মো. ইকবাল হোসেন : বর্তমান বিশ্বে শক্তির উৎস হিসেবে মোটাদাগে খনিকেই বিবেচনা করা হয়। কিন্তু খনিতে থাকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ মজুদ, যা টিপে টিপে খরচ করলেও একটা সময় এ মজুদ ফুরিয়ে যাবে। এ বিবেচনাতেই বিকল্প জ্বালানি উৎসের সন্ধানে নামে মানুষ। জীবাশ্ম জ্বালানিকেন্দ্রিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এছাড়া নবায়নযোগ্য জ্বালানিও অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও পর্যাপ্ত পরিমাণ শক্তি উৎপাদন করতে পারে না। তাই বর্তমান বিশ্বে টেকসই শক্তি উৎপাদনে পারমাণবিক প্রযুক্তিকে একটি অন্যতম অফুরান বিকল্প উৎস হিসেবে জোর দেয়া হচ্ছে। পারমাণবিক শক্তি দুই ধরনের বিক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপাদিত হয় যার একটিকে বলে নিউক্লিয়ার ফিশন, অন্যটি নিউক্লিয়ার ফিউশন। সারা বিশ্বে শান্তিপূর্ণ ও সামরিক উদ্দেশ্যে যত কর্মকাণ্ড চলে তার ভিত্তি হচ্ছে ফিশন। যেখানে পরমাণুর একটি ভারী মৌলের নিউক্লিয়াসকে নিউট্রন দিয়ে আঘাত করা হয়। তাতে ভারী মৌলের নিউক্লিয়াস ভেঙে দুটি হালকা মৌলের পরমাণুতে পরিণত হওয়ার সময় বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপাদন হয় এবং প্রক্রিয়াটি চলতে থাকে শিকলের মতো করে যাকে থামানো দুরূহ। এছাড়া প্রচলিত নিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টরে সৃষ্ট নিউক্লীয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজও ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকিপূর্ণ।
অন্যদিকে নিউক্লিয়ার ফিউশনের সূচনা হয় ফিশন বিক্রিয়ার উল্টো প্রক্রিয়ায়। এক্ষেত্রে অতিউচ্চ তাপমাত্রায় দুটি বা তার বেশি নিউক্লিয়াসকে একত্র করে বড় নিউক্লিয়াসে রূপান্তরিত করা হয়, সঙ্গে পাওয়া যায় বিপুল শক্তি। তবে এই প্রক্রিয়ার সুবিধা হচ্ছে, জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে এটি নিজে নিজেই কাজ করা বন্ধ করে দেয়, উচ্চমাত্রার দীর্ঘমেয়াদি তেজস্ক্রিয় বর্জ্যও তৈরি করে না, সেজন্য এর নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি কম। সেই সঙ্গে শক্তি উৎপাদনও হয় অনেক গুণ বেশি। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ফিউশন বিক্রিয়ার সফল ব্যবহার বর্তমান বিশ্বের জলবায়ু সংকটের অন্যতম বড় এক সমাধান হতে পারে।
নিউক্লিয়ার ফিউশন এমন এক প্রক্রিয়া যে প্রক্রিয়ায় সূর্য তাপ উৎপন্ন করে থাকে। সূর্যের মতো নক্ষত্রে নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমেই শক্তি তৈরি হয়। সূর্যের ভেতর এক কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এ বিক্রিয়া হয়। তবে পৃথিবীতে বিক্রিয়াটির জন্য প্রয়োজন ১০ কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি তাপমাত্রা। পৃথিবীতে এমন কোনো বস্তু নেই, যেটা ওই তাপমাত্রায় টিকে থাকতে পারে। বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে পৃথিবীতে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় সেই বিক্রিয়া ঘটানোর কৌশল উদ্ভাবনের চেষ্টা চালিয়ে আসছেন। প্রথম দিকে ফিউশন রিঅ্যাক্টর তৈরির ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা সূর্যের দিকেই তাকিয়েছিলেন। এখন আমরা জানি, সূর্যে যে বিক্রিয়ায় শক্তি উৎপাদিত হয়, তাকে বলে প্রোটন-প্রোটন চেইন বিক্রিয়া। এ বিক্রিয়ার প্রধান জ্বালানি হাইড্রোজেন। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, সূর্যের ভেতরে প্রচণ্ড তাপ ও চাপে প্রতি কণা (অ্যান্টিমেটার) পজিট্রনের প্ররোচনায় দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু থেকে দুটি ইলেকট্রনের (ঋণাত্মক কণা) কক্ষত্যাগের মধ্য দিয়ে সেখানে হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস তৈরির পথে বিপুল পরিমাণ শক্তির নির্গমন হয়। কিন্তু সমস্যা হলো, পরমাণুর কেন্দ্র নিউক্লিয়াসে এ বিক্রিয়া ঘটতে গড়ে শতকোটি বছর লাগে। যা-ই হোক সৌভাগ্যক্রমে হাইড্রোজেনের দুটি আইসোটোপ ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়ামের হাত ধরে এর একটি শর্টকাটের দেখা পেয়ে যান বিজ্ঞানীরা। যেখানে এই আইসোটোপের সংযোগের ফলে হিলিয়াম ও একটি নিউট্রন পাওয়া যায়। একটি চুল্লি বা রিঅ্যাক্টরে ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়ামের একটি অত্যনুকূল মিশ্রণ ও নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় বিক্রিয়া করানো গেলেই ফিউশন রিঅ্যাক্টর উৎপন্ন করতে পারবে অফুরান শক্তি।
১৯৫০-এর দশকে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের পদার্থবিদ আন্দ্রেই সাখারভ ফিউশন চুল্লির টোকাম্যাক নামের একটি নকশার প্রথম ধারণা দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। সেই পথ ধরেই দেখা দিয়েছে বেশ কয়েকটি সম্ভাব্য নকশা। ফিউশন প্রক্রিয়ায় শক্তি উৎপাদনের এ কাজে এখন পর্যন্ত বড় গবেষণা প্রকল্প হচ্ছে ফ্রান্সের ইন্টারন্যাশনাল থার্মোনিউক্লিয়ার এক্সপেরিমেন্টাল রিঅ্যাক্টর (আইটিইআর)। এছাড়া ক্যালিফোর্নিয়ার লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির ন্যাশনাল ইগনিশন ফ্যাসিলিটি, যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা জয়েন্ট ইউরোপিয়ান টোরাস (জেইটি) ল্যাবরেটরি, কমনওয়েলথ ফিউশন সিস্টেম (সিএফএস) যা হাজির করেছে ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (এমআইটি) পরীক্ষাগার, ব্রিটেনের কালহামের অ্যাটমিক এনার্জি অথরিটি, চীনের এক্সপেরিমেন্টাল অ্যাডভান্সড সুপারকনডাক্টিং টোকাম্যাক (ইস্ট) ফিউশন রিঅ্যাক্টর। আর টোকাম্যাক নামেই আরেকটি নকশা হাজির করেছে ব্রিটেনের কালহামের অ্যাটমিক এনার্জি অথরিটি, যা ১৯৫০-এর দশকে স্থাপিত হারওয়েল ল্যাবরেটরির উত্তরসূরি বলা যায়।
টোকাম্যাক এমন একটি মেশিন, যা ভীষণ শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র ব্যবহার করে প্লাজমাকে ডোনাটের মতো গোলাকার রিং আকারে সীমাবদ্ধ করে। এ বৃত্তাকার আকৃতিকে বৈজ্ঞানিক ভাষায় টোরাস বলা হয়। এই টোরাসেই থাকে জ্বালানি যা মূলত ডিউটেরিয়াম ও ট্রিটিয়ামের প্লাজমা। উল্লেখ্য, প্লাজমা হচ্ছে পদার্থের কঠিন, তরল আর বায়বীয় পরিস্থিতির পরের চতুর্থ একটি অবস্থা, যা অতিউচ্চ তাপমাত্রায় পাওয়া যায়। শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রটি এই প্লাজমাকে উত্তপ্ত করতে ও তাকে ওই টোরাসের দেয়াল স্পর্শ থেকে বিরত রাখতে ভূমিকা রাখে। কারণ টোরাসের গায়ে লেগে গেলেই প্লাজমার তাপমাত্রা যাবে কমে, আর হবে শক্তির অপচয়। এই টোকাম্যাক কিন্তু ছোটখাটো কোনো যন্ত্র নয়। এর মূল কাঠামো টোরাসেরই আয়তন হতে পারে ৮৩০ ঘনমিটার। এ আকৃতির টোরাস ব্যবহার করে গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইটিইআর। তবে সিএফএসের টোরাসের আকার এর ৬০ ভাগের ৫ ভাগ। এ ক্ষুদ্র টোরাসের জন্য সিএফএসের অবশ্য অনেক বেশি শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রয়োজন পড়ে। তুলনামূলক উচ্চ তাপমাত্রায় এ চৌম্বক ক্ষেত্রের শক্তিমত্তা বাড়ে। সময় বুঝে একে ঠাণ্ডা করে আনলেই হলো। ঠাণ্ডা করার জন্য ব্যবহার করা হয় তরল নাইট্রোজেন, যা আরেক কুলার হিলিয়ামের চেয়ে অনেক সস্তা। এখন অবশ্য সর্পিলাকার টোরাসের ধারণা এসেছে। এখানে বলা দরকার, টোকাম্যাকই একমাত্র রিঅ্যাক্টর নয়। কানাডার ভ্যাঙ্কুভারভিত্তিক প্রতিষ্ঠান জেনারেল ফিউশন যেমন কাজ করছে ভিন্ন আরেক ধরনের ফিউশন চুল্লি নিয়ে, যাকে তারা বলছে ‘ম্যাগনেটাইজড টার্গেট ফিউশন’ হিসেবে। এতে প্লাজমায় বিদ্যমান চার্জগুলো দিয়েই চৌম্বক ক্ষেত্র উৎপাদনের কথা বলা হচ্ছে।
পৃথিবীতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নিউক্লিয়ার ফিউশন ঘটানোর ক্ষেত্রে বিজ্ঞানীদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছে বারবার। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকটি যুগান্তকারী অগ্রগতি এ প্রযুক্তি নিয়ে আশাবাদী করে তুলেছে বিজ্ঞানীদের। গত বছর ক্যালিফোর্নিয়ার লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি প্রথমবারের মতো নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া ঘটিয়ে লাভজনকভাবে শক্তি তৈরিতে সফল হন। তার ঠিক এক বছরের মাথায় নিয়ন্ত্রিত নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার মাধ্যমে টেকসই উপায়ে সীমাহীন শক্তি উৎপাদন সম্ভব কিনা তা পরীক্ষার সবচেয়ে বড় সুযোগ এনে দিয়েছে জাপানের ‘জেটি-৬০এসএ’ নামের পরীক্ষামূলক চুল্লী। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে জাপান এ প্রকল্প শুরু করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের জ্বালানি কমিশনের মতে, জেটি-৬০এসএ বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত টোকাম্যাক। পূর্ববর্তী জেটি-৬০ অবকাঠামো ব্যবহার করে নতুন এ চুল্লি তৈরি করা হয়েছে। এসএর অর্থ হলো ‘সুপার, অ্যাডভান্সড’। রাজধানী টোকিওর দক্ষিণে নাকা এলাকায় ছয়তলা ভবনের সমান এ যন্ত্র। জাপানের এই ফিউশন গবেষণাকর্মে ব্যবহৃত এই ‘টোকাম্যাক’ ব্যবস্থাটি দেখতে বিশালাকৃতির গোলাকার চৌবাচ্চার মতো। এ চুল্লি ২০০ মিলিয়ন ডিগ্রি সেলসিয়াসের উত্তপ্ত প্লাজমা ধারণ করতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বড় পরিসরে প্লাজমার পরিমাণ বাড়িয়ে ফিউশন বিক্রিয়া ঘটানো গেলে খরচ করা শক্তির চেয়ে বেশিই উৎপাদন করা সম্ভব। এছাড়া সবচেয়ে বড় পারমাণবিক ফিউশন চুল্লি নির্মাণাধীন পর্যায়ে রয়েছে ফ্রান্সে, যা সক্রিয় হতে পারে ২০২৫ সাল নাগাদ।
ফিউশন চুল্লি থেকে শক্তির বাণিজ্যিক উৎপাদনের স্বপ্ন দেখছে ভারত, চীন থেকে শুরু করে ইউরোপের প্রতিটি দেশ এবং অতি অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্রের বহু প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেই পুরনো কৌতুককে হার মানাতে পারেনি কেউ, যেখানে বলা হয়েছে, বাণিজ্যিক ফিউশন শক্তির উৎপাদন থেকে বিজ্ঞানীরা সব সময়ই ৩০ বছর দূরে থাকবে। সেজন্য যেতে হবে আরো বহু পথ, দরকার হবে আরো অনেক গবেষণা, তাতে লাগবে আরো অনেক সময়। সত্যিই যদি পৃথিবীতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে নিউক্লিয়ার ফিউশন ঘটানো যায়, তার মধ্য দিয়ে দৃশ্যত অসীম পরিমাণ শক্তি উৎপাদন করা যাবে পরিবেশবান্ধব উপায়ে। সেটি কতটা সম্ভব হবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে তা সম্ভব হলে নিশ্চিতভাবেই বিশ্বের চেহারা বদলে যাবে।
মো. ইকবাল হোসেন: সহকারী অধ্যাপক, নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও
পিএইচডি গবেষক, কিউশু বিশ্ববিদ্যালয়, জাপান
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।