শরাফত হোসেন : দিন যায়। মাস পেরিয়ে যায়। কেটে যায় বছরের পর বছর। কিন্তু আসে না সুখের সময়। আক্ষেপের আগুনে পুড়তে পুড়তে একটা সময় ক্লান্তি চলে আসে। আশার বাতিটাও নিভিয়ে ফেলেন অনেকে। সব যেন ছন্নছাড়া।
অথচ কী নেই। বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় দলে। অন্য খেলোয়াড়রাও নিজ নিজ ক্লাবে এক-একজন বিশাল চরিত্র। তাতে আর্জেন্টাইন সমর্থকদের মুখে হাসি ফোটে না। একটি বিশ্বকাপের আশায় চাতকপাখির মতো তাকিয়ে থাকে তারা। অবশেষে এক নাবিকের হাত ধরে পথে ফেরে আর্জেন্টিনা। দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে আর্জেন্টিনায় আসে ট্রফি।
বিশ্বকাপ নয়, কোপা আমেরিকার শিরোপা। তাও কী বুনো উল্লাস। ২৮ বছর পর প্রথমবার শিরোপা ছুঁয়ে দেখার আনন্দ বিশ্বকাপ জয়ের চেয়ে কম কীসে! ওই নাবিকের আঁকানো নকশায় চলে বিশ্বকাপটাও এসে যায় আর্জেন্টিনায়। ১৯৮৬ সালের পর প্রথমবার। ২০২২ সালে কাতারে গিয়ে অপেক্ষায় শেষ হয় লাতিন দেশটির।
কী ভাবছেন, ‘নাবিক’ বলতে লিওনেল মেসির কথা বলা হচ্ছে? ভুল ভাবছেন। মেসি তো সেই ২০০৫ সাল থেকেই আর্জেন্টিনার জার্সিতে। ২০২১ সালের কোপার আগে কখনো আর্জেন্টিনার হয়ে কিছু জিততে পারেননি তিনি। অর্থাৎ, আর্জেন্টিনায় অনেক ভালো মানের খেলোয়াড় এসেছেন-গিয়েছেন, কিন্তু সঠিক দিক-নির্দেশনায় পাওয়া হয়নি সাফল্য। এখানে ‘নাবিক’ তাই লিওনেল স্কালোনি। যার ক্ষুরধার মস্তিষ্কে কোপা আমেরিকার জেতার পর আসে ফিনালিসিমা (ইউরো-কোপা আমেরিকা চ্যাম্পিয়নদের লড়াই) শিরোপা। আর সব প্রাপ্তি পূর্ণতা পায় বিশ্বকাপ জিতে।
আর্জেন্টিনা হয় সুখী পরিবার। অনেক দিন পরপর মেসি-আনহেল দি মারিয়া-রোদ্রিগো দি পলরা একসঙ্গে জাতীয় দলে মিলিত হলেও তাদের দেখে সেটা বোঝার উপায় নেই। প্রতিদিনই যেন তাদের সাক্ষাৎ হয়! স্কালোনির আর্জেন্টিনা দলের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো- একটা টিম হয়ে খেলা। একে অন্যের সম্পর্কের গভীরতা বোঝা যায় মাঠে তাদের বোঝাপড়ায়।
সাজানো-গোছানো সুখের এই সংসারে হঠাৎ ভাঙনের সুর। যিনি একসুতোয় বেঁধেছেন দলকে, যার ছোঁয়ায় সাফল্য পায়ে লুটিয়ে পড়ছে আর্জেন্টিনার, সেই স্কালোনি নাকি ছেড়ে দিচ্ছেন কোচের পদ!
দিনকয়েক আগে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলকে ১-০ গোলে হারিয়েছে আর্জেন্টিনা। মারাকানার ঘটনাবহুল ম্যাচ জেতার পর হঠাৎই চমকে যাওয়ার মতো কথা বলেন স্কালোনি। ইঙ্গিত দিয়েছেন, আর্জেন্টিনার কোচের পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর।
সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘আমার এখানেই বল থামিয়ে দিয়ে ভাবা প্রয়োজন। এটা আসলে বিদায় বা অন্য কিছু নয়। কিন্তু আমাকে ভাবতে হবে। কারণ প্রত্যাশার পারদ অনেক উঁচুতে। আসলে এই খেলোয়াড়েরা আমার কাজটা কঠিন করে তুলেছে।’
তাহলে কি অতিমাত্রার প্রত্যাশা চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে স্কালোনির জন্য? তার হাত ধরেই যেহেতু ৩৬ বছর পর বিশ্বকাপ জিতেছে আর্জেন্টিনা। এখানে কয়েকটি প্রশ্ন এসে যায়। ব্রাজিলের ম্যাচ শেষেই কেন এমন ইঙ্গিত দেবেন তিনি? কেনই-বা ২০২৬ বিশ্বকাপ পর্যন্ত চুক্তি করবেন আর্জেন্টিনার সঙ্গে? তাহলে কি খেলোয়াড়দের সঙ্গে কিছু হয়েছে?
প্রথমে খেলোয়াড়দের প্রসঙ্গে আসা যাক। যেহেতু তিনি ‘খেলোয়াড়েরা আমার কাজটা কঠিন করে তুলেছে’- এমন মন্তব্য করেছেন। আর্জেন্টিনার জনপ্রিয় দুই সংবাদমাধ্যম ‘ওলে’ ও ‘টিওয়াইসি স্পোর্তস’- এর খবর, খেলোয়াড়দের সঙ্গে সম্পর্কের কোনো অবনতি হয়নি স্কালোনির। বরং স্কালোনির সরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিতে হতবাক হয়েছেন আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়রা।
তাহলে বিশ্বকাপ জয়ী কোচ সরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত কেন দিলেন? এজন্য একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। কাতার বিশ্বকাপ পর্যন্ত ছিল স্কালোনির আগের চুক্তি। মধ্যপ্রাচ্যের দেশটিতে আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপ জিতলো। স্বাভাবিকভাবেই স্কালোনির সঙ্গে চুক্তি বাড়ানোর পথে হাঁটলো আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (এএফএ)। কিন্তু চুক্তি আর হয় না। দিন চলে যায়, মাসও পেরিয়ে যায়, কিন্তু স্কালোনির চুক্তি নবায়ন হয় না।
ওই সময় আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যমের খবর ছিলো, এএফএ’র সঙ্গে ‘শর্ত’ পূরণ না হওয়ায় স্কালোনি চুক্তিতে স্বাক্ষর করছেন না। কী ছিল সেই ‘শর্ত’? যেটি আসলে অনেক বছর ধরে আর্জেন্টিনা ফুটবলের বড় সমস্যা হয়ে আছে। এএফএ’র কাছ থেকে সময়মতো লজিস্টিক সাপোর্ট না পাওয়া। কোচিং স্টাফদের ব্যাপারে বোর্ডের উদাসীনতাও একটা সমস্যা। এই বিষয়গুলো ‘ঠিক করে’ তবেই নাকি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছিলেন স্কালোনি।
কিন্তু নতুন চুক্তিতেও সেই ঝামেলা কাটেনি। ‘ওলে’ ও ‘টিওয়াইসি স্পোর্তস’-এর খবর, লজিস্টিক সাপোর্ট নিয়েই মূল ঝামেলা। এএফএ সভাপতি ক্লাউদিও তাপিয়ার সঙ্গে একাধিকবার এ বিষয়ে কথা বলেও কোনো সমাধান পাননি স্কালোনি।
জাতীয় দলের খেলা আন্তর্জাতিক ফুটবল বিরতিতে হয়। ওই সময় খেলোয়াড়রা যে যার ক্লাব থেকে জাতীয় দলের ক্যাম্পে আসেন। ওই মুহূর্তেই টনক নড়ে এএফএ’র। অল্প সময়ের মধ্যে সব সরবরাহ করতে গিয়ে বিলম্বের মুখে পড়তে হয়। যাতে প্রভাব পড়ে অনুশীলনে। ম্যাচের আগেও পোহাতে হয় ঝামেলা। সরঞ্জামাদি পৌঁছাতে বা পেতে বারবার অপেক্ষায় থাকতে হয়।
নতুন চুক্তির আগে এই বিষয়গুলো ‘ক্লিয়ার’ করেও লাভ হয়নি স্কালোনির। তাই আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের সঙ্গে আর থাকতে চাইছেন না বলে খবর দেশটির সংবাদমাধ্যমের।
আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশনে সমস্যার জাল ছড়ানো আগে থেকেই। তারপরও বিশ্বকাপ জেতার পণ করে একসঙ্গে লড়াই চালিয়ে গেছেন খেলোয়াড় থেকে শুরু করে কোচিং স্টাফেরা। কিন্তু ঝামেলার জায়গাগুলো থেকেই গেছে। এই যেমন বিশ্বকাপ জেতার প্রাইজমানির টাকা পেতে লম্বা সময় অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে খেলোয়াড়-কোচদের। তার মানে কি তাপিয়ার সঙ্গে মেসি কিংবা স্কালোনির মুখের হাসি শুধুই লোক দেখানো?
সে যাই হোক, আর্জেন্টিনার সংসারে এখন সুখ নেই। বাজছে ভাঙনের সুর!-ইত্তেফাক
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।