জুমবাংলা ডেস্ক : এক ইউটিউব চ্যানেল থেকেই চলতি বছর ১০ বার সজীব ওয়াজেদ জয়ের গ্রেপ্তার হওয়ার গুজব রটিয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি ফ্যাক্টচেক সংস্থা রিউমর স্ক্যানার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গহীনের বার্তা নামক একটি ইউটিউব চ্যানেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তার আইসিটিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় যুক্তরাষ্ট্রে গ্রেপ্তার হয়েছেন এমন দাবিতে চলতি বছর ১০টি ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে। অথচ জয়ের গ্রেপ্তারের কোনো তথ্য গণমাধ্যম বা নির্ভরযোগ্য সূত্রেই আসেনি।
এসব ভিডিওতেও এই দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। থাম্বনেইলে জয়ের গ্রেপ্তারের এডিটেড ছবি এবং ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিদের অপ্রাসঙ্গিক আলোচনার ফুটেজ সংগ্রহ করে এই দাবিটি প্রচার করা হয়েছে।
জয়ের গ্রেপ্তার প্রসঙ্গে যে ১০টি ভিডিও প্রকাশ করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে দুটি জানুয়ারিতে, ৪টি ফেব্রুয়ারিতে, ৩টি মার্চে এবং একটি চলতি মাসে প্রকাশিত হয়েছে। এসব ভিডিও বিশ্লেষণ করে স্বতন্ত্র কোনো ব্যক্তিকে ভিডিওগুলোতে দেখা যায়নি।
চ্যানেল কর্তৃপক্ষ এসব ভিডিওতে নিজেদের কোনো মতামতও দেননি। ইউটিউবের বিভিন্ন চ্যানেলের ভিন্ন ভিন্ন বক্তার ভিডিও সংগ্রহ করে এসব ভিডিওতে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে ইউটিউবের ৯টি চ্যানেলের ১৫টি ভিডিওকে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিডিও নেওয়া হয়েছে নাগরিক টিভি নামের একটি চ্যানেল থেকে।
সংগৃহীত ভিডিওগুলো পর্যবেক্ষণ করে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট দেখেছে, এসব ভিডিওর কোনোটিতে সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ এবং এফবিআইয়ের এক কর্মকর্তার এ-সংক্রান্ত কথিত একটি নথি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, কোনোটিতে শেখ হাসিনার গত বছরের যুক্তরাষ্ট্র সফর নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
কোনো ভিডিওতে দাবি করা হয়েছে এফবিআই তদন্ত করছে জয়ের বিষয়ে, কোনোটিতে বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহারের অনুমতি পাওয়া প্রসঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যসহ অপ্রাসঙ্গিক বিভিন্ন ভিডিওর মাধ্যমে শিরোনাম এবং থান্বনেইলে দাবিটি প্রচার করা হয়েছে।
তবে একটি ভিডিওতে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বক্তা জ্যাকব মিল্টনকে বলতে শোনা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে জয় ১৪ বার গ্রেপ্তার হয়েছেন।
এই ভিডিওটি সংগ্রহ করা হয়েছে ২০২২ সালের ২৩ নভেম্বর নাগরিক টিভির ইউটিউবে প্রকাশিত একটি ভিডিও থেকে। যদিও এই দাবির পক্ষে প্রায় দেড় বছরের পুরোনো এই অনুষ্ঠানে কোনো তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি।
আরেকটি ভিডিও যেটিও নাগরিক টিভির গত ৩ মে এর একটি অনুষ্ঠান থেকে নেওয়া হয়েছে, সেখানে উপস্থাপক নাজমুস সাকিবকে দাবি করতে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র এবং কাতার এই দুই দেশে জয় আইনি ঝামেলায় পড়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাকে প্যারোলে মুক্তি নিয়ে আসতে হয়েছে এমন দাবিও উপস্থাপন করতে দেখা গেলেও জনাব সাকিব এসব বিষয়ে কোনো প্রমাণ দেখাননি তার অনুষ্ঠানে। অর্থাৎ, চলতি বছরে প্রকাশিত গহীনের বার্তা চ্যানেলটির ভিডিওগুলোতে কোনো তথ্যপ্রমাণই ছাড়াই জয়ের গ্রেপ্তার হওয়ার দাবিটি প্রচার করা হয়েছে।
গহীনের বার্তা নামের চ্যানেলটিতে চলতি বছর যে কয়টি ভিডিওর মাধ্যমে সজীব ওয়াজেদ জয়ের গ্রেপ্তারের দাবি প্রচার করা হয়েছে তার মধ্যে প্রথম প্রকাশিত ভিডিওটি পাওয়া যায় ৫ জানুয়ারি।
রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন এসব ভিডিও সম্পর্কে অনুসন্ধান করে জানায়, ‘জেল বন্দি জয় চোরা ওয়াশিংটন ডিসিতে’ শিরোনামে প্রকাশিত এই ভিডিওটি সংগ্রহ করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী এম রহমান মাসুমের ইউটিউব চ্যানেল Channel US Bangla থেকে। মাসুমের চ্যানেলে ভিডিওটি এখন আর নেই। তবে তিনি ভিডিওটির লিংক তার ফেসবুক পেজে শেয়ার করেছিলেন যা এখনো সচল রয়েছে।
তার ভিডিওটি ডাউনলোড করে সেদিনই ইউটিউবের আরেকটি চ্যানেলে প্রকাশ করা হয়েছে। মাসুম তার ভিডিওতে দেওয়া বক্তব্যে দাবি করেন, জয়ের বাজেয়াপ্ত হওয়া ৩০০ মিলিয়ন ডলার মামলার নথি প্রকাশ করা হয়েছে সেদিন অর্থাৎ ৫ জানুয়ারি।
তিনি বলেন, এটি প্রকাশ করেছেন New York Voice-নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলের মালিক নাজমুল হাসান বাবু নামে এক ব্যক্তি।
একইদিন নিউইয়র্ক ভয়েস চ্যানেলে প্রকাশিত ভিডিওটিতে দেখা যায়, নাজমুল হাসান একটি নথির ছবি দেখান, দাবি করেন শেখ হাসিনা ও জয়ের বাজেয়াপ্ত হওয়া ৩০০ মিলিয়ন ডলারের বিষয়ে ওয়াশিংটনে হওয়া মামলার নথি এটি। অনুসন্ধানে জানা গেছে, একই নথির ছবি অন্তত ৪ জানুয়ারি থেকেই ফেসবুকে পোস্ট হচ্ছিল।
শিরোনামের এই নথিটি ডেবরা লাপ্রেভোট্টে নামে এক নারী প্রস্তুত করেছেন। কেস আইডি উল্লেখ করা হয়েছে, 275-WF-237566। নথিটি পড়ে জানা যাচ্ছে, ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে ডেবরা লাপ্রেভোট্টের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের (ডিওজে) সিনিয়র ট্রায়াল অ্যাটর্নি লিন্ডা স্যামুয়েলস যোগাযোগ করেছিলেন।
লিন্ডা বাংলাদেশ থেকে চুরি হওয়া ফান্ড যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলোতে পাচারের সঙ্গে জড়িত একটি অভিযোগের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) ওয়াশিংটন ফিল্ড অফিসকে সহায়তার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। লিন্ডা জানান, বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ২০০৭ সালের জুলাই মাসে দুর্নীতির দায়ে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং শেখ হাসিনার চুরি করা বা চাঁদাবাজির কিছু অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকে বা তার মাধ্যমে পাচার করা হয়েছিল। এর পাশাপাশি তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ও যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ পাচার করেছেন।
নথিতে উল্লেখ করা হয়, শেখ হাসিনা ৩০০,০০০,০০০ ডলারের বেশি চুরি করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মার্কিন বিচার বিভাগের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে তদন্তের জন্য এফবিআইয়ের ওয়াশিংটন ফিল্ড অফিসকে অনুরোধ করার তথ্য উল্লেখ রয়েছে এই নথিতে।
এর প্রেক্ষিতে ২০০৮ সালের ৪ জানুয়ারি ডেবরা লাপ্রেভোট্টের সঙ্গে ডিওজের একটি মিটিং নির্ধারিত রয়েছে বলেও জানানো হয় নথিতে।
এই নথি থেকে জানা যায়, এটি সাম্প্রতিক সময়ের কোনো নথি নয়। বিশেষ করে, এই নথিতে থাকা অন্তত দুটি তথ্য এই সন্দেহের পক্ষেই যায়। যেমনঃ নথিতে শেখ হাসিনাকে ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী’ বলে সম্বোধন করা হয়েছে, এও উল্লেখ আছে- ২০০৭ সালের জুলাইয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই গ্রেপ্তার হন শেখ হাসিনা। ২০০৮ সালের ১১ জুন তিনি মুক্তি পান। অন্যদিকে, নথিতে ২০০৮ সালের জানুয়ারিতে নির্ধারিত একটি মিটিংয়ের বিষয়েও বলা হয়েছে। এই বিষয়গুলো থেকে প্রতীয়মান হয়েছে, নথিটি ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে প্রস্তুত করা হয়েছিল।
নথিতে দুজন ব্যক্তির নাম উল্লেখ আছে, ডেবরা লাপ্রেভোট্টে এবং মার্কিন বিচার বিভাগের (ডিওজে) সিনিয়র ট্রায়াল অ্যাটর্নি লিন্ডা স্যামুয়েলস। জানা গেছে, লিন্ডা স্যামুয়েলস ২০১৩ সালে মারা গেছেন। অন্যদিকে, ডেবরা লাপ্রেভোট্টে ১৯৯৫ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত এফবিআইয়ের সুপারভাইসরি স্পেশাল এজেন্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের পক্ষ থেকে ডেবরা লাপ্রেভোট্টের কাছে এই নথির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি মার্কিন বিচার বিভাগ (ডিওজে) কর্তৃক ২০০৯ সালের ৯ জানুয়ারি প্রকাশিত একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠান। এই বিজ্ঞপ্তিতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর কয়েকটি ব্যাংক হিসাবের বিরুদ্ধে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানানো হয়। এই ব্যাংক হিসাবগুলোতে ৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার জমা ছিল। এ বিষয়ে মামলার নম্বর 1:09-cv-00021(JDB)।
ডেবরা রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিটকে বলেছেন, জয় এবং শেখ হাসিনার নামে থাকা নথিতে যে অভিযোগ উল্লেখ আছে তার বিপরীতে কোনো তথ্যপ্রমাণ তারা সে সময় পাননি। জয় ২০১৬ সালে এক ফেসবুক পোস্টেও একই তথ্য জানান।
অর্থাৎ, সজীব ওয়াজেদ জয় এবং শেখ হাসিনার বিষয়ে প্রচারিত নথিটি কোনো মামলার নথি নয়, এটি শুধু একটি অভিযোগপত্র ছিল।
যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও প্রশংসা অর্জন করেছে
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।