ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি দুই দফায় ২৭২ আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীর নাম প্রকাশ করেছে। কিন্তু শরিক দলগুলোর আসন এখনো ঝুলে থাকায় জোটের রাজনীতিতে দেখা দিয়েছে অস্থিরতা ও উৎকণ্ঠা—একই সঙ্গে দ্রুত আলোচনা ও আনুষ্ঠানিক ঘোষণার দাবি তুলেছে শরিকরা।
দুই দফায় মোট ২৭২ আসনে দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করে ইতোমধ্যে নির্বাচনী প্রস্তুতি জোরদার করেছে বিএনপি। তবে এরই মধ্যে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলো নিজেদের মনোনয়ন চূড়ান্ত না হওয়ায় উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সময় ঘনিয়ে আসায় তারা দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিএনপির সঙ্গে বসে আসন সমঝোতা চূড়ান্ত করতে চান।
শরিক দলগুলোর নেতাদের মতে, বিএনপি যেহেতু তাদের দলীয় প্রার্থীদের আসন ঘোষণা করে দিয়েছে, এখন জোটের আসনগুলোও প্রকাশ করা জরুরি। এতে শরিকদের প্রস্তুতি বাড়বে এবং মাঠে বার্তা যাবে—জোট একসঙ্গেই লড়াইয়ে আছে।
সূত্র বলছে, এরই মধ্যে শরিক দলের কয়েকজনকে প্রার্থিতার বিষয়ে ‘গ্রিন সিগন্যাল’ দিয়েছে বিএনপি। তবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না থাকায় তারা পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। বিশেষ করে যেসব আসনে জোটের শীর্ষ নেতাদের বাদ পড়ে নাম ঘোষণা করা হয়েছে, সে আসনগুলো পুনর্বিবেচনারও দাবি তুলেছেন শরিকরা।
দলীয় সূত্রে আরও জানা গেছে, জোটের যেসব নেতাকে বাদ রাখা হয়েছে তাদের কাউকে কাউকে বিএনপি ভবিষ্যতে—সংসদের উচ্চকক্ষে কিংবা ক্ষমতায় গেলে—অন্যভাবে মূল্যায়নের চিন্তাও করছে।
নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে শরিকদের চাপ—জোটের আসন বণ্টন নিয়ে স্পষ্টতা ও আনুষ্ঠানিক ঘোষণাই এখন তাদের প্রধান প্রত্যাশা।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত ৩ নভেম্বর প্রথম দফায় ২৩৬ আসনে দলের প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করে বিএনপি। এর এক দিন পর মাদারীপুর-১ আসনে ঘোষণা করা প্রার্থীর মনোনয়ন স্থগিত করা হয়। এক মাস পর গত বৃহস্পতিবার আরও ৩৬ আসনে দলীয় প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। সে হিসাবে মোট ২৭২ আসনে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণা করা হলো। এখন ফাঁকা রয়েছে আর ২৮ আসন। বিএনপি থেকে বলা হয়েছে, এই ফাঁকা আসনগুলোতে মূলত শরিকরাই নির্বাচন করবেন।
ফাঁকা আসনগুলো প্রসঙ্গে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আমাদের অ্যালায়েন্সের (জোট) সঙ্গে যারা আছেন, মূলত এগুলো তাদের। এ ছাড়া আমাদেরও দু-একটির ডিসিশন হবে, সেগুলো আমরা আরও পরে ঘোষণা করব। বাকিগুলো আমরা যথাসময়ে ঘোষণা করব।’
বিএনপি সর্বশেষ ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। সেবার শরিকদের জন্য ৫৯টি আসন ছেড়েছিল দলটি। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীকে ২২টি আসন ছাড়লেও, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এবারের ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে জামায়াতকেই বিএনপির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মনে করা হচ্ছে। তাই আগামী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রার্থিতা এবং সংশোধিত আরপিও বিবেচনায় নিয়ে মূলত বিজয়ী হওয়ার মতো শরিকদের ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে আসন ছাড়বে বিএনপি। মিত্রদের জন্য ছাড়া আসনে প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রার্থী বিজয়ী হোক, সেটা কোনোভাবেই চায় না বিএনপি। দলটির বিশ্লেষণ হচ্ছে, ঘোষিত আসনগুলোর মধ্যে কয়েকটি আসনে যুগপতের শরিকরা মনোনয়নপ্রত্যাশী থাকলেও, ওই আসনগুলোতে বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী রয়েছেন। তাদের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সে বিবেচনায় এসব আসনে দলীয় লোকদেরই প্রার্থী করেছে বিএনপি।
দ্বিতীয় ধাপে ঘোষিত ৩৬ আসনের মধ্যে কমপক্ষে চারটি আসনে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্ররা ধানের শীষের মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। তারা হলেন নড়াইল-২ আসনে জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের আহ্বায়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, কিশোরগঞ্জ-৫ আসনে ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা, ঝালকাঠি-১ আসনে বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান এবং যশোর-৫ আসনে ১২ দলীয় জোট শরিক জমিয়তের যুগ্ম মহাসচিব রশিদ বিন ওয়াক্কাস। তাদের মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচনে নড়াইল-২ আসন থেকে ফরিদুজ্জামান ফরহাদ এবং পিরোজপুর-২ আসন থেকে মোস্তাফিজুর রহমান ইরান ধানের শীষ প্রতীকে ভোট করেন। আর যশোর-৫ আসন থেকে নির্বাচন করেন রশিদ বিন ওয়াক্কাসের বাবা জমিয়তের প্রয়াত মুফতি মুহাম্মদ ওয়াক্কাস। এবার নড়াইল-২ আসন থেকে জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মনিরুল ইসলাম, কিশোরগঞ্জ-৫ আসন থেকে বাজিতপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি শেখ মজিবুর রহমান ইকবাল, ঝালকাঠি-১ আসন থেকে বিএনপির কেন্দ্রীয় ধর্মবিষয়ক সম্পাদক রফিকুল ইসলাম জামাল এবং যশোর-৫ আসন থেকে মনিরামপুর উপজেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট ইকবাল হোসেনকে প্রার্থী করেছে দলটি।
আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের নিয়ে একই সঙ্গে নির্বাচন ও সরকার গঠন করার অঙ্গীকার রয়েছে বিএনপির। নির্বাচন সামনে রেখে আসন বণ্টন বা আসন সমঝোতা প্রশ্নে বিএনপির চাওয়া অনুযায়ী যুগপতের মিত্ররা তাদের প্রার্থী তালিকাও জমা দিয়েছে। তবে তালিকা জমা নেওয়ার পর শরিকদের কারও সঙ্গে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বসেনি বিএনপি। এ অবস্থায় শরিকদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই প্রার্থী ঘোষণায় তারা বিস্মিত। এমন প্রেক্ষাপটে গতকাল শুক্রবার রাজধানীর নয়াপল্টনের দলীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত নির্বাহী কমিটির সভায় বিএনপির সঙ্গে দীর্ঘ ২০ বছরের রাজনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছে বাংলাদেশ লেবার পার্টি। দলটির চেয়ারম্যান ইরান ২০১৮ সালে পিরোজপুর-২ আসন থেকে নির্বাচন করেছিলেন। তবে এবার সেখান থেকে সরে গিয়ে বিএনপির কাছে কেন ঝালকাঠি-১ আসন থেকে মনোনয়ন চাইলেন, সেটা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। কারণ, ঝালকাঠি-১ আসনে আগে থেকেই বিএনপির শক্তিশালী প্রার্থী রয়েছেন।
অন্যদিকে, শরিক দলের নেতাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে প্রার্থী ঘোষণায় বিস্মিত হয়েছে ১২ দলীয় জোট। গতকাল জোটপ্রধান ও জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দারের খিলগাঁওয়ের কার্যালয়ে জোটের এক সভায় এই বিস্ময় প্রকাশ করেন নেতারা। এ অবস্থায় ভবিষ্যৎ রাজনীতি ও করণীয় সম্পর্কে জানাতে আগামী সোমবার জরুরি সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করা হয়েছে। সেখানে জোটের পক্ষ থেকে সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট বক্তব্য তুলে ধরা হবে।
১২ দলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও ন্যাশনাল লেবার পার্টির চেয়ারম্যান লায়ন মো. ফারুক রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘১২ দলীয় জোট শুরু থেকেই বিএনপির নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে রাজপথে সক্রিয় ছিল। বিএনপির পক্ষ থেকে এরই মধ্যে দুই দফায় ঘোষিত ২৭২ আসনের মধ্যে ১২ দলীয় জোটের অনেক শীর্ষ নেতা মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু তারা কেউ-ই মনোনয়ন পাননি। এখন ফাঁকা রাখা ২৮ আসনের অধিকাংশই শরিকদের জন্য বলে বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এ অবস্থায় আসন সমঝোতা নিয়ে আমরা শিগগির বিএনপির সঙ্গে আলোচনা চাই। শরিকরা তাদের যথাযথ মূল্যায়ন চায়। এ ছাড়া এরই মধ্যে জোটের শীর্ষ নেতাদের যেসব আসনে বিএনপি তাদের প্রার্থিতা ঘোষণা করেছে, সেগুলোরও পুনর্বিবেচনা চান তারা।’
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে আলোচনা ছাড়াই বিএনপি দুই দফায় তাদের প্রার্থিতা ঘোষণা করেছে। অনুমান করি, অন্য শরিকদের সঙ্গেও আলোচনা করেনি। একতরফাভাবে বিএনপি তাদের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করছে। উনারা এখন দেখছি, দেখবেন, যাচাই-বাছাই করছেন—এ রকম কথাবার্তার মধ্যে আছেন। এর ফলে শরিকদের আসন সমঝোতার বিষয়টি এক ধরনের দীর্ঘসূত্রতায় পর্যবসিত হয়েছে। প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রার্থীরা আগে থেকেই মাঠে থাকায় শরিকদের জন্য একেকটি দিন যেন মাসের সমান। উনারা শরিকদের কিছুটা বেকার, আধাবেকার অবস্থায় রেখে দিয়েছেন। এতে করে শুধু শরিকরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তা নয়; পরোক্ষভাবে বিএনপিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে আসন সমঝোতা নিয়ে আমরাও আলোচনা চাই। বিএনপি কথা বলতে চাইলে নিশ্চয় আমরা কথা বলব। উনাদের বসার জন্য তাগাদা দেওয়া হয়েছে, নানা কারণে উনারা সে সময় করতে পারেননি। বসাটা উনাদের অগ্রাধিকারের মধ্যে আছে, আপাতত এমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।’
নির্বাচন সামনে রেখে বৃহত্তর জোট গঠন প্রক্রিয়ায় রয়েছে বিএনপি। যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের বাইরেও কয়েকটি ইসলামী দল এবং বাম ঘরানার দু-একটি দলকেও নির্বাচনী জোটে নিতে আগ্রহী তারা। তাই প্রয়োজন হলে, অর্থাৎ নতুন কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি নির্বাচনী জোটে অন্তর্ভুক্ত হলে, ঘোষিত আসনগুলোর মধ্য থেকেও ছাড় দিতে পারে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) ব্যাপারে শুরুতে বিএনপির আগ্রহ ছিল। তাদের ব্যাপারে বিএনপি ইতিবাচকও ছিল। এর অংশ হিসেবে আসন বণ্টন বা আসন সমঝোতা নিয়ে দল দুটির মধ্যে কয়েকবার অনানুষ্ঠানিক আলোচনাও হয়েছে। তবে পরবর্তী সময়ে এনসিপির তরফ থেকে এ ব্যাপারে বিএনপিকে যেমন সুস্পষ্ট কোনো বার্তা দেওয়া হয়নি, তেমনি বিএনপিও আর খুব একটা আগ্রহ দেখায়নি। সব মিলিয়ে এটা নিয়ে তেমন অগ্রগতি না থাকায় এবং তপশিল ঘোষণা কাছাকাছি চলে আসায় এনসিপির অনেক শীর্ষ নেতার আসনেই দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করে দিয়েছে বিএনপি।
ঢাকা-৯, ১০ ও ১৮ থেকে এনসিপির গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের নির্বাচন করার আলোচনা রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা-৯ থেকে নির্বাচন করার ঘোষণা দেন দলটির সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা। সেখানে হাবিবুর রশিদ হাবিবকে প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। এ ছাড়া আলোচিত ঢাকা-১০ আসনে শেখ রবিউল আলম রবিকে প্রার্থী করেছে বিএনপি। যেখানে নির্বাচন করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে থাকা উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। ঢাকা-১৮ আসনে এনসিপি থেকে ভোটের মাঠে লড়বেন দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। এই আসনে এসএম জাহাঙ্গীর হোসেনকে প্রার্থী করেছে বিএনপি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



