অ্যাঙ্গাস রক্সবার্গ : পশ্চিমের খুব কম মানুষেরই সন্দেহ রয়েছে যে ইউক্রেন একটি ন্যায়সংগত যুদ্ধে লড়ছে। রাশিয়ার হামলাটি ছিল বিনা প্ররোচনায়। ন্যাটোর সম্প্রসারণ কিংবা দোনবাসে রুশদের প্রতি ইউক্রেনের নিপীড়ন নিয়ে যে অভিযোগই উঠুক না কেন, এটা ঠিক যে রাশিয়াকে কেউ আক্রমণ করেনি এবং এর ধরনের পরিকল্পনাও কেউ করেনি। ভ্লাদিমির পুতিন সরাসরি একটি আগ্রাসন ও আঞ্চলিক দখলদারি যুদ্ধের সূচনা করেছেন।
এই চিন্তাধারা অনুসারে ইউক্রেনকে সমর্থন করা সঠিক কাজ। তবে আমরা (পশ্চিমারা) ইউক্রেনকে যেভাবে সমর্থন দিচ্ছি, সেটা ইউক্রেনীয় জাতিকে রক্ষা করার সঠিক উপায় কি না তা মোটেও স্পষ্ট নয়।
এই যুদ্ধ যত বেশি দীর্ঘ হবে, ইউক্রেনীয়রা তত বেশি পরিমাণে তাদের মাতৃভূমি থেকে পালাতে বাধ্য হবে। এর ফলে তাদের বাড়িঘর, শহর, শিল্প ও অর্থনীতির ওপর ধ্বংসযজ্ঞ চলতে থাকবে। এর পরও ইউক্রেনের যুদ্ধের লক্ষ্য অর্জনের জন্য আগ্রাসনকারীকে পরাজিত করতে পশ্চিমাদের সমর্থনের বর্তমান ধরন এবং নিজেদের সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপের পরিবর্তে ইউক্রেনকে যেভাবে অস্ত্র সরবরাহ করছে, তা কেবলই যুদ্ধকে প্রলম্বিত করার নিশ্চয়তা দিচ্ছে। রাশিয়ার অগ্রগতি ধীর হতে পারে, কিন্তু হামলা বন্ধ হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। আবার ইউক্রেন থেকে পাল্টা আঘাত হানার সম্ভাবনাও কম। সুতরাং দেশটিতে মারাত্মক ধ্বংসযজ্ঞই অব্যাহত থাকবে এবং জঘন্য যুদ্ধাপরাধ ঘটতে থাকবে।
কিছু পশ্চিমা জ্যেষ্ঠ নেতা এমন একটি দিনও বাদ নেই যে বলছেন না, ‘ইউক্রেন সফল হবে এবং রাশিয়া ব্যর্থ হবে। ’ এই ধরনের কথা অবশ্যই মনোবল বৃদ্ধি, কিন্তু বাস্তবতা হলো এগুলো কাণ্ডজ্ঞানহীন কথাবার্তা।
সত্যটি হচ্ছে, দিনের পর দিন আরো অনেক শহর ও নগর ধ্বংস হচ্ছে এবং রুশদের হাতে পতন ঘটছে। গত দুই মাসে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া এলাকা মূলত দোনবাসের বিচ্ছিন্ন অংশগুলোর তুলনায় সম্ভবত পাঁচ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। যদি রাশিয়া এই গতিতে ‘পরাজয়ের’ (পশ্চিমারা যেহেতু তা-ই মনে করে) মুখোমুখি হতে থাকে, তাহলে আগামী দুই মাসের মধ্যে ইউক্রেনের পুরো দক্ষিণাঞ্চল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হবে, ওডেসার মতো শহরগুলো মারিওপোলের মতো হবে এবং হাজারে হাজারে ইউক্রেনীয় মারা যাবে।
যুদ্ধ যদি আরো খারাপ অবস্থার দিকে যায় এবং আরো বেশি বেশি ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে আসে, তখন যুদ্ধ থেকে পালিয়ে অন্যান্য দেশে আশ্রয় নেওয়া ইউক্রেনীয়রা আর কখনো ফিরে আসবে বলে মনে হয় না। কারণ তাদের কাছে ফিরে আসার জন্য কোনো বাড়ি বা কর্মক্ষেত্র অবশিষ্ট থাকবে না। মারিওপোল থেকে যে পরিমাণ নাগরিক পালিয়ে গেছে, তাদের কতজন আর ফিরে আসবে? রাশিয়ার লক্ষ্য যদি ইউক্রেনের জাতিকে ধ্বংস করা হয়, তাহলে পশ্চিমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ঠিক সেটাই করতে সাহায্য করছে।
প্রকৃত অর্থেই যদি ইউক্রেনের জনগণের জীবন আমাদের উদ্বেগের বিষয় হয়, তাহলে পশ্চিমাদের এমন কিছু করতে হবে, যাতে এখনই যুদ্ধ বন্ধ করা যায়। ইউক্রেনীয়দের যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করার মধ্য দিয়ে কেবল তাদের দেশকে বসবাসের অযোগ্য করেই তোলা হচ্ছে।
তবে সমস্যা হচ্ছে, দ্রুত যুদ্ধ বন্ধ করার মাত্র দুটি উপায় আছে এবং বেশির ভাগ পশ্চিমা নেতার কাছে এর কোনোটাই সুস্বাদু নয়। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ন্যাটোকে যুদ্ধে প্রবেশ করতে হবে এবং রাশিয়ার আক্রমণকারী বাহিনীকে অচল করে দেওয়ার জন্য একটি ত্বরিত, বিশাল ও নিষ্পত্তিমূলক আক্রমণ করতে হবে। রাশিয়ার পদক্ষেপের বিপরীতে, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী এটা করার জন্য পশ্চিমের সব অধিকার থাকবে। পুতিন যখন সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করেন, তখন সিরিয়ার বৈধ ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকারের অনুরোধে সাড়া দিয়ে তিনি খুব সাবধানে এর বৈধতা গড়ে তোলেন। ইউক্রেনেও পশ্চিমারা একই কাজ করতে পারে। পুতিন নিজেও ইউক্রেনে তাঁর আগ্রাসনের পক্ষে এমন কোনো যুক্তি দেখাতে পারেননি। সমস্যা হচ্ছে, এর সঙ্গে যে ঝুঁকি জড়িত সেটা হচ্ছে নির্ঘাত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ—এটা পরিষ্কার। ঠিক এ কারণেই পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেন যুদ্ধে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকার করে আসছে।
অন্য বিকল্পটি হলো পুতিনকে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নের জন্য বুঝিয়েসুজিয়ে রাজি করানো। রাশিয়াকে ব্যাপক শান্তি আলোচনার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে এটা করতে হবে। পশ্চিমা নেতারা পুতিনের মতো একজন কসাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু তাঁরা সার্বিয়ার স্লোবোদান মিলোসেভিচের সঙ্গে ঠিকই আলোচনা করেছিলেন। যখন স্রেব্রেনিচায় গণহত্যা হলো, এর মাত্র কয়েক মাস পর মিলোসেভিচের সঙ্গে আলোচনা হয়। সেই আলোচনার ফল হচ্ছে ডেটন চুক্তি, যা ১৯৯৫ সালে বসনিয়ায় যুদ্ধের অবসান ঘটায়।
পুতিনকে আলোচনার টেবিলে নিয়ে যাওয়ার জন্য যে পরিবেশ তৈরি করা উচিত তার সবই করতে হবে। এর মধ্যে ইউক্রেনের সীমান্ত ও রাশিয়ার পুরনো নিরাপত্তা উদ্বেগের ইস্যুটি রয়েছে। এই উদ্বেগের মধ্যে সম্ভবত সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ সীমানাটি গুরুত্ব পাবে। আলোচনার ফলাফল পূর্বনির্ধারিত হওয়ার প্রয়োজন নেই। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো লড়াইয়ের চেয়ে কথা বলা।
পশ্চিমা নেতারা এই সব বিষয়ে নিজেদের আলোচনা নিয়ে আসতে চান না। কারণ তাঁরা মনে করেন, এর মধ্য দিয়ে পুতিনকে বলপূর্বক নতুন মানচিত্র তৈরির প্রচেষ্টার জন্য পুরস্কৃত করা হবে। তাঁরা বরং যুদ্ধ করবেন অথবা আরো সঠিক উপায়ে ইউক্রেনকে যুদ্ধ করতে দেবেন রাশিয়াকে পরাজিত করার আশায়। এর মধ্যে একটা বিষয়ও যদি নিশ্চিত হয়ে থাকে, সেটা হলো পুতিন কখনোই পরাজয় মেনে নেবেন না। তিনি এরই মধ্যে এই যুদ্ধে খুব গভীর বিনিয়োগ করেছেন। পশ্চিমা নেতারা যদি মনে করেন যে ইউক্রেনকে তাঁদের অস্ত্রবিষয়ক উৎসাহ ইউক্রেনের সামরিক বিজয় এনে দেবে, তাহলে তাঁরা পুতিনের উদ্দেশ্য ও সংকল্পকে মারাত্মকভাবে ভুল বুঝবেন। এর চেয়ে বরং ইউক্রেনের স্বার্থে আমাদের এখনই পুতিনকে থামাতে হবে। আমরা যে দেশটিকে রক্ষা করতে চাই, তার কিছু অবশিষ্ট থাকার আগেই কোনো না কোনোভাবে আমাদের তাকে থামাতে হবে।
লেখক : ব্রিটিশ সাংবাদিক, বিবিসির সাবেক মস্কো প্রতিনিধি ও ক্রেমলিনের সাবেক জনসংযোগ উপদেষ্টা এবং ‘আ স্ট্রংম্যান পুতিন অ্যান্ড স্ট্রাগল ফর রাশিয়া’ গ্রন্থের প্রণেতা।
সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান (যুক্তরাজ্য), ভাষান্তরিত
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।