এ যেন রণক্ষেত্র। সড়কজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ইটের টুকরা, লাঠিসোঁটা, গাছের ডাল। সড়কে ইতস্তত পড়ে থাকা জুতা, স্যান্ডেল সাক্ষ্য দিচ্ছে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছেন আন্দোলনকারীরা। তবে একজনকে নড়ানো যায়নি।
সড়কের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দুই হাত প্রসারিত করে বুক পেতে দিলেন পুলিশের গুলির সামনে। পুলিশের ছোড়া অসংখ্য ছররা গুলি বিদ্ধ করল তাঁর দেহ। রক্তক্ষরণে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মৃত্যু হলো ২২ বছরের ওই যুবকের।
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) শিক্ষার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু সাঈদ এভাবেই শহীদ হন।
এর আগের দিন (১৫ জুলাই) কোটা সংস্কার আন্দোলন রূপ নেয় সহিংসতায়। তবে ১৬ জুলাইয়ের আন্দোলন আগের দিনের সহিংস রূপকে ছাড়িয়ে যায়। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে এদিন ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে ছয়জন নিহত হন। আহত হয় এক হাজারেরও বেশি।
তবে রংপুরে শিক্ষার্থী আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনা আন্দোলনে স্ফুলিঙ্গ হয়ে ধরা দেয়। শহীদ আবু সাঈদ নামের এই স্ফুলিঙ্গ দেশজুড়ে ছাত্র-জনতার প্রতিরোধ ও ক্ষোভে দাবানল আকারে ছড়িয়ে পড়ে। এর মাত্র ২০ দিন পর (৫ আগস্ট) পতন হয় তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের।
যা ঘটেছিল সেদিন
পূর্বঘোষিত কর্মসূচির বাইরেও গত বছর ১৬ জুলাই সকাল থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষার্থীরা। দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও ক্ষমতাসীন দলের কর্মী-সমর্থকদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা এদিন সকাল থেকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। ঢাকা, সাভার, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, খুলনা, বরিশাল, বগুড়া, রংপুর ও ময়মনসিংহ—গুরুত্বপূর্ণ এই শহরগুলোতে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করা হয়। ফলে সারা দেশে যোগাযোগব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে।
ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও এদিন মাঠে নামলে বিভিন্ন স্থানে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়। রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব এলাকা পরিণত হয় রণক্ষেত্রে। এখানে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানোর অভিযোগ ওঠে। ঢাকা কলেজের সামনের সড়কে ছাত্রলীগ-যুবলীগের কর্মীদের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে নিহত হন নিউমার্কেট এলাকার হকার মোহাম্মদ শাহজাহান (২৫)। ঢাকা সিটি কলেজ এলাকায় নিহত হন মো. মনির নামের এক যুবক।
এদিন বিকেল পৌনে ৫টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকা থেকে বহিরাগতদের চলে যেতে মাইকে অনুরোধ করলে বিক্ষোভকারীরা ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দিয়ে প্রক্টরিয়াল টিমের ওপর হামলা চালান। এতে সহকারী প্রক্টর অধ্যাপক আবদুল মুহিত আহত হন।
চট্টগ্রামে সংঘর্ষে নিহত হন তিনজন। এর মধ্যে একজন চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষার্থী ও কলেজ শাখা ছাত্রদলের যুগ্ম আহবায়ক ওয়াসিম আকরাম (২৩)। নিহত বাকি দুজন হলেন মো. ফারুক ও ফিরোজ আহমেদ (২৪)।
এদিন দুপুর ২টার দিকে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পার্ক মোড়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এক পর্যায়ে পুলিশও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে জরুরি বিভাগের চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
ছয়জন নিহত ছাড়াও সংঘর্ষে এদিন সারা দেশে শিক্ষার্থীসহ অন্তত ২০ জন গুলিবিদ্ধ হন। আহত হন এক হাজারের বেশি, যাঁদের মধ্যে শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, পথচারী এবং ক্ষমতাসীন দলের সদস্যরাও ছিলেন।
চট্টগ্রাম শহরের মুরাদপুর এলাকায় একটি বহুতল ভবন থেকে ১২-১৫ জন ছাত্রলীগকর্মীকে নিচে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় ছাত্রদল ও শিবির জড়িত বলে অভিযোগ করা হয়।
সারা দেশে দিনভর বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ চলে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের পাশাপাশি কুমিল্লায় পুলিশের গাড়িতে ভাঙচুর, বগুড়ায় বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভাঙচুর এবং আওয়ামী লীগ অফিসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির ফলে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, গাজীপুর, রংপুর ও রাজশাহীতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) মোতায়েন করা হয়।
নিহতদের স্মরণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন পরদিন ১৭ জুলাই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও জেলায় জেলায় গায়েবানা জানাজা ও কফিন মিছিল বের করার আহবান জানায়।
আন্দোলনে যোগ দেয় কলেজ শিক্ষার্থীরাও
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি এদিন দেশের কলেজগুলোর শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনে যোগ দেয়। ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীরা সায়েন্স ল্যাব এবং নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থীরা মতিঝিলে সড়ক অবরোধ করে। এ ছাড়া খুলনাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অবরোধ কর্মসূচিতে কলেজ শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে।
কোটার রায় বাতিল চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের লিভ টু আপিল
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন (লিভ টু আপিল) করেন তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। অ্যাটর্নি জেনারেলের মতে, এটি (কোটা) সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়, তাই আদালতের বিচারের কিছু নেই।
দেড় শতাধিক ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর পদত্যাগ
গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের হল শাখা থেকে এদিন দেশজুড়ে ছাত্রলীগের দেড় শতাধিক নেতাকর্মী পদত্যাগ করেন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা, স্থগিত এইচএসসি পরীক্ষা
শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে এদিন রাতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেশের সব সরকারি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজসহ সব কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ও তাদের অধিভুক্ত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে। সারা দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। স্থগিত করা হয় পরদিনের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।