তরুণ ব্যাংকার মোর্শেদ চৌধুরীর আত্মহত্যার প্রায় দুই সপ্তাহ পরও তাঁর ১২ বছরের মেয়ে মোবাশ্বিরা জাহান চৌধুরী জুম স্বাভাবিক হতে পারেনি। পারার কথাও নয়। এখনো দিনের বেশির ভাগ সময় সে চুপচাপ বসে থাকে; বাবার ছবি আঁকে। আর মাকে বলে রেখেছে, ‘আমাকে যেন কেউ না বলে যে তোমার বাবা নেই। আমার বাবা আছে, আমার সঙ্গেই আছে।’
জুমের মা ইশরাত জাহান চৌধুরী গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওকে আমি কাঁদতে বলি। কেঁদে যদি একটু স্বাভাবিক হতে পারত। কিন্তু জোরে শব্দ করে কেঁদে উঠতে পারে না। সাহরি খেয়ে বিছানায় শোয়ার পর আমাকে খামচে ধরে কাঁপতে থাকে। বাবার মৃত্যু ওকে স্টিফ করে ফেলেছে। আমি নিজে চাইল্ড সাইকোলজি নিয়ে কাজ করেছি। কিন্তু নানা ধরনের চাপে এবং করোনা পরিস্থিতির কারণে ওকে ঠিকমতো কাউন্সেলিং করাতে পারছি না।’
জুম সম্পর্কে তিনি আরো বলেন, ‘ও খুব ভালো স্কেচ আঁকতে পারে। কার্টুন আঁকে। নিজে থেকেই আঁকা শিখেছে।’
ইশরাত জাহান চৌধুরী আরো বলেন, ‘আমাকে বাসাটাও ছাড়তে হচ্ছে। যে বাসায় আছি, সে বাসার ভাড়া মাসে ২৬ হাজার টাকা। এর সঙ্গে অন্যান্য বিল যোগ হয় চার হাজার টাকা। মোর্শেদ গত মাসের ভাড়াটাও দিয়ে যেতে পারেনি। স্কুলে শিক্ষকতা থেকে আমার যে আয়, তাতে এত টাকা বাসাভাড়া দেওয়ার ক্ষমতা নেই। এর সঙ্গে খাওয়া, মেয়ের পড়াশোনার খরচও আছে।’
উল্লেখ্য, প্রভাবশালী একটি চক্রের গোপন ব্যবসার বলি হতে হয় তরুণ ব্যাংক কর্মকর্তা মোর্শেদ চৌধুরীকে। ২৫ কোটি টাকার ঋণের বিপরীতে প্রায় ৩৮ কোটি টাকা পরিশোধ করেও নিষ্কৃতি মেলেনি তাঁর। তাঁকে বেছে নিতে হয়েছে আত্মহননের পথ। ঘটনাটি বন্দরনগরী চট্টগ্রামে এখন প্রধান আলোচনার বিষয়।
অনেকের ধারণা, রাজনৈতিক শক্তিধর একটি চক্র তাদের আয়ের টাকা ব্যাংকার মোর্শেদ চৌধুরীর মাধ্যমে শেয়ারবাজার, কলমানি, খাতুনগঞ্জভিত্তিক ডিও ব্যবসা এবং গার্মেন্টের স্টক লট ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছে। সেই বিনিয়োগের টাকা এবং লাভের টাকা ফেরত নিতেই ‘রাজনৈতিকভাবে অতিরিক্ত চাপ’ দেওয়া হয়। আর অতিরিক্ত চাপ সহ্য করতে না পেরেই মোর্শেদ আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন।
এ বিষয়ে মোর্শেদের স্ত্রী ইশরাত জাহান চৌধুরী বাদী হয়ে পাঁচলাইশ মডেল থানায় একটি মামলা করেন। মামলার এজাহারে মো. পারভেজ ইকবাল, জাভেদ ইকবাল, সৈয়দ সাকিব, নাঈম উদ্দীন, রাসেলসহ অজ্ঞাত আরো ৮-১০ জনকে আসামি করেন। গোয়েন্দা (উত্তর) বিভাগের পরিদর্শক মইনুর রহমানকে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
চট্টগ্রামের বিশিষ্ট নাগরিকরা বলছেন, এই ঘটনার সঙ্গে হুইপপুত্র নাজমুল হক চৌধুরী শারুনের সংশ্লিষ্টতার খবর পাওয়া যাচ্ছে। মামলার বাদী তাঁদের ফ্ল্যাটে হামলা চালানোর সময় শারুনের উপস্থিতির কথা বলেছেন। শারুন র্যাডিসন হোটেলে মোর্শেদকে দেখা করতে চাপ সৃষ্টি করেন এবং টাকা আদায় নিয়ে এক বৈঠকেও তিনি উপস্থিত ছিলেন বলে জানা যাচ্ছে।
মামলায় শারুনের নাম উল্লেখ না করার যুক্তি হিসেবে ইশরাত জাহান চৌধুরী জানিয়েছেন, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী কয়েকজন এ ঘটনায় জড়িত। তাদের নির্দেশেই সব হয়েছে। পুলিশ আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে এজাহারভুক্ত আসামি পারভেজের কাছ থেকে তাদের সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য-প্রমাণ সহজেই পেয়ে যাবে। নিরাপত্তার কথা ভেবে শারুনের নাম এজাহারে উল্লেখ করা হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মোর্শেদ চৌধুরীকে আত্মহত্যায় বাধ্য করার মামলায় এজাহারভুক্ত আসামিরা গাঢাকা দিয়েছে। তারা চট্টগ্রাম ছেড়েছে ৮ এপ্রিল। ওই দিন রাতে পুলিশ তাদের কয়েকজনের বাসায় অভিযান চালায়। পুলিশ আসবে, এমন সংবাদ পেয়েই তারা পালিয়ে যায়। রাত ১১টার দিকে আসামি পারভেজ ইকবালের বাসায় পৌঁছে পুলিশ দেখতে পায়, তাঁর খাবার টেবিলে থালা পড়ে আছে। মগের কফিও শেষ হয়নি। পুলিশের ধারণা, রাতের খাবার খাওয়ার সময়ই পারভেজ পুলিশ আসার খবর টের পেয়ে বাসা ছাড়েন। ধারণা করা হচ্ছে, আসামিরা ঢাকায় বা অন্য কোথাও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের সহযোগিতায় গাঢাকা দিয়ে আছে।
সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, চট্টগ্রামের আন্দরকেল্লায় আসামিদের একটি টর্চার সেল ছিল। সেখানে ব্যাংকার মোর্শেদকেও নিয়ে গিয়েছিল তারা। যাঁর স্থাপনায় ওই টর্চার সেলটির অবস্থান, তিনিও গাঢাকা দিয়েছেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গোয়েন্দা (উত্তর) বিভাগের পরিদর্শক মইনুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তদন্ত চলছে। আসামিদের গ্রেপ্তার করার জন্য অভিযানও অব্যাহত রয়েছে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।