আন্তর্জাতিক ডেস্ক: আফগানিস্তানের একটি বড় শহর মাজার-ই-শরীফ থেকে মাত্র ৩০ মিনিট দূরে এক ঘাঁটিতে দেখা হলো তালেবানের যোদ্ধাদের সাথে। খবর বিবিসি বাংলার।
তারা যেসব ‘মালে গনিমত’ (যুদ্ধে অর্জিত সম্পদ) দেখাচ্ছিল তার মধ্যে রয়েছে একটি হামভি সামরিক জিপ, দুটি পিক-আপ ভ্যান এবং একগাদা শক্তিশালী মেশিনগান। এদের নেতা আয়েনুদ্দিন দাঁড়িয়ে ছিলেন ভারি অস্ত্রে সজ্জিত একদল যোদ্ধার মাঝে। সাবেক মাদ্রাসা ছাত্র মি. আয়েনুদ্দিনের মুখ পাথরের মতো কঠোর।
আফগানিস্তান থেকে বিদেশি সৈন্য প্রত্যাহারের সাথে সাথে তালেবান প্রায় প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা দখল করছে। আর এই দেশ দখলের লড়াইয়ে দুই পক্ষের মাঝখানে পড়েছে দেশের আতঙ্কিত জনগণ। এই যুদ্ধের কবলে পড়ে বাস্তুহারা হয়েছে হাজার হাজার আফগান। প্রাণ হারিয়েছে কিংবা গুরুতর আহত হয়েছে শত শত মানুষ।
আমি আয়েনুদ্দিনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি যে জনগণের হয়ে লড়ছেন বলে দাবি করছেন, তাদের ওপর চালানো সহিংসতাকে তিনি কীভাবে সমর্থন করেন?
আয়েনুদ্দিন বলেন, লড়াই চলছে, তাই লোক মরছে।
তিনি জানান, তারা চেষ্টা করছেন ‘বেসামরিক লোকজনের ক্ষয়ক্ষতি’ না করতে।
‘যুদ্ধটা তারাই শুরু করেছে’
আমি বললাম, এই যুদ্ধটা তো শুরু করেছে তালেবান।
তিনি বললেন, না। আমাদের একটি সরকার ছিল। সেটাকে উৎখাত করা হয়েছিল। তারাই (আমেরিকানরা) এই যুদ্ধ শুরু করেছে।
আয়েনুদ্দিন এবং তার তালেবান সাথীরা বিশ্বাস করেন সময় এখন তাদের পক্ষে এবং ২০০১ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন অভিযানে তাদের সরকারের পতনের পর থেকে এই প্রথম তারা তাদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করতে চলেছেন।
কাবুলের ‘পুতুল সরকার’ সম্পর্কে তিনি বলেন, তারা পশ্চিমা জীবনধারা বদলাবে না… আমরা সে জন্য তাদের হত্যা করবো।
আমাদের কথাবার্তা শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ পরই শোনা গেল হেলিকপ্টারের আওয়াজ। তালেবান যোদ্ধারা তাদের হামভি-তে চড়ে দ্রুত সেখান থেকে সরে গেল। আফগান বিমান বাহিনী যে এখনও তালেবানের জন্য একটা বড় হুমকি, এবং আফগানিস্তানের লড়াই যে এখনও শেষ হয়নি, এই ঘটনা তাকেই আবার স্মরণ করিয়ে দিল।
উত্তরাঞ্চল কেন তালেবানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ
এরপর আমরা গেলাম বালখ্-এ। এটা একটা প্রাচীন শহর। ইসলামের সবচেয়ে খ্যাতনামা সুফি কবি জালালুদ্দিন রুমির জন্মস্থান এই বালখ্-এ। এই এলাকা দিয়ে আমি গত বছরও গেছি। সেই সময়টাতেও এই শহরের নিয়ন্ত্রণ ছিল আফগান সরকারি বাহিনীর হাতে, তবে দূরদূরান্তের গ্রামগুলো নিয়ন্ত্রণ করতো তালেবান। এবার এই অভূতপূর্ব অভিযানে তালেবান বালখসহ আফগানিস্তানের প্রায় ২০০টি জেলা শহর দখল করেছে।
একজন ঊর্ধ্বতন তালেবান কর্মকর্তা জানালেন, আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলে তারা পরিকল্পনা করেই অভিযান পরিচালনা করছেন। কারণ, এখানে তালেবানের প্রতিপক্ষ বরাবরই শক্তিশালী এবং এখানকার জনসংখ্যা পাঁচমিশালী।
তালেবানের মূল নেতৃত্বে থাকা বেশিরভাগ নেতাই পশতুন পাঠান জাতিগোষ্ঠীর। কিন্তু ঐ কর্মকর্তা জানান, তারা এবার দেখাতে চান যে অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর লোকও তাদের দলে রয়েছে।
‘কাউকেই জোরজবরদস্তি করা হচ্ছে না’
স্থানীয় তালেবান নেতা, যিনি আমাদের দেখাশোনা করছেন তার নাম হাজি হেকমত। তিনি দেখানোর চেষ্টা করলেন যে তালেবানের শাসনে সেখানকার মানুষের দৈনন্দিন জীবনধারা স্বাভাবিক রয়েছে। ছাত্রীরা দলে দলে স্কুলে যাচ্ছে (যদিও দেশের অন্যত্র মেয়েদের স্কুলে যাওয়া বারণ করার খবর এসেছে।) বাজারগুলো নারী ও পুরুষ খদ্দেরে গমগম করছে।
স্থানীয় সূত্র থেকে আগে আমাদের জানানো হয়েছিল নারীরা শুধু পুরুষ সঙ্গী নিয়ে বাড়ির বাইরে যেতে পারেন। কিন্তু এখানে এসে দেখা গেল খবরটা ভুল।
আফগানিস্তানের অন্য জায়গাগুলোতে তালেবান অধিনায়করা এব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। তবে আমরা এখানে যাদের দেখেছি তারা সবাই ছিলেন বোরকা পরা। তাদের মুখ এবং হাত ছিল ঢাকা।
হাজি হেকমত জোর দিয়ে বললেন, এদের কাউকেই কোন জোরজবরদস্তি করা হচ্ছে না এবং মেয়েদের কী পরিধান করা উচিত তালেবান শুধু সে সম্পর্কেই ‘উপদেশ’ দিচ্ছে।
কিন্তু আমি জানতে পারলাম ট্যাক্সি চালকদের প্রতি কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে তারা যেন কোন বোরকা-বিহীন ‘বেগানা’ নারীকে ট্যাক্সিতে না তোলেন।
আমরা বালখ্ থেকে ফিরে আসার পর খবর পেলাম সেখানে এক নারীকে শুধু তার পোশাকের কারণে হত্যা করা হয়েছে। তবে এই ঘটনার সাথে তালেবান সদস্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ হাজি হেকমত অস্বীকার করেন।
এই বাজারের অনেকেই তালেবানের প্রতি তাদের সমর্থনের কথা জানালেন। তালেবানের জন্য সেখানকার নিরাপত্তার প্রভূত উন্নতি হয়েছে বলে তালেবানের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। কিন্তু আমাদের সাথে সশস্ত্র তালেবান রক্ষী ছিল বলেই তারা একথা বলেছিলেন, নাকি তারা সত্যি সত্যি তা বিশ্বাস করেন বলে বলেছেন, তা যাচাই করার কোন উপায় ছিল না।
তরুণদের নিয়ে শঙ্কা
তালেবানের কট্টর নীতিমালার প্রতি রক্ষণশীল আফগানদের একাংশের সহানুভূতি রয়েছে। আর তালেবান এখন চেষ্টা করছে দেশের এক বড় অংশের ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে।
মাজার-ই-শরীফের নীল মসজিদের ছায়ায় গত সপ্তাহে দেখা গেল নরনারীরা শান্ত পরিবেশে নিরুদ্বিগ্ন-ভাবে ঘোরাফেরা করছেন।
শহরের নিয়ন্ত্রণ তখনও সরকারের হাতে থাকলেও আমি যার সঙ্গেই কথা বলেছি, তারা সবাই তালেবানের শাসন পুন-প্রতিষ্ঠিত হলে কী ঘটতে পারে তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। বিশেষভাবে শহরের তরুণ জনগোষ্ঠী যে ”স্বাধীনতা” নিয়ে বড় হচ্ছে তাদের কী হবে তা নিয়ে তারা চিন্তিত।
তবে বালখ্ জেলায় তালেবান এখন বিকল্প সরকার তৈরির চেষ্টা করছে। তারা শহরের সব সরকারি ভবন দখল করেছে। শুধু একটি বাদে। সেটি হলো পরিত্যক্ত পুলিশ লাইন।
এটি ছিল তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ পুলিশ প্রধানের সদর দফতর। তালেবান যখন ঐ এলাকার নিয়ন্ত্রণ দখলের চেষ্টা করছিল তখন এক আত্মঘাতী হামলায় ভবনটির একাংশ ধসে পড়ে।
ঐ অভিযানের বর্ণনা দিতে গিয়ে জেলার তালেবান নিযুক্ত গভর্নর আব্দুল্লাহ মঞ্জুরের মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। তার সঙ্গীরাও মুচকি হাসছিল। আফগানিস্তানের অন্যান্য জায়গার মতোই এখানে যে লড়াই চলেছে তা ছিল আংশিকভাবে মতাদর্শের এবং আংশিকভাবে ব্যক্তিগত।
ইসলামী আমিরাত আফগানিস্তান
তবে তালেবান এখানে দখল নেয়ার পর কিছু জিনিস এখনও আগের মতোই রয়ে গেছে। শহরের রাস্তায় দেখা গেল কমলা-পোশাক পরা ঝাড়ুদাররা কাজ করছে। সরকারি অফিসেও কিছু কর্মচারী হাজিরা দিয়েছেন। এদের দায়িত্বে রয়েছেন তালেবান নিযুক্ত মেয়র। তাকে দেখা গেল একটি বড় কাঠের টেবিলের সামনে বসে থাকতে। টেবিলের এক কোনায় রাখা একটি সাদা পতাকা। সেখানে লেখা ‘ইসলামী আমিরাত আফগানিস্তান।’
এর আগে এই মেয়রের দায়িত্ব ছিল তালেবানের জন্য গোলাবারুদ সরবরাহ করা। এখন তার কাজ ‘কর’ আদায়। তিনি বেশ গর্বের সাথেই জানালেন, আগের সরকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যত অর্থ আদায় করতে, তারা এখন তার চেয়ে কম অর্থ আদায় করেন।
তবে সামরিক জীবন থেকে বেসামরিক জীবনে ফিরে আসার পথ খুব সহজ না। ইন্টারভিউ নেয়ার সময় অস্ত্রহাতে এক তালেবান যোদ্ধা ছবিতে পোজ দেয়ার জন্য মেয়রের পেছনে এসে দাঁড়ান। তালেবানের ঊর্ধ্বতন নেতারা তাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যান।
‘নোংরা’ গান প্রচার নিষিদ্ধ
অন্যান্য জায়গায় দেখা গেল ইসলামের কঠোর ব্যাখ্যা তালেবান কঠিন হাতেই প্রয়োগ করছে। আগে এখানকার রেডিও থেকে ইসলামী গান ও পপ সঙ্গীত প্রচার করা হতো। এখন শুধু ধর্মীয় বিষয়াবলী সম্প্রচার করা হয়।
হাজি হেকমত বলছেন, তারা ‘নোংরা’ গান প্রচার নিষিদ্ধ করেছেন। তবে তিনি বলেন, যে যা শুনতে চায় তাতে তারা কোন বাধা সৃষ্টি করেন না।
তবে আমি জানতে পেরেছি, গান শোনার সময় স্থানীয় বাজারে এক ব্যক্তিকে হাতেনাতে ধরা হয়। শাস্তি হিসেবে তালেবান যোদ্ধারা তাকে খালি পায়ে রাস্তার ওপর দাঁড় করিয়ে রাখে। তখন রাস্তায় এতটাই গরম ছিল যে ঐ ব্যক্তি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
তবে হাজি হেকমত জোর দিয়ে বললেন যে এধরনের কোন ঘটনাই ঘটেনি। আমরা যখন রেডিও স্টেশনে থেকে বের হয়ে আসছিলাম তখন তিনি একদল যুবককে দেখিয়ে বলেন এদের মুখে কোন দাঁড়ি নেই। “দেখেছেন! আমরা কাউকেই জোর করছি না,” হাসতে হাসতে তিনি বললেন।
তালেবানের ‘গ্রহণযোগ্য’ ভাবমূর্তি
এসব ঘটনা থেকে এটা পরিষ্কার যে তালেবান সারা বিশ্বের কাছে তার একটি গ্রহণযোগ্য ভাবমূর্তি তুলে ধরতে চায়। তবে দেশের অন্যত্র তালেবান বেশ কঠোর আচরণ করছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে এটা অনেকাংশেই নির্ভর করে ঐ এলাকার তালেবান অধিনায়কের কী মনোভাব তার ওপর।
আফগানিস্তানের যেসব জায়গা তালেবানের নিয়ন্ত্রণে সেখানকার কোন কোন জায়গা থেকে বিচার-বহির্ভূত হত্যা এবং অন্যান্য নির্যাতনের ক্রমবর্ধমান খবর আসছে।
পশ্চিমা দেশের কর্মকর্তারা তালেবানকে সতর্ক করে বলেছেন, তালেবান জোর করে দেশ দখল করলে আফগানিস্তানকে একঘরে করা হবে।
তালেবান যখন এর আগে ক্ষমতায় ছিল সে সময়ের কথা যাদের মনে আছে তারা শরীয়া আইনকে ব্যবহার করে তালেবানের নিষ্ঠুর শাস্তির কথাই উল্লেখ করেন।
গত মাসে দক্ষিণাঞ্চলীয় হেলমান্দ প্রদেশে তালেবান শিশু অপহরণের অভিযোগে দুই ব্যক্তিকে ধরে একটি সেতু থেকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়। যুক্তি হিসেবে তারা বলে ঐ দু’জন দোষী প্রমাণিত হয়েছে।
‘ঘরের দুশমনও পরাজিত হবে’
আমরা যেদিন বালখ্ প্রদেশে গেলাম সেদিন তালেবানের একটি আদালতে বিচারকার্য চলছিল। মামলাগুলোর সবই ছিল জমি সংক্রান্ত বিবাদ। তালেবানের শাস্তি নিয়ে অনেকের মনে ভয় থাকলেও বিচারের দ্রুততা নিয়ে সন্তোষ দেখা যায়। কারণ দুর্নীতিবাজ সরকারি ব্যবস্থায় তার ন্যায়বিচার পেতে বহু সময় লেগে যেত।
এক মামলার ফরিয়াদি বলছিলেন, আমাকে বহুবার ঘুষ দিতে হয়েছে।
তালেবান বিচারক হাজি বদরুদ্দিন বললেন, তিনি দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে গত চার মাসে তিনি কাউকে কোন শারীরিক শাস্তি দেননি। উচ্চতর আদালতে গুরুত্বপূর্ণ রায়গুলো পর্যালোচনার করার জন্য আপিলের সুযোগ আছে বলেও তিনি জোর দিয়ে বলেন।
হাজি বদরুদ্দিন বললেন, আমাদের শরীয়া আইনে এটা পরিষ্কার। বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে কেউ যৌন সঙ্গম করলে, সেই নারী বা পুরুষের শাস্তি হবে ১০০ ঘা চাবুক। কিন্তু কোন বিবাহিত মানুষ এই কাজ করলে শাস্তি হবে পাথর ছুঁড়ে মৃত্যু.. চুরির অভিযোগ প্রমাণিত হলে হাত কেটে ফেলার বিধান রয়েছে।
এসব শাস্তি আধুনিক জমানায় অচল বলে যে সমালোচনা রয়েছে তিনি তাকে মেনে নিতে নারাজ। বাচ্চা চুরি করা হচ্ছে, এটা কী ভাল? একজনের হাত কেটে দিয়ে যদি সমাজের স্থিতিশীলতা রক্ষা করা সম্ভব হয়, সেটা কি ভাল না?”
তবে সারা দেশে তালেবানের অগ্রযাত্রা সত্ত্বেও বড় বড় শহরগুলো এখনও আফগান সরকারের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আগামী কয়েক মাসে চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণের জন্য দু’পক্ষ যখন তীব্র লড়াইয়ে নামবে তখন উভয় পক্ষ থেকে সহিংসতা বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।
হাজি হেকমতকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তালেবান কি সামরিক শক্তি দিয়ে বিজয়ী হতে পারবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। শান্তি আলোচনা সফল না হলে আমরাই জিতবো, ইনশা আল্লাহ্। আগে আমরা বাইরের দুশমনকে পরাজিত করেছি, এবার ঘরের দুশমনও পরাজিত হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।