জুমবাংলা ডেস্ক : বাংলাদেশ ২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে যাবে! তারপর গ্রেস পিরিয়ড হিসেবে পাওয়া যাবে আরও তিন বছর। কিন্তু দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির অস্থিরতা, অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ থাকায় স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের জন্য এটা উপযুক্ত সময় নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ প্রতিদিনের করা প্রতিবেদনটি হুবহু তুলে ধরা হলো-
তাদের মতে, বর্তমানে ডলারের উচ্চ মূল্য ও সংকট, রপ্তানি খাতের সীমাবদ্ধতা, বিদ্যুৎ-জ্বালানির সংকট ও অভ্যন্তরীণ কৃষি খাতের প্রতিবন্ধকতা, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগে স্থবিরতা, আর্থিক খাতের অস্থিরতা, অনিয়ম, দুর্নীতি কমাতে চলমান সংস্কার কর্মসূচি বিবেচনায় নিয়ে এলডিসি থেকে উত্তরণের সময়সীমা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় চলতি বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে নতুন সরকার দায়িত্বে আসবে আগামী বছরের শুরুতেই। সে ক্ষেত্রে মাত্র ১০ বা ১১ মাসের মধ্যে এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটবে বাংলাদেশের। যা সে সরকারের জন্য নতুন একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবেও সামনে থাকবে। তবে এটা চ্যালেঞ্জ হলেও অসম্ভব হবে বলে মনে করেন না অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য অনেক আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে আসছে বাংলাদেশ। তবুও আমরা এখন প্রস্তুত নই বলে ব্যবসায়ীদের দাবি।
এভাবে সময় পিছিয়ে নিলে আমরা পৃথিবী থেকেই পিছিয়ে পড়ব বলে মনে করেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। এজন্য ব্যবসায়ীদেরকে এলডিসি উত্তরণের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিতে বলেছেন। গতকাল তিনি ইআরএফের এক অনুষ্ঠানে বলেন, আমার মতে এলডিসি উত্তরণের জন্য আর সময় নেওয়া উচিত হবে না।
এদিকে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, এলডিসি তালিকা থেকে গ্র্যাজুয়েশনের পর বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার খরচ বেড়ে যাবে। ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের ক্ষেত্রে আমরা গ্রেস পিরিয়ড পাই বা কম সুদ ধরা হয়। গ্র্যাজুয়েট হয়ে গেলে গ্রেস পিরিয়ড কমে যাবে। একই সঙ্গে কম্পিটিটিভ ইন্টারেস্ট রেট পেমেন্ট করতে হবে। ফলে আমাদের খরচ বেড়ে যাবে। বিষয়টি নিয়ে আমাদের আগে থেকেই চিন্তাভাবনা করা উচিত।
তিনি বলেন, বিগত ১৬ বছরের মতো যদি এখনো ঋণ দিয়ে দুর্নীতি এবং অপচয় করতে থাকি, তাহলে বৈদেশিক ঋণ রিপেমেন্ট নিয়ে আমাদের সমস্যায় পড়তে হতে পারে। ঋণ নেওয়ার সময়ই সেটার ব্যবহার ও রিটার্ন সম্পর্কে আমাদের পরিষ্কার ধারণা রাখতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে ঋণ ব্যবস্থাপনা ভালো না হলে আমরা ঋণের ফাঁদে পড়তে পারি।
সূত্র জানায়, নিয়ম অনুযায়ী এলডিসি উত্তরণের পর থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাবে ইউরোপের বাজারের বিদ্যমান শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা। এতে করে সে সব দেশের বাজারে বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে গুনতে হবে অতিরিক্ত শুল্ক। যা দেশের রপ্তানি খাতকে আরও চ্যালেঞ্জের মধ্যে ফেলে দেবে। বর্তমানে ক্ষেত্রবিশেষে রপ্তানিকারকদের সরকারের পক্ষ থেকে নগদ সহায়তা দেওয়া হয়। যা দেশের রপ্তানিকারকদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহযোগীর ভূমিকা রাখে। সেটাও বন্ধ হয়ে যাবে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর। বেড়ে যাবে বৈদেশিক ঋণের সুদ। এতে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে আরও চাপ বাড়বে। কেননা এ খাতে ব্যয়ের পরিমাণ বেড়ে যাবে। একই সঙ্গে কমে যাবে বৈদেশিক অনুদান। কৃষি, পাট ও চামড়াজাত পণ্যেও রপ্তানির বাজারে বাড়বে চ্যালেঞ্জ। বেড়ে যাবে জাতিসংঘের চাঁদার পরিমাণও। বাংলাদেশের সামগ্রিকভাবে খরচ বাড়বে বৈশ্বিক ব্যবস্থায় নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখতে। বৈশ্বিক ক্ষেত্রে ব্যবসা-বাণিজ্যের চ্যালেঞ্জ আরও বাড়বে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
এদিকে বিগত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক খাতের প্রবৃদ্ধির প্রচার ছিল অনেকটাই ফাঁপানো। যার সঙ্গে বাস্তবতার সঙ্গে মিল নেই। রপ্তানি আয়ও দেখানো হতো অনেক ক্ষেত্রে ভুয়া। উৎপাদন, প্রবৃদ্ধি ও আয় কোনো ক্ষেত্রেই পরিসংখ্যানের যথার্থতা প্রমাণ করা যায়নি। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে উচ্চ বেকারত্বই তার বড় প্রমাণ। কাগজপত্রে প্রবৃদ্ধি হলেও সুফল পৌঁছেনি সাধারণ মানুষের কাছে। এসব পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে এই মুুহূর্তে এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটালে আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জটা আরও বাড়বে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকনোমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, এটার জন্য আমরা হয়তো আরও কিছুটা সময় নিতে পারি। তবে খুব বেশি পেছানোটাও আবার ঠিক হবে না।
জানা গেছে, জাতিসংঘের তালিকা অনুযায়ী, স্বল্পোন্নত দেশ হলেও বাংলাদেশ এক ধরনের উন্নয়নশীল দেশ। বর্তমানে বিশ্বে ৪৪টি স্বল্পোন্নত দেশ রয়েছে। দেশগুলো হলো- বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, অ্যাঙ্গোলা, বেনিন, বুরকিনা ফাসো, বুরুন্ডি, কম্বোডিয়া, সেন্ট্রাল আফ্রিকা, চাদ, কমরোস, কঙ্গো, জিবুতি, ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, গাম্বিয়া, গিনি, গিনি বিসাউ, হাইতি, কিরিবাতি, লাওস, লেসেতে, লাইবেরিয়া, মাদাগাস্কার, মালাউ, মালি, মৌরিতানিয়া, মোজাম্বিক, মিয়ানমার, নেপাল, নাইজার, রুয়ান্ডা, সেনেগাল, সিয়েরা লিওন, সলোমন দ্বীপপুঞ্জ, সোমালিয়া, দক্ষিণ সুদান, সুদান, পূর্ব-তিমুর, টোগো, টুভালু, উগান্ডা, তানজানিয়া, ইয়েমেন ও জাম্বিয়া। এলডিসি থেকে কোন দেশ বের হবে, সে বিষয়ে সুপারিশ করে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)।
এজন্য প্রতি তিন বছর পরপর এলডিসিগুলোর ত্রিবার্ষিক মূল্যায়ন করা হয়। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ, জলবায়ু ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা- এই তিন সূচক দিয়ে একটি দেশ উন্নয়নশীল দেশ হতে পারবে কি না, সেই যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়। যে কোনো দুটি সূচকে যোগ্যতা অর্জন করতে হয় কিংবা মাথাপিছু আয় নির্দিষ্ট সীমার দ্বিগুণ করতে হয়। এই মানদণ্ড সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হয়। বাংলাদেশ ২০১৮ ও ২০২১ সালের ত্রিবার্ষিক মানদণ্ডের তিনটিতেই উত্তীর্ণ হয়। ২০২১ সালেই বাংলাদেশ চূড়ান্ত সুপারিশ পায় যে, ২০২৪ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ হতে পারে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ ছাড়াও ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের তালিকায় আরও দুটি দেশ লাওস ও নেপাল আছে। এ পর্যন্ত গত পাঁচ দশকে সব মিলিয়ে মাত্র আটটি দেশ এলডিসি থেকে বের হয়েছে। দেশগুলো হলো- ভুটান, বতসোয়ানা, কেপ ভার্দে, ইকুইটোরিয়াল গিনি, মালদ্বীপ, সামোয়া, ভানুয়াতু, সাও টোমো অ্যান্ড প্রিন্সেপ।
‘রেমিট্যান্সে করমুক্ত সুবিধার সুযোগে ৭৩০ কোটি টাকা দেশে এনেছেন এক ব্যক্তি’
বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণের জন্য আরও কিছুদিন সময় নেওয়া উচিত বলে মনে করেন ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আবুল কাসেম খান। তিনি বলেন, বাস্তবতার নিরিখে বিবেচনা করলে আমরা আমাদের যা উন্নতি বা উন্নয়ন হয়েছে তার বেশির ভাগই টেকসই নয়। ফলে টেকসই ও মজবুত অর্থনীতির জন্য আমাদের আরও কিছুটা সময় নেওয়া উচিত।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।