বাংলাদেশ ও ইতালির মধ্যে সম্প্রতি সই হওয়া সমঝোতা স্মারক (MoU) বৈধ অভিবাসন প্রসঙ্গে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। এই চুক্তিটি দুই দেশের মধ্যে প্রথমবারের মতো এমন একটি পদক্ষেপ যেখানে অবৈধ অভিবাসন ও মানবপাচার বন্ধ করার পাশাপাশি বৈধ অভিবাসনের পথ সুগম করার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছে। ইতালির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাত্তেও পিয়ান্তেদোসি এবং বাংলাদেশের পক্ষে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল এই ঐতিহাসিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ইতালি বর্তমানে বাংলাদেশের প্রধান শ্রমবাজারগুলোর একটি এবং এই চুক্তির ফলে সেখানে আরও বেশি বাংলাদেশি শ্রমিকের বৈধভাবে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
ইতালি ও বাংলাদেশের মধ্যে বৈধ অভিবাসন চুক্তির প্রেক্ষাপট
ইতালি সবসময়েই বাংলাদেশের শ্রমবাজারের একটি গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ২০২০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ইতালিতে বৈধভাবে ২৬,৩৩৩ জন বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগ পেয়েছেন। ২০২৩ সালেই এক বছরে ৮,০০০-এর বেশি শ্রমিক দেশটিতে গেছেন, যা প্রমাণ করে যে দুই দেশের মধ্যে শ্রমবাজার কতটা সক্রিয়। তবে এতদিন পর্যন্ত এই অভিবাসনের ধারা একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর অধীনে ছিল না। এবারের MoU সেই কাঠামোর অভাব পূরণ করেছে। এখন থেকে সিজনাল ও নন-সিজনাল উভয় ধরণের ওয়ার্কাররা আরও সহজে ইতালিতে কাজের সুযোগ পাবেন।
Table of Contents
এই চুক্তির মাধ্যমে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, যারা নিয়মিতভাবে অভিবাসন বিষয়ক উন্নয়ন এবং সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবে। এর পাশাপাশি ইতালিকে অনুরোধ করা হয়েছে বাংলাদেশের একটি বা দুটি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য, যাতে তারা দক্ষতা উন্নয়ন এবং ইতালিয়ান ভাষা শিক্ষায় অবদান রাখতে পারে।
আজকের আবহাওয়ার খবর: ফের তাপপ্রবাহের আভাস ও সম্ভাব্য বৃষ্টিপাতের বিস্তারিত বিশ্লেষণ
বাংলাদেশি অভিবাসীদের জন্য সম্ভাব্য সুফল
এই চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশি অভিবাসীরা নানা দিক থেকে উপকৃত হবেন। প্রথমত, অবৈধ পথে ইউরোপে যাওয়ার ঝুঁকি কমবে এবং এতে করে প্রাণহানি, গ্রেপ্তার এবং কম মজুরির মতো সমস্যা থেকেও রক্ষা পাওয়া যাবে। বৈধ অভিবাসনের সুযোগ যত বাড়বে, তত বেশি মানুষ নিরাপদ ও আইনসম্মত পথে পাড়ি জমাতে আগ্রহী হবে।
দ্বিতীয়ত, ইতালি কর্তৃপক্ষ বিদ্যমান কোটার বাইরে আরও নতুন কোটা বাড়ানোর চিন্তাভাবনা করছে। এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে। তৃতীয়ত, স্কলারশিপ সংখ্যা বাড়ানো এবং ‘হাই-রিস্ক’ তালিকা থেকে বাংলাদেশের নাম বাদ দেওয়ার প্রস্তাবও ইতালিকে দেওয়া হয়েছে, যা শিক্ষার্থী এবং পর্যটকদের জন্য সুবিধাজনক হবে।
অভিবাসন নীতির মানবিক দিক এবং চ্যালেঞ্জ
চুক্তিটি শুধু অর্থনৈতিক সম্ভাবনার ক্ষেত্রেই নয়, বরং একটি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিও উপস্থাপন করে। প্রতি বছর অনেক বাংলাদেশি উন্নত জীবনের আশায় অবৈধ পথে ইউরোপে পাড়ি জমায়, যার ফলে অনেকেই দুর্ঘটনায় পড়ে কিংবা মানবপাচারের শিকার হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে এমন ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসনের সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
তবে এটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। যেমন, কোটা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ইতালির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বড় ভূমিকা রাখবে। একই সঙ্গে অভিবাসীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও ভাষাজ্ঞানের অভাব থাকলে তারা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়তে পারে। এজন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আরও বেশি ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন এবং ইতালির সঙ্গে সমন্বয়ে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালানো প্রয়োজন।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের কৌশল
এই চুক্তির পরপরই যেসব বিষয়ে ফোকাস দেওয়া জরুরি তা হলো—১) যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ সক্রিয় করা, ২) কোটা বৃদ্ধির বিষয়ে ইতালির সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা, ৩) ভাষা ও দক্ষতা প্রশিক্ষণের জন্য উপযুক্ত সেন্টার নির্ধারণ এবং ৪) প্রবাসীদের জন্য সহায়ক আইনগত কাঠামো তৈরি করা। এসব দিক ঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে দুই দেশের মধ্যে অভিবাসন সম্পর্ক আরও মজবুত হবে।
তথ্য অনুসারে, বর্তমানে ইউরোপের ৪২টি দেশে বাংলাদেশি কর্মীরা কাজ করছেন এবং এর মধ্যে ইতালি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য। তাই এই MoU শুধু একটি কাগজে সই করা চুক্তি নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য এক সুদূরপ্রসারী কৌশলও।
বিশেষ অনুরোধ এবং কূটনৈতিক উদ্যোগ
চুক্তির সময় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি অনুরোধ জানানো হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো:
- ভিসা প্রক্রিয়া দ্রুততর করা
- শিক্ষার্থীদের জন্য স্কলারশিপ সংখ্যা বাড়ানো
- বাংলাদেশকে ‘হাই-রিস্ক’ তালিকা থেকে বাদ দেওয়া
ইতালি এই সব প্রস্তাব বিবেচনা করবে বলে জানিয়েছে। এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন হলে দুই দেশের সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় হবে।
সতর্কতা ও দায়িত্বশীল অভিবাসন
সরকারি চুক্তি থাকার পরও ব্যক্তিগত পর্যায়ে সচেতনতা থাকা অত্যন্ত জরুরি। অনেক সময় দালালচক্র এবং ভুয়া এজেন্সি অভিবাসনের নামে প্রতারণা করে থাকে। তাই যারা ইতালিতে কাজ করতে আগ্রহী, তাদের অবশ্যই সরকার অনুমোদিত এজেন্সির মাধ্যমে আবেদন করা উচিত এবং যথাযথ প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা উচিত।
এই সমঝোতা স্মারকটি ‘ইতালি’ সম্পর্কে বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীদের জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।
FAQs
- ইতালিতে কাজের জন্য কীভাবে আবেদন করা যায়?
সরকার অনুমোদিত এজেন্সির মাধ্যমে আবেদন করতে হবে। বিএমইটি-এর ওয়েবসাইটে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। - এই চুক্তির ফলে কী নতুন ভিসা সুবিধা আসবে?
হ্যাঁ, কোটা বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে এবং ভিসা প্রক্রিয়া আরও সহজ করা হতে পারে। - বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা কি স্কলারশিপ পাবে?
চুক্তিতে স্কলারশিপ সংখ্যা বাড়ানোর অনুরোধ করা হয়েছে, যা ইতালি বিবেচনা করবে। - ইতালিয়ান ভাষা জানা কি আবশ্যক?
ভাষা জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে সিজনাল ওয়ার্কারদের জন্য। প্রশিক্ষণ সেন্টারে ভাষা শিক্ষা দেওয়া হবে। - এই চুক্তি কবে থেকে কার্যকর হবে?
চুক্তি ইতিমধ্যেই সই হয়েছে এবং যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের মাধ্যমে দ্রুত কার্যক্রম শুরু হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।