সুরের মিশ্রনে তৈরী হয় গীত। আর এই গীতের সাথে বাদ্যযন্ত্র সংগত করে যে সুর তৈরী হয় তাকেই সংগীত বলা হয়। স্বর ও শব্দ গীত গঠনের জন্য অন্যতম দুটি উপাদান। আঞ্চলিক ভাষায় প্রচারিত হওয়ার কারণে প্রকাশ ভঙ্গিতে থাকে গীতের ভিন্নতা। বিয়ের গীত বাঙালি লোকসংস্কৃতির এক অন্যতম অনুষঙ্গ। এগুলোর উদ্ভব হয়েছিল প্রধানত হিন্দুসমাজে, মঙ্গলকাব্যে। পরে ইসলামী শরিয়তে নিষেধ হওয়া সত্বেও মুসলমান সমাজে গীত সমাদৃত হতে থাকে।
আশ্চর্যের বিষয় হলো-এসব গীত আঞ্চলিক ভাষায় মহিলাদের নিজস্ব ছন্দিই রচিত। এসব গীত সুপ্রাচীনকাল থেকেই গ্রামের মহিলারাই মুখে মুখে রচনা করেছেন, সুর করেছেন এবং পরিবেশনও করেছেন। এইসব মহিলারা অধিকাংশই ছিলেন নিরক্ষর, অশিক্ষিত, অল্প শিক্ষিত- পড়ালেখা জানা পাবলিক নন। গীত রচনা বা এর সুর শেখার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও তাদের ছিল না। অথচ এরা নিজেরাই দক্ষতার সাথেই গীত রচনা, সুর ও পরিবেশন করতে পারতেন। অনেক গীত তাৎক্ষণিকভাবে রচিত তাই এগুলোর কোনও লিখিত পাণ্ডুলিপিও নেই।
যেহেতু বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে আঞ্চলিক রীতি অনুযায়ী ঐতিহ্যগতভাবে বিয়ের গীত পরিবেশেনের একটা চিরাচরিত রেওয়াজ ছিল সেহেতু রংপুর অঞ্চলেও বিয়ের অনুষ্ঠানে গীত পরিবেশনের রীতি প্রচলিত ছিল বহুকাল থেকেই।
রংপুর অঞ্চলে হুদমার গান, জগেরগান, যোগীর গান, গোয়ালীর গান, ক্ষ্যাপাগান, জারীগান, মালশা গান, পালাগান বা কাহিনীগান, মুর্শিদি, মারফতি, ফকিরি ইত্যাদি নানা ধরনের সঙ্গীতের পাশাপাশি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল এই ‘বিয়ের গীত’। এগুলো নানান উপলক্ষ নিয়ে রচিত হত। যেমন গায়ে হলুদ, বিয়ে, বউ ভাত, সাধভক্ষন, অন্নপ্রাসন বা মুখে ভাতসহ বিয়ের বিভিন্ন পর্বকে ঘিরে এই গীতগুলো রচিত ও পরিবেশিত হয়ে আসছে বহুকাল ধরেই।
বিয়ের একেক আচার অনুষ্ঠান বা আয়োজনে একেক ধরনের গীত গাওয়া হতো। যেমন বিয়ে বাড়িতে আনন্দের উপলক্ষ হিসেবে দলবেঁধে নারীরা গান গাইত। বরকে বরণ করার সময় পরিবেশিত গীতে যেমন আনন্দ ফুটে উঠত তেমনি কনের বিদায়ের সময় গীতে দুঃখ বেদনা ও বিচ্ছেদের সুর ভেসে উঠত। এভাবে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের ন্যায় বিয়ের গীত রংপুর অঞ্চলে লোকসঙ্গীতের বিরাট একটা অংশ দখল করে আছে।
একসময় গীত ছাড়া বিয়ে ছিল যেন কল্পনাতীত ব্যাপার। সেসময় বিয়ের অনুষ্ঠানে একটা ঘরে জলচৌকির উপরে কনে সেজেগুজে বসে থাকত আর পাশে একদল মেয়ে বিয়ের গীত গাইত। এসব গীত গাইতে গাইতে নাচত মধ্যবয়সি মহিলারাও। তারা অন্যদের সাথে নিজের মত ভঙ্গিমায় গাইতেন এবং নাচতেন। কখনো কখনো গ্রামের এসব বিয়ে কিংবা গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে ‘গীত গাওনি’ নামে কিছু মহিলা দল বেঁধে গীত পরিবেশেন করত এবং গীতের তালে ছন্দ ও মুদ্রাবিহীন নাচও পরিবেশন করত। এসব গীত গাওনিরা অসংখ্য বিয়ের গীত মুখস্থ বলতে পারত। এ অঞ্চলের গ্রামাঞ্চলে নানা ধরনের গীত প্রচলিত ছিল। যেমন:
১. গাও হ্যালানি দিয়া নাচ রে গোলাপী
চুল হ্যালানি দিয়া নাচ রে গোলাপী
গোলাপী মোর দুধের সর
ক্যামনে যাইবে পরের ঘর…..
২. ছোট ছোট কারেঙ্গা
ঢাল ঢাল পাত
শহরে মেলিয়া গেল পাত রে মারওয়া
ভালবাসো তোরে …..
বন্দরে মেলিয়া গেল পাত রে মারওয়া
ভালবাসো তোরে …..
৩. ঝরি পরে চিকোরে চিকো
আগিনা হইল্ মোর পিছিলা রে রসিয়া।
সেইনা আগিনায় নাচিতে নাচিতে
শাড়ি গেইল্ মোর ছিড়িয়া রে রসিয়া …….
৪. বালার কাই আছে দরদী
তায় বাটিবে হলদি
বালার ভাওজি আছে দরদী
তায় বাটিবে হলদী
বালার বোনজি আছে দরদী
তায় বাটিবে হলদী।।
৫. বাহির করো বাহির করো রে
অঞ্চলে ঘিরিয়া
দয়ার বাবা দেখিলেরে না দিবে ছাড়িয়া …
৬. পাইর বান্দে পাথুরি হে কালাচান
হেচিয়া পেন্দো তার ধুতি হে কালাচান
বসিয়া পেন্দো তার ধুতি হে কালাচান…
৭. খোলার হাটের বালুর চরে সায়মোনা টাঙ্গাইছেরে
লাল ময়না তোর ই কারনে রে
সোন্দর ময়না তোর ই কারনে রে
তোমার বাবা জবান দিছে ভরা সভার মাঝেরে….
৮. দুপুইরা অইদের মইদেরে পালকি
পালকি চলছে রবে রবে….
পালকির কাপড় তুইলা গো দেখি
লাইলীর আব্বা আইসে নাই সাতে।
৯. ডালিমের গাছে ডালিম ধরে
ডালিমের ভারে হাইলা পরে
ওকি হায় হায় রুপালি নাইওর যাইতাম….
১০. দাঁত ড্যাংরা বরের বওনাই মিছাই দেখান ভাও
কোন বা ভাগ্যে পাইনেন তোমরা চান্দের মতন ছাও—
এসব গীতের সুর কিছুটা করুণ, মর্মস্পর্শী ও আবেগঘন ছিল। এসব গীতে চিত্ত-বিনোদন ছাড়াও সমাজের নানা সুখ-দুঃখ, সঙ্গতি- অসঙ্গতি, প্রথা ও ঐতিহ্য, নারী মনের নানা আনন্দ-বেদনা, হাসি-ঠাট্টা, আবেগ-উত্কণ্ঠার কথা প্রকাশিত হত। এখন আর এমন গীত খুব একটা শোনা যায় না। আধুনিকতার ছোঁয়ায় গ্রামবাংলার সেই ঐতিহ্য আর নেই। আধুনিক প্রজন্ম বিয়ের এসব গীত আর পছন্দ করেনা। তারা বিয়ে বাড়িতে ‘বিয়ের গীত’ -এর বদলে বিদেশি বা হিন্দী গান, ব্যান্ড সংগীত অথবা যান্ত্রিক সাউন্ড বক্সের উচ্চ শব্দ শুনতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে । এখন গীত বা গীত গাওয়ানিদের সেই কদরও আর নেই। দেশের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে এখনও বিয়ের গীত খানিকটা প্রচলিত থাকলেও কালক্রমে এগুলো বিলুপ্তির পথে। আধুনিক সংগীতের চাপে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামবাংলার এসব পুরাতন সংস্কৃতি।
লেখক: আইনের শিক্ষক ও পিএইচডি গবেষক
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।