বাংলাদেশে অবৈধ তামাক ব্যবসার ভয়াবহ বিস্তার নিয়ে সম্প্রতি এক গবেষণায় চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। দেশে অবৈধ তামাক ব্যবসা এমনভাবে বিস্তৃত হয়েছে যা আর সাধারণ চোরাচালান বা নকল পণ্যের সীমিত সরবরাহে সীমাবদ্ধ নয়। পূর্ণাঙ্গ অপরাধ চক্র এর পিছনে কাজ করছে। আর এর ফলশ্রুতিতে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্র ও অর্থনীতি।
গবেষণা অনুযায়ী, গত বছরের তুলনায় অবৈধ তামাক বাজার প্রায় ৩১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতি মাসে বাজারে আসছে প্রায় ৮৩২ মিলিয়ন শলাকা অবৈধ সিগারেট। এই অবৈধ বাজারের বড় অংশ দখল করে আছে ‘ইলিসিট হোয়াইটস’, যেগুলো আমাদের দেশে নানা অবৈধ উপায়ে উৎপাদিত হয় এবং ভুয়া, পুনঃব্যবহৃত কিংবা সম্পূর্ন ট্যাক্স স্ট্যাম্পবিহীনভাবে বাজারজাত হচ্ছে। অন্যদিকে বিদেশ থেকে চোরাচালানকৃত ব্র্যান্ড যা কন্ট্রাব্র্যান্ড নামে পরিচিত, সেগুলোও বাজার সয়লাব করে ফেলেছে। এসকল চোরাচালনকৃত সিগারেট কোনো ধরনের শুল্ক ছাড়াই দেশের বাজারে প্রবেশ করছে। খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, অবৈধ এ বাণিজ্যের কারণে সরকার যে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে, তা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ঘোষিত বার্ষিক ২,০০০ কোটি টাকার হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি। বাস্তবে ক্ষতির পরিমাণ এর দ্বিগুণ কিংবা তারও বেশি হতে পারে।
বাংলাদেশে চোরাই পথে আনা বিদেশি সিগারেট বা কন্ট্রাব্যান্ড পণ্যগুলো প্রবেশ করছে অপ্রকাশ্য ও গোপন চ্যানেলের মাধ্যমে। এভাবে তারা সিগারেট আমদানির উপরে প্রায় ৬০০ শতাংশ যে উচ্চহারের আমদানি শুল্ক সরকার আরোপ করেছে তা এড়িয়ে যাচ্ছে। এরূপ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কর ফাঁকি কেবল অপরাধই নয়, বরং এভাবে অবৈধ ব্যবসায়ীরা বিপুল মুনাফা করার সুযোগ পাচ্ছে এবং সরকারের রাজস্ব থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা এভাবেই কালো বাজারে হারিয়ে যাচ্ছে।
সস্তা ও অবৈধ এই সিগারেটগুলো দ্রুতই নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠী এবং তরুণদের পছন্দের পণ্য হয়ে উঠছে। এর ফলে ধূমপানের হার ক্রমশ বেড়ে চলেছে। বৈধ সিগারেটের দাম যখন সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে, তখন অবৈধ সিগারেট সহজলভ্য ও সস্তা থাকায় এটি এক ধরনের ‘ফাঁদ’ হিসেবে কাজ করছে।
দেশজুড়ে খুচরা দোকানগুলোতে ট্যাক্স স্ট্যাম্পের প্রকাশ্য পুনঃব্যবহার যেন এখন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈধ সিগারেট প্যাকেট থেকে স্ট্যাম্প সংগ্রহ করে তা আবার অবৈধ ব্যবসায়ীর মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ১৫ শতাংশ দোকানদার অবৈধ সিগারেট সরবরাহকারীদের থেকে সরাসরি প্রণোদনা পেয়ে থাকে। তাদের বিভিন্ন ফ্রি গিফট, প্যাক ডিসকাউন্ট ও অতিরিক্ত শলাকা দেওয়ার মাধ্যমে টার্গেট করা হচ্ছে। অন্যদিকে অনেক খুচরা বিক্রেতা শুধু বাড়তি মুনাফার লোভেই এসব শুল্ক ফাঁকি দেয়া সিগারেট বিক্রি করছেন। এসব সুবিধা ও লাভজনক প্রণোদনা খুচরা বিক্রেতাদের উৎসাহিত করছে অবৈধ ব্র্যান্ড মজুদ রাখতে, ব্যবহৃত ট্যাক্স স্ট্যাম্প সংগ্রহ করতে এবং সরকারের নির্ধারিত ন্যূনতম খুচরা মূল্যের নিয়ম প্রকাশ্যেই উপেক্ষা করতে।
বাংলাদেশে অবৈধ সিগারেট ব্যবসা এখন সুসংগঠিত ও কার্যকর এক নেটওয়ার্ক। খুচরা বিক্রেতাদের মধ্যে প্রায় ৮২ শতাংশই জানিয়েছেন, তারা অবৈধ সিগারেটের নিয়মিত ও নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ পাচ্ছেন। রাজধানী ঢাকা ও বন্দরনগরী চট্টগ্রাম ইতোমধ্যেই এ বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। চোরাই পথে আসা ওরিস, মন্ড, প্যাট্রন, এক্সএসও ও এসসে নামের বিদেশি ব্র্যান্ডগুলো খুচরা দোকানে দাপটের সঙ্গে বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে শুধু ওরিস ব্র্যান্ডের মাসিক বিক্রি ৫ কোটিরও বেশি শলাকা , যা এ সংকটের ব্যাপকতা ও গভীরতাকে আরও স্পষ্ট করে। অন্যদিকে দেশে উৎপাদিত পুষ্পা, টি-২০, সিটি গোল্ড ও পোলো-র মতো ব্র্যান্ডগুলোও সরকার নির্ধারিত ন্যূনতম মূল্যের বহু নিচে বিক্রি হচ্ছে। এভাবে অগণিত অনিয়ন্ত্রিত পণ্যে সিগারেটের বাজার সয়লাব হচ্ছে, আর বৈধ কর পরিশোধ করা ব্র্যান্ডগুলো দ্রুতই স্থান হারাচ্ছে। ফলস্বরূপ, সরকার বিপুল রাজস্ব ক্ষতির শিকার হচ্ছে এবং নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ছে।
সাম্প্রতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের অনুসন্ধানে বাংলাদেশের অবৈধ সিগারেট বাণিজ্যের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। শুধু ছোটখাটো চোরাচালান নয়, বরং বড় আকারের দুর্নীতি ও শিল্প পর্যায়ের চোরাচালানও চলছে। বিজয় ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো ও তারা ইন্টারন্যাশনাল টোব্যাকো নামের কোম্পানিগুলো ভূয়া প্রতিষ্ঠান ব্যবহার করে প্রায় ৫,৯০৬ টন কাঁচামাল আমদানি করেছে। এই কাঁচামাল দিয়ে প্রায় ২৯৫ কোটি সিগারেট স্টিক উৎপাদন সম্ভব, আর এতে সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে আনুমানিক ১,৫০০ কোটি টাকা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযানও চালাচ্ছে। তবে বাস্তবতা ভয়াবহ, সীমিত সম্পদ ও জনবল থাকায় অধিকাংশই নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে এবং অবৈধ পণ্যগুলো বাজারে ছড়িয়ে যাচ্ছে।
সন্ধ্যা ৭টার মধ্যেই প্রতিমা বিসর্জন শেষ করতে হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
বাংলাদেশের ভ্যাট আয়ের প্রায় ৩০-৩৫ শতাংশই তামাকখাত থেকে আসে, তাই অবৈধ তামাকের উত্থান সরাসরি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর আঘাত করছে। বিশেষজ্ঞ ও খাত সংশ্লিষ্টরা আইন প্রয়োগের প্রচেষ্টার প্রশংসা করলেও তারা দীর্ঘদিন ধরেই সতর্ক করে আসছেন যে বর্তমান কর ও দাম কাঠামো এবং মূল্য বৃদ্ধি এই অপরাধচক্রকে অনিচ্ছাকৃতভাবেই পুষ্ট করছে। তাই অতিসত্তর এই কাঠামোর মেরামত প্রয়োজন। অবিলম্বে সরকারি ও বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্যোগ প্রয়োজন, যাতে এই অবৈধ সাম্রাজ্যের মূল উপরে ফেলা যায়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।