আন্তর্জাতিক ডেস্ক : রুশ বাহিনী বলছে, পূর্ব ডোনেৎস্কের সভিৎলোডারস্ক শহরে ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিদ্যুত কেন্দ্রটি তারা দখল করে নিয়েছে। বলা হচ্ছে, গত তিন সপ্তাহের মধ্যে এটিই রাশিয়ার প্রথম কোন কৌশলগত বিজয়। পাশাপাশি, রুশ সেনা এই প্রথম ইউক্রেনের ড্রোন পরিচালনাকারী গ্রাউন্ড স্টেশন ধ্বংস করতে সফল হয়েছে।
পাঁচ মাসের কঠিন লড়াইয়ের মধ্যে, রাশিয়ান বাহিনী ইউক্রেনের তুর্কি তৈরি বায়রাক্টার টিবি-২ ড্রোনের অন্তত ১২টি গুলি করে ভূপাতিত করেছে। কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত টিবি-২ এর অপারেশনের জন্য প্রয়োজনীয় গ্রাউন্ড স্টেশনগুলোকে টার্গেট করতে সফল হয়নি। বৃহস্পতিবার, একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে যাতে দেখা গেছে যে, দক্ষিণ ইউক্রেনের খেরসন ওব্লাস্টে ইউক্রেনের ড্রোন পরিচালানাকারী স্টেশন টুইন-মাস্ট রেডিও রিলে গুড়িয়ে দিচ্ছে রাশিয়ান কামিকাজি বা ‘আত্মঘাতী’ ড্রোন। ইউক্রেনীয় বিমান বাহিনী এবং নৌবাহিনীর অন্তর্গত টিবি-২ এর ফটোগুলোর পটভূমির সাথে এর মিল পাওয়া যায়।
রিলেগুলো দেড় টন ওজনের প্রপেলার-চালিত টিবি-২-এর পরিসর প্রসারিত করতে সাহায্য করে, যার মাধ্যমে ক্ষেপণাস্ত্র-সজ্জিত ড্রোনগুলোকে তাদের রেডিও-সজ্জিত কমান্ড ট্রেলারে বসে থাকা অপারেটররা কয়েকশ মাইল দূর থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। রিলেগুলো তাদের ড্রোনগুলোতে ক্রুদের পাঠানো কমান্ড সংকেতগুলো গ্রহণ করে এবং পুনরায় সম্প্রচার করে। একইভাবে ড্রোন থেকে পাঠানো ভিডিওগুলোও কমান্ড সেন্টারে পাঠাতে সাহায্য করে। এটি ছাড়া, ড্রোনগুলো প্রধান কন্ট্রোল ট্রেলারের সম্প্রচার পরিসরের চেয়ে বেশি দূরত্বে যেতে সক্ষম হবে না।
এটা স্পষ্ট যে, ইউক্রেনের বাকি ড্রোন অবকাঠামোর সাথে রাশিয়ানরা রিলেগুলোকেও টার্গেট করবে। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করার পাঁচ মাস পরে, রাশিয়ানরা অবশেষে একটি রিলে শনাক্ত এবং ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে। যার ফলে ইউক্রেনের বাকি ড্রোনগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সাবেক ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা স্যার রিচার্ড ব্যারনস বলছেন, ইউক্রেনকে দেয়া পশ্চিমা বিশ্বের অস্ত্রগুলো যুদ্ধে কিছুটা পার্থক্য তৈরি করতে পেরেছে, কিন্তু এর পরিমাণ – রাশিয়ার সামরিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপকতার তুলনায় অনেক কম। গত সপ্তাহে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ বলেছেন, রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর মূল লক্ষ্য এখন শুধু ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলই নয়, বরং তারা এখন দক্ষিণে খেরসন ও জাপোরিঝঝিয়ার দখলের দিকেও তাদের অভিযান কেন্দ্রীভূত করছে। রাশিয়ার তাস সংবাদ সংস্থার এক খবরে বলা হয়েছে, খেরসন শহরকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাশিয়ার সাথে যুক্ত করার জন্য শহরের কর্মকর্তারা সাম্প্রতিক কয়েক দিনে একটি গণভোট অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়েছেন। এর জন্য কর্তৃপক্ষ একটি নির্বাচন কমিটি গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলে জানানো হয়েছে।
রাশিয়া গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেয়ায় আরও সঙ্কটে এশিয়া : রাশিয়া ইউরোপে তাদের প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেয়ায় বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম আরও বেড়েছে। এটি এশিয়ায় জ্বালানি নিরাপত্তাকে আরও অস্থিতিশীল করার হুমকি দেয় এবং এ অঞ্চলে তরল প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) ব্যবহার কমে যেতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। বুধবার, রাশিয়ার রাষ্ট্র-চালিত গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম নর্ড স্ট্রিম ১ এর মাধ্যমে ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ আরও ২০ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছে। তারা এর জন্য টারবাইন সমস্যাকে দায়ী করলেও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কর্মকর্তারা একে ‘রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন।
এ খবরে ইউরোপে এলএনজি ফিউচার ১০ শতাংশের মতো উল্লম্ফন করেছে, যখন উত্তর এশিয়ায় স্পট মূল্য মার্চের পর থেকে তাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের ইউটিলিটিগুলি উদ্বিগ্ন যে, ইউরোপ আসন্ন শীতকালের জন্য আরও গ্যাস মজুদ করবে এবং তারা যতটা সম্ভব এলএনজি কার্গোগুলিকে সুরক্ষিত করার জন্য দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। যদিও অতীতে এলএনজি মূল্যের উল্লেখযোগ্য আঞ্চলিক পরিবর্তন বিদ্যমান ছিল, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাজারটি ক্রমবর্ধমানভাবে বিশ্বায়ন হয়েছে। চীন, জাপানের মতো দুই একটি দেশ ছাড়া ইউরোপের সাথে পাল্লা দিয়ে এশিয়ার বাকি দেশগুলো গ্যাস কিনতে পারবে না। ফলে আগামী দিনগুলোতে এশিয়ায় জ্বালানি সঙ্কট আরও তীব্র হবে।
রাশিয়ানদের ভিসা প্রদানে কোন নিষেধাজ্ঞা নেই : ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিয়ম রাশিয়ান নাগরিকদের শেনজেন ভিসা প্রদানের উপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার অনুমতি দেয় না। বৃহস্পতিবার ফিনল্যান্ডের হেলসিংগিন সানোমাট সংবাদপত্র ইউরোপীয় কমিশনের প্রতিক্রিয়া উদ্ধৃত করে রিপোর্ট করেছে। ‘ভিসা সর্বদা নির্দিষ্ট শ্রেণীর আবেদনকারীদের জন্য উপলব্ধ হওয়া উচিত। ভিসার আবেদনগুলো প্রক্রিয়াকরণ করা (ইইউ) সদস্য রাষ্ট্রগুলোর দায়িত্ব যারা কেস-বাই-কেস ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য,’ ইউরোপীয় কমিশনকে উদ্ধৃত করে সংবাদপত্রটি বলেছে। ব্রাসেলস পুনর্ব্যক্ত করেছে যে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞাগুলো সাধারণ রাশিয়ানদের উদ্দেশ্যে দেয়া হয়নি। তবে তারা নতুন বিধিনিষেধগুলি একত্রিত করার সময় ভিসা সমস্যাটি উত্থাপিত হয়েছে কিনা তার উত্তর দিতে অস্বীকার করেছে।
তুরস্কের সিগন্যালের অপেক্ষায় ইউক্রেন : ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কি গতকাল জানিয়েছেন, নিজেদের বন্দর ব্যবহার করে বিশ্ব বাজারে শস্য রপ্তানি করতে প্রস্তুত আছে ইউক্রেন। এখন তারা তুরস্ক ও জাতিসংঘের সিগন্যালের অপেক্ষায় আছেন। প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে জানানো হয়েছে, জেলেনস্কি কৃষ্ণ সাগরের বন্দর ওডেসার চর্নোমোর্স্কে গিয়েছিলেন। সেখানে শস্য রপ্তানির প্রস্তুতির বিষয়টি দেখতে গেছেন তিনি।
জেলেনস্কি শস্য রপ্তানির ব্যাপারে বলেছেন, আমাদের পক্ষ (ইউক্রেন) পুরোপুরি প্রস্তুত। আমরা আমাদের মিত্র তুরস্ক এবং জাতিসংঘকে সব সিগন্যাল পাঠিয়েছি। আমাদের সামরিক গ্যারান্টি এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতির বিষয়টি জানিয়েছি। তিনি আরও বলেছেন, অবকাঠামো মন্ত্রী জাতিসংঘ এবং তুরস্কের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগে আছেন। শস্য রপ্তানি শুরু করতে আমরা এখন তুরস্ক ও জাতিসংঘের সিগন্যালের অপেক্ষায় আছি।
তাইওয়ানের বিষয়ে এক চীন নীতি সমর্থন করে রাশিয়া : তাইওয়ানে ইস্যুতে বেইজিংয়ের ‘এক চীন’ নীতিকে সমর্থনের কথা জানিয়েছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ। গতকাল তাসখন্দে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা জানান। তিনি বলেন, ‘এক চীনের অস্তিত্বের বিষয়ে আমাদের অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে। চীনের সার্বভৌমত্বের নীতিকে সমুন্নত রাখার প্রশ্নে আমাদের কোনো ভিন্ন নীতি নেই।’
ইউক্রেনের ৩৫৯টি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস : ইউক্রেনে ‘সামরিক অভিযান’ শুরুর পর থেকে দেশটির ৩৫৯টি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংসের কথা জানিয়েছে রাশিয়া। রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বৃহস্পতিবার এ তথ্য জানায়। রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইগোর কোনাশেনকভ দাবি করেন, ইউক্রেনের সেনাবাহিনী ‘উল্লেখযোগ্য’ ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। এ ছাড়া খেরসন অঞ্চলে সাম্প্রতিক হামলায় দেশটির ৭০ সেনা ও পাঁচের বেশি সাঁজোয়া যান ধ্বংস হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় নয়টি হেডকোয়ার্টার, ছয়টি গোলাবারুদের গুদাম এবং এস-৩০০ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে। কোনাশেনকভ বলেন, এ সময়ের মধ্যে ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর তিন ড্রোন ভূপাতিত করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এ পর্যন্ত রাশিয়া ইউক্রেনের ২৬০টি যুদ্ধবিমান, ১৪৫টি হেলিকপ্টার, এক হাজার ৬২৫টি ড্রোন, ৩৫৯টি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, চার হাজার ১৭২টি ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান, ৭৬৪টি মাল্টি-ব্যারেল রকেট লঞ্চার, তিন হাজার ২০৭টি হুইটজার ও মর্টার এবং চার হাজার ৫১৫টি বেসরকারি সামরিক যান ধ্বংস করা হয়েছে। সূত্র : তাস, আল-জাজিরা, ফোর্বস, বিবিসি নিউজ, এপি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।