সময় এগিয়ে নিয়ে এলেও যে কারণে আম পাড়ছেন না চাষিরা
জুমবাংলা ডেস্ক : গেল পাঁচ বছর থেকে রাজশাহীতে আম পাড়ার সময়সীমা বেঁধে দিচ্ছে রাজশাহী জেলা প্রশাসন। গাছে থেকে পরিপক্ব হওয়ার পরই যেন কেবল নিরাপদ এই আম ভোক্তাদের কাছে যায় সেটাই ছিল লক্ষ্য।
সেই হিসেবে গেল বছরও আম পাড়া শুরু হয় ১৩ মে। চলে ২০ আগস্ট পর্যন্ত।
এ বছরও ২০ আগস্ট পর্যন্ত আম পাড়ার সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তবে ১১ দিন আগেই আম পাড়া শুরু হয়ে গেছে। আর হুট করে আম পাড়ার এই সময় এগিয়ে নিয়ে আসাতেই দেখা দিয়েছে বিপত্তি। গুটি আম পাড়ার দুই দিন সময় অতিবাহিত হচ্ছে। কিন্তু রাজশাহীর বাজারে আম নেই!
চাষিরা বলছেন- আগাম জাতের কিছু আমের পরিপক্বতা আসলেও বেশিরভাগ আমই এখনও অপরিপক্ব। পরিপক্বতা বলতে তারা আমের ভেতর আঁটি হওয়াকে বুঝিয়ে থাকেন। কারণ আঁটি হওয়ার আগেই গাছ থেকে আম নামালে তা প্রাকৃতিক বা স্বাভাবিক নিয়মে পাকে না। তাকে বিভিন্ন কেমিক্যাল দিয়ে পাকাতে হয়। আর অসদুপায়ের পাকানো ওই আম কাটার পর দেখা যায় আঁটি ধবধবে সাদা এবং কাঁচা!
তাই তারা পরিপক্বতা না আসা পর্যন্ত গাছ থেকে এখন কোনো আমই নামাতে চান না। আর এরই মধ্যে ‘ম্যাংগো ক্যালেন্ডার’ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই ৪ মে থেকে গুটি (চোষা আম) জাতের আম নামানোর কথা থাকলেও অধিকাংশ কৃষক এখন অপেক্ষা করছেন। কারণ গুটি আমের পরিপক্বতা আসতে কম করে হলেও আরও ১০/১২ দিন সময় লাগবে।
আমচাষিদের অভিযোগ, এবার আম পাড়ার সময় নির্ধারণ করতে গিয়ে অনেকটাই তড়িঘড়ি করে ফেলেছে জেলা প্রশাসন৷ কারণ এখনও বেশিরভাগ বাগানেই আম পাকেনি। আর এসব বাগান পর্যবেক্ষণ না করেই বা চাষিদের সঙ্গে না বসেই আম পাড়ার তারিখ ঘোষণা করে দেওয়া হয়েছে।
যে কারণে আনুষ্ঠানিকভাবে মৌসুম শুরু হলেও এখন গাছেই শোভা পাচ্ছে রাজশাহীর আম। আর হাট-বাজারের ঝুড়ি এখনও রয়েছে ফাঁকা। অনেক মানুষ আম কিনতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত খালি হাতেই বাড়ি ফিরছেন।
তাই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আম পাড়ার বেঁধে দেওয়া সময় নিয়ে কিছুটা বিভ্রান্তিতে পড়েছেন ক্রেতা ও বিক্রেতারা। তবে জেলা প্রশাসন বলছে- একাধিক বাগানের আমে পাক ধরেছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরামর্শ ছিল এসব বাগানের চাষিরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন। আর সেজন্যই সমন্বয় সভা করে আম পাড়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া হয়েছে।
শুক্রবার (৫ মে) সাপ্তাহিক ছুটির দিনে রাজশাহীর পুঠিয়ার বানেশ্বর হাটে কথা হয় ভাল্লুকগাছি গ্রামের জয়নাল হোসেনের সঙ্গে।
তিনি বলেন, আগাম জাতের কিছু গুটি আম প্রথম দিন গাছ থেকে পাড়া হয়েছে। তবে পরিমাণে খুবই কম। টকমিষ্টি স্বাদের এই আমগাছগুলো বেশিরভাগই নতুন লাগানো। পুরোনো গাছের গুটি আম পরিপক্ব হয়নি এখনও৷ একই অবস্থা গোপালভোগ ও খিরশাপাতসহ (হিম সাগর) অন্যান্য নামীদামি জাতের আমগুলোরও। এগুলো আম কেটে দেখা গেছে কেবলই আঁটি হয়েছে। তাই এগুলো দিয়ে এখনও আচার বা মোরব্বাও হবে না। কারণ এগুলো বানাতেও পরিপক্বতা লাগে।
এদিকে আমের জগতে সুপরিচিত মুখ রাজশাহী-চাঁপাই এগ্রো ফুড প্রোডিউসারের প্রতিষ্ঠাতা আনোয়ারুল হক বলেন, প্রথম দিন সাংবাদিকদের অনুরোধে ম্যাংগো ক্যালেন্ডার মেনে কিছু গুটি আম পেড়েছিলেন। কিন্তু পরে কেটে দেখা গেছে এসব আম এখনও পরিপক্ব হয়নি। এর জন্য আরও কমপক্ষে ১০/১২ দিন অপেক্ষা করতে হবে। অথচ সময় নির্ধারণের পর অনেকেই কিছু কিছু করে আম নামিয়ে ফেলেছেন। এতে একটা বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। অনেকেই বুঝতে পারছেন না কী করবেন।
আনোয়ারুল হক জানান, তিনি রাজশাহী এগ্রো ফুড প্রোডিউসার সোসাইটি’র আহ্বায়ক। তার নিজস্ব ৫০ বিঘা জমিতে আম বাগান রয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন থেকেই বিভিন্ন জাতের আম চাষ করেন। তার ফ্রুট ব্যাগিং করা সুস্বাদু আম বিদেশেও যায়। আগে তাদের সঙ্গে বৈঠক করে ম্যাংগো ক্যালেন্ডার করা হতো। তারা বাগানের প্রকৃত অবস্থা অনুযায়ী মতামত দিতেন। কিন্তু এবার তারা ডাক পাননি জেলা প্রশাসনের ওই সভায়। সেখানে কৃষি কর্মকর্তারা কয়েকজন চাষির মতামতের ওপর ভিত্তি করেই আম পাড়ার দিনক্ষণ ঠিক করে দিয়েছেন। তবে আর কয়েকটা দিন থামলে আরও ভালো হতো।
রাজশাহী ফল গবেষণাকেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুল ইসলাম জানান, এ বছর টানা তাপপ্রবাহ বয়ে গেলেও আমের ফলনের ব্যাপারে আমরা আশাবাদী। বেশিরভাগ গাছেই আম ধরেছে এবং এখনও আছে। তবে বৃষ্টি কম হওয়ায় মাটিতে রস ছিল না। তাই মাটি থেকে গাছ খাবারের জোগান কম পেয়েছে। আর এজন্য রাজশাহীর আমের আকার গতবারের চেয়ে এবার কিছুটা ছোট হয়েছে। আর বেশিরভাগ বাগানের আম এখনও পরিপক্ব হয়নি। তাই কৃষকরা হাতে একটু সময় নিয়েই আম নামাতে চান।
এটি ভালো দিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে তো কী হয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় যার যার সুবিধা মতো আম নামালেই হলো। আর রাজশাহীর আগাম জাতের কিছু আম আগে নামবে এটাই তো স্বাভাবিক। প্রতিবছরই এমন হয়ে থাকে।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মোজদার হোসেন বলেন, বুধবার ( ৩ মে) রাজশাহী জেলা প্রশাসকের সভা কক্ষে এই ব্যাপারে সমন্বয় সভা হয়েছে। সেখানে উপস্থিত চাষি ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন চারঘাট ও বাঘার কিছু কিছু বাগানে আম পরিপক্ব হয়ে উঠেছে। এগুলো নামানো যেতে পারে। তাই আলোচনা শেষে কেবল গুটি জাতের আম নামানোর জন্য ৪ মে তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। ভালো মানের ও জাতের আমগুলো ১৫ মে থেকেই পর্যায়ক্রমে নামবে। এতে সমস্যা কোথায়? তারা এই তারিখ নির্ধারণের ব্যাপারে চেষ্টা করেছেন একজন কৃষকও যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হন। সময় দেওয়া হয়েছে, এখন যার আম যখন পরিপক্ব হবে স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও কৃষি কর্মকর্তাকে অবহিত করে তারা তখন সেই আম নামাবেন।
সেই নির্দেশনা ওই সভায়ও বলে দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন।
একই কথা বলেন রাজশাহী জেলা প্রশাসক মো. শামীম আহমেদ। তিনি বলেন, কৃষক ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাদের পরামর্শেই জেলা প্রশাসন আম পাড়ার সময় বেঁধে দিয়েছে। তবে এও বলা হয়েছে- পরিপক্ব হলেই কেবল গাছ থেকে আম নামানো যাবে। তাই আবহাওয়ার তারতম্য অনুযায়ী যার আম যখন পরিপক্ব হবে তিনি তখন আম পাড়তে পারবেন। ক্ষেত্র বিশেষ আগে পরিপক্ক হলে উপজেলা প্রশাসনকে জানিয়ে নামাতে পারবেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।