মহাবিশ্বকে এককথায় আমরা জানি বিশাল, বিপুল। সেটা আসলে আমাদের ধারণার চেয়েও বিশাল। এই বিশালতার মাত্রা বোঝাতে গেলে হিমশিম খাবেন যে কেউ, বাদ যাবেন না বিজ্ঞানীরাও। মহাবিশ্ব বা মহাকাশের বিশালতা বোঝাতে কিছু সংখ্যা ব্যবহার করা হয়। এর প্রতিটি ক্ষেত্রে যেসব সংখ্যা জড়িত, সেগুলোর মানও অনেক বড়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে এসব সংখ্যার তুলনা করলে আকাশ-পাতাল শব্দ ব্যবহার করাও সম্ভবত ন্যায্য হবে না। তাই সংখ্যাগুলো আসলে কী বোঝায় বা কতটা বড় বোঝায়, তা অনেক সময় মাথায় ঢুকতে চায় না।
সেটা সঠিকভাবে বোঝার জন্য শুরুতেই মহাকাশবিজ্ঞানের সঙ্গে জড়িত কিছু সংখ্যার মর্ম উপলব্ধি করা দরকার। কোনো কিছুকে অনেক বেশি বোঝাতে আমরা সাধারণত লাখ, কোটি, মিলিয়ন বা বিলিয়ন শব্দগুলো প্রয়োগ করি। কিন্তু এসব শব্দের প্রতিটি একেবারেই আলাদা। যেমন মিলিয়ন সংখ্যাটার কথা বলা যাক। ১০ লাখে হয় ১ মিলিয়ন। মহাকাশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মিলিয়ন শব্দের ব্যবহার দেখা যায়।
যেমন এক মিলিয়ন সেকেন্ড, কিন্তু এতে কী বোঝায়? সেই সময় আসলে কতটুকু? জেনে হয়তো অবাক হবেন, ১ মিলিয়ন সেকেন্ড মানে সাড়ে ১১ দিন। আর ১০০ কোটি বা ১ বিলিয়ন সেকেন্ডে? মাত্র ৩১ বছর। আরও ভালোভাবে বললে, আপনার বয়স যেদিন ৩১ বছর, ৭ মাস, ৯ ঘণ্টা, ৪ মিনিট, ২০ সেকেন্ড পূর্ণ হবে, সেদিন জীবনের ১ বিলিয়ন সেকেন্ড পার করবেন আপনি। অন্যদিকে ১ লাখ কোটি বা ১ ট্রিলিয়ন সেকেন্ডে হবে প্রায় ৩২ হাজার বছর। এক ট্রিলিয়ন সেকেন্ড আগে গুহাবাসী মানুষেরা গুহার দেয়ালে ছবি এঁকেছিল। সেসব ছবি দেখে এখনো বিস্মিত হয় আধুনিক মানুষেরাও।
ট্রিলিয়ন শব্দটা উচ্চারণ করতে এক সেকেন্ডের কম সময় লাগলেও এক ট্রিলিয়ন সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে মুখে মুখে গণনা করা সহজ কাজ নয়। প্রতি সেকেন্ডে যদি একটা সংখ্যা গোনেন, তাহলে সেটা করতে লাগবে প্রায় ৩২ হাজার বছর। কাজেই একা একা বাসায় বসে কাজটা না করাই ভালো। এরপর আমরা যেসব সংখ্যা ব্যবহার করব, সেখানে এই তফাতটুকু মনে রাখার চেষ্টা করবেন।
শুরু করা যাক, সূর্য থেকে পৃথিবীর দূরত্ব দিয়ে। সৌরজগতের এই দুটি বস্তুর মধ্যবর্তী দূরত্ব প্রায় ১৫০ মিলিয়ন কিলোমিটার (৯৩ মিলিয়ন মাইল)। ধরা যাক, একদিন সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে সিদ্ধান্ত নিলেন পৃথিবী থেকে সূর্যে পাড়ি দেবেন। সে জন্য ব্যবহার করবেন এখন পর্যন্ত মনুষ্যনির্মিত তৈরি সবচেয়ে দ্রুতগতির বিমান।
তেমন একটা বিমানের নাম লকহিড এসআর-৭১ ব্ল্যাকবার্ড। মার্কিন এই যুদ্ধবিমান সেকেন্ডে প্রায় এক কিলোমিটার (০ দশমিক ৬ মাইল) পাড়ি দিতে পারে। এর গতি শব্দের চেয়েও পাঁচ গুণ বেশি, এমনকি বুলেটের চেয়েও বেশি বেগে ছোটে। এই গতিতে ছুটলে ঢাকা থেকে কক্সবাজারে পৌঁছাতে পারবেন মাত্র পাঁচ মিনিটে। আর ঢাকা থেকে লন্ডনে পৌঁছানো যাবে মাত্র সোয়া দুই ঘণ্টায়।
এবার কল্পনা করা যাক, একদিন লকহিড বিমানে চড়ে সূর্যে পাড়ি দিতে শুরু করলেন (বাস্তবে যদিও তা অসম্ভব)। দ্রুতগতিতে বিমানটি সরলরেখা বরাবর চলতে থাকলে সৌরজগতের কেন্দ্রে মানে সূর্যে পৌঁছাতে লাগবে প্রায় পাঁচ বছর।
পৃথিবী প্রতি মুহূর্তে সূর্যের চারপাশের কক্ষপথ ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। মজার ব্যাপার হলো, তার গতি লকহিড বিমানের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি। কিন্তু সেই বিপুল গতির কিছুই টের পাচ্ছি না আমরা পৃথিবীর বাসিন্দারা। এভাবে পৃথিবী প্রতিদিন প্রায় ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়।
সেই হিসাবে মহাকাশের ভেতর দিয়ে বুলেটের চেয়েও প্রায় ৫০ গুণ বেশি গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন আপনি। ভাবা যায়! গতিটা এতই বেশি যে এই গতিতে মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছাতে সময় লাগবে এক সেকেন্ডের তিন ভাগের এক ভাগ। অথচ এত বেশি গতিতে চলেও সূর্যের চারপাশে এক পাক ঘুরে আসতে পৃথিবীর সময় লাগে পুরো ১ বছর বা ৩৬৫ দিন। তাহলে পৃথিবীর কক্ষপথটা কত বড়, সেটা কিছুটা আন্দাজ করতে পারছেন?
আমাদের সূর্যও কিন্তু নিছক ছোটখাটো কোনো অগ্নিগোলক নয়, তার আকৃতিও বিশাল। সেটা এতই বড় যে তার ভেতর ১০ লাখ পৃথিবী অনায়াসে আটানো সম্ভব। তার ভরও নেহাত কম নয়। সেই ভরের কারণে সৌরজগতের সব গ্রহসহ অন্যান্য বস্তুকে ধরে রাখতে পেরেছে। বুধ থেকে শুরু করে ১৫ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার দূরের সর্বশেষ গ্রহ নেপচুনকে মহাকর্ষ বলে আটকে রেখেছে সূর্য। এই ফাঁকে বলে রাখি, নেপচুন পর্যন্ত এই দূরত্ব পাড়ি দিতে লকহিড বিমানের লাগবে প্রায় ১৪২ বছর। তবে সূর্যের আধিপত্য কিন্তু নেপচুন পর্যন্তই সীমাবদ্ধ নয়।
নেপচুন ছাড়িয়ে আরও দূরে রয়েছে ওর্ট ক্লাউড। একে বলা হয় সৌরজগতের সবচেয়ে বড় আর সবচেয়ে দূরবর্তী কাঠামো। এই এলাকা বরফ আর পাথরে পরিপূর্ণ, যারা বৃত্তাকারে সূর্যকে ঘিরে রেখেছে। এর ব্যাসার্ধ প্রায় ১৫ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার। পৃথিবী থেকে একটা আলোক রশ্মি যদি ছুড়ে দেওয়া হয়, তাহলে সেটা (আলোর গতিতে) ওর্ট ক্লাউডে পৌঁছাতে লাগবে প্রায় দেড় বছর। তাহলে লকহিড বিমানের কত সময় লাগবে? কাগজ-কলম নিয়ে হিসাব কষার দরকার নেই, আমিই বলে দিচ্ছি। ৪ লাখ ৭৫ হাজার বছর। মনে রাখবেন, বিজ্ঞানীদের হিসাবে পৃথিবীতে মানুষের আবির্ভাব হয়েছে মাত্র তিন লাখ বছর আগে।
এবার সৌরজগৎ ছেড়ে প্রতিবেশী নক্ষত্রের দিকে নজর দেওয়া যাক। সূর্যের পর আমাদের সবচেয়ে কাছের নক্ষত্রের নাম আলফা সেন্টোরি ক্লাস্টার, যেখানে তিনটি সৌরব্যবস্থা রয়েছে। সেগুলো হলো প্রক্সিমা সেন্টোরি, আলফা সেন্টোরি এ এবং আলফা সেন্টোরি বি। তাদের দূরত্ব আমাদের কাছ থেকে ওর্ট ক্লাউডের প্রায় চার গুণ। সেখান থেকে পৃথিবীতে আলো এসে পৌঁছাতে সময় নেয় প্রায় চার বছর।
এ ধরনের দূরত্ব পরিমাপে কিলোমিটারের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় আলোকবর্ষ। অর্থাৎ আলো এক বছরে যতটুকু দূরত্ব পাড়ি দেয়, সেটাই হলো এক আলোকবর্ষ। সেই হিসাবে পৃথিবী থেকে আলফা সেন্টোরির দূরত্ব প্রায় চার আলোকবর্ষ। লকহিড বিমানের জন্য সেটা অনেক দূরত্বের, যা পাড়ি দিতে লাগবে ২ মিলিয়ন বা ২০ লাখ বছর। বুঝতেই পারছেন, অন্য কোনো নক্ষত্রে যাওয়ার জন্য লকহিড বিমান যথাযথ যান নয়।
আলফা সেন্টোরি ছাড়িয়ে অন্য কোনো নক্ষত্র ব্যবস্থায় যেতে চাইলে লাগবে আরও বেশি সময়। যেমন উলফ ৩৫৯ এবং লালানডে নক্ষত্রের দূরত্ব প্রায় ৮ আলোকবর্ষ। কাজেই লকহিডের সেখানে পৌঁছাতে কত দিন লাগবে, বুঝতেই পারছেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।