এনওআর বা ‘মৌলিক গবেষণা না হওয়া’ নীতি অনুযায়ী, আপনি উইকিপিডিয়ায় লেখার সময় নিজের আবিষ্কৃত কিছু সেখানে যুক্ত করতে পারবেন না। উইকিপিডিয়া একটি সেকেন্ডারি সোর্স, মানে অন্যান্য নির্ভরযোগ্য সূত্রের তথ্য কেবল উইকিপিডিয়ায় এক করে উপস্থাপন করা হয়। আপনি চাইলেই সেখানে বৈজ্ঞানিক গবেষণার তথ্য প্রথমবারের মতো যুক্ত করতে পারবেন না।
এই মূল কন্টেন্ট পলিসিগুলো মোটামুটিভাবে সব উইকিপিডিয়া ভাষা সংস্করণে একইভাবে ব্যবহার করা হয়। যে ভাষা সংস্করণের মান যত ভালো, তার মূল কন্টেন্ট পলিসি সংক্রান্ত পাতাগুলো তত সাবলীল, সুলিখিত ও সহজে বোধগম্য। কোনো কোনো উইকিপিডিয়া ভাষা সংস্করণে স্বেচ্ছাসেবকের অভাবে এই গুরুত্বপূর্ণ পাতাগুলো ইংরেজিতেই রেখে দেওয়া হয় অথবা সংক্ষিপ্তভাবে অনুবাদ করা হয়। অনেকে ভাবেন, একটি নিবন্ধ ইংরেজি উইকিপিডিয়ায় থাকবে মানে বাংলা বা অন্য যেকোনো ভাষা সংস্করণেও অবশ্যই থাকবে, কিংবা হুবহু একইভাবে সব ভাষায় থাকবে।
এটা পুরোপুরি সত্য নয়। একই নিবন্ধ একটি ভাষায় খুব ভালোমানের হতে পারে, আবার অন্য ভাষায় এর মান ভালো নাও হতে পারে। একটি ভাষা সংস্করণের পেছনে যে স্বেচ্ছাসেবকরা কাজ করেন, তাঁদের দক্ষতা, কাজ করার প্রক্রিয়ার মান, কর্মপরিবেশের সুস্থতা সেই ভাষা সংস্করণে থাকা তথ্যের মান ও ভাষা সংস্করণের নীতিমালার মান অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করে।
অনেকসময় সবচেয়ে সমৃদ্ধ উইকিপিডিয়া ভাষা সংস্করণগুলোতেও বড় ভুল তথ্য থাকতে পারে। ২০২২ সালে পুরো উইকিমিডিয়া আন্দোলন একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনার মুখোমুখি হয়। একজন চীনা গৃহিনী বাড়িতে কাটানো অলস সময় কাজে লাগানোর জন্য ২০১৯ সাল থেকে মধ্যযুগীয় রাশিয়ান ইতিহাস নিয়ে চাইনিজ উইকিপিডিয়াতে ২০৬টির বেশি নিবন্ধ তৈরি করেন, যার সবগুলোই ছিল বানোয়াট! সেসব নিবন্ধগুলো এত সুকৌশলে লেখা হয়েছিল এবং এত ভালোভাবে সূত্র উল্লেখসহ অন্যান্য সব করা হয়েছিল যে ২০২২ সালের আগে বিষয়টা কেউ ধরতেই পারেনি!
এমনকি এসব কাল্পনিক ইতিহাসকে সত্য ভেবে এই নিবন্ধগুলো ইংরেজি, আরবি আর রুশ ভাষার মতো বড় উইকিপিডিয়াগুলোতে অনুবাদও করা হয়! এই ঘটনা ‘ভাইস’ এর মতো আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিনে গুরুত্ব দিয়ে ছাপানো হয় এবং উইকিপিডিয়ার নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে অন্যতম কেস স্টাডি হিসেবে ইতিহাসের পাতায় জায়গা করে নেয়। এত বড় ঘটনা ধরাই পড়ত না, যদি না চীনা ঔপন্যাসিক ‘ঈফান’ তাঁর একটি বইয়ের জন্য পড়াশোনা করতে গিয়ে এই মহিলার লেখা নিবন্ধগুলোর তথ্যসূত্র যাচাই না করতেন। যাচাই করতে গিয়ে তিনি দেখেন, যেসব বইয়ের পাতা সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, সেগুলোর কোনো অস্তিত্বই নেই!
যেসব বিষয় নিয়ে অনেক বেশি মানুষ একসঙ্গে কাজ করেন, সেখানে তথ্যের মান ভালো থাকে। যেমন বৈজ্ঞানিক বা চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কিত নিবন্ধ। ২০০৫ সালে যখন উইকিপিডিয়া নতুন ছিল, তখন নেচার ইংরেজি উইকিপিডিয়া নিয়ে একটি গবেষণা করে। যেখানে তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে বৈজ্ঞানিক তথ্যের দিক থেকে উইকিপিডিয়া বিখ্যাত বিশ্বকোষ এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার প্রায় সমকক্ষ।
যদিও উইকিপিডিয়া বিনামূল্যেই পাওয়া যায়, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার ক্ষেত্রে তেমনটা হতো না। অপরদিকে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাকেও তথ্যসূত্র হিসেবে উইকিপিডিয়ায় ব্যবহার করা হয়। ২০০৫ সালের তুলনায় এখন ইংরেজি উইকিপিডিয়া কয়েকগুণ বেশি পরিণত। এখন গুগল বা ইউটিউব প্রয়োজনে উইকিপিডিয়াকে নির্ভরযোগ্য তথ্যের উৎস হিসেবে ব্যবহারকারীদের সাজেস্ট করে।
উইকিপিডিয়ার তথ্য যাচাই করার আগে উইকিপিডিয়ার পাতা সম্পর্কে কিছু সাধারণ ধারণা থাকা জরুরি। প্রতিটি উইকিপিডিয়া পাতার দুটি মূল অংশ থাকে—মূল পাতা আর আলাপ পাতা বা টক পেইজ। নিবন্ধের ওপরে বাঁ পাশে এই দুটো পাতা লিঙ্ক করা থাকে। মূল পাতায় মূল নিবন্ধ থাকে; আর আলাপ পাতায় সেই নিবন্ধ যারা লেখেন, তাঁদের সেই নিবন্ধবিষয়ক আলোচনা থাকে। যেকোনো নিবন্ধ যাচাই করার সময় আলাপ পাতা দেখে নেওয়া ভালো।
এতে ওই নিবন্ধ তৈরির সময় কোন কোন বিষয় বিবেচনায় ছিল, কীভাবে ঐকমত্য তৈরি হয়েছে, এমনকি কখনো কখনো ওই নিবন্ধ যাঁরা লিখছেন, তাঁদের দক্ষতা সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যেতে পারে। সব সময় যে আলাপ পাতা বা টক পেইজে আলোচনা থাকবে, তা নয়। তবে যদি থাকে, তাহলে পড়ে নেওয়া ভালো।
অনেক সময় দেখা যায়, মূল নিবন্ধ পড়ে বিষয়বস্তু সম্পর্কে যতটা জানা যায়, টক পেইজ পড়ে সেই বিষয়বস্তু সম্পর্কে তার চেয়েও বিস্তারিত ধারণা পাওয়া যায়। নিবন্ধের ওপরে ডানপাশে তিনটা অপশন পাওয়া যায়—নিবন্ধ পড়ার বাটন, সোর্স বা উৎস পাতা দেখার বাটন আর হিস্টোরি বা ইতিহাস দেখার বাটন। মূল নিবন্ধ পড়তে অবশ্যই ‘রিড’ বা পড়ুন বাটন, মূল নিবন্ধ সম্পাদনা বা এডিট করতে ‘এডিট সোর্স’ বা উৎস সম্পাদনা বাটন এবং সম্পাদনা ইতিহাস দেখার জন্য রয়েছে হিস্ট্রি বা ইতিহাস বাটন।
এই হিস্টোরি থেকেও অনেক কিছু জানা যায়। প্লস ওয়ান জার্নালের গবেষণায় (Benjakob O, Guley O, Sevin J-M, BlondelL, Augustoni A, Collet M, et al. 2023) বিজ্ঞানীরা দেখানোর চেষ্টা করেছেন, কীভাবে উইকিপিডিয়া পাতার হিস্ট্রি অংশে চলমান বিজ্ঞানের অগ্রগতির ইতিহাস আটকা পড়ে যায়। তাঁরা ইংরেজি উইকিপিডিয়ায় ক্রিসপার ক্যাস প্রযুক্তি সম্পর্কিত তথ্য পর্যবেক্ষণ করেন এবং কীভাবে সম্পূর্ণ নতুন একটি আবিষ্কার থেকে ‘জীবপ্রযুক্তিগত বিপ্লব’-এর অংশ হয়ে গেছে এবং বাস্তব জীবনে ক্রিসপার ক্যাসের উন্নয়নের সমান্তরালে উইকিপিডিয়া সম্পর্কিত নিবন্ধগুলোও সমানতালে সমৃদ্ধ হয়েছে, সেটি বেশ স্পষ্টভাবে দেখিয়েছেন তাঁরা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।