স্পোর্টস ডেস্ক : ইতিহাস আর ঐতিহ্যের মানদণ্ডে অ্যাশেজই ক্রিকেটের সেরা দ্বৈরথ। এটি ঐতিহাসিকেরাই বলেন। কোনো দ্বিপাক্ষিক সিরিজ কি দেড় শতকেরও বেশি সময় ধরে চলেছে? অ্যাশেজ চলছে সগৌরবে। ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের এ যুগে টেস্ট ক্রিকেটের রং খানিকটা ফিকে হয়ে গেলেও এই অ্যাশেজই দায়িত্ব নিয়ে টেস্টকে রাঙিয়ে দিয়ে যায় বারবার। টেস্টপ্রেমীরাও অমিয় সুধা পানের আশায় বসে থাকেন প্রতি বছর, কখন আসবে অ্যাশেজ!
আগামীকাল ক্রিকেটের প্রাচীনতম এই অধ্যায়ের আরেকটি পর্বের শুরু হতে যাচ্ছে। এ সময় ইতিহাসের পাতায় থাকা আলোচিত সিরিজগুলোও কিন্তু উঁকি দিয়ে যায় ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে।
১৯৩২-৩৩: বডিলাইন সিরিজ
১৯৩০-এর অ্যাশেজে ১৩৯.১৪ গড়ে ৯৭৪ রান করে ব্র্যাডম্যান একাই ইংরেজদের স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দিয়ে অস্ট্রেলিয়াকে সিরিজ জেতান ২-১ এ। ১৯৩২-৩৩-এর পরের অ্যাশেজে ইংলিশরা ভালোভাবেই বুঝতে পারে, ব্র্যাডম্যানকে থামানো আর অ্যাশেজ জয় একই সুতোয় গাঁথা। ব্র্যাডম্যানকে থামানোর উপায় খুঁজতে গিয়েই জন্ম নিল ক্রিকেটের এক বিতর্কিত ইতিহাসের।
ইংলিশ অধিনায়ক ডগলাস জার্ডিন আগের অ্যাশেজেই লক্ষ্য করেছিলেন, লেগ স্টাম্পে লাফিয়ে ওঠা বল খেলতে সমস্যা হচ্ছে ব্র্যাডম্যানের। অন্যান্য ব্যাটসম্যানরাও এমন বলে তেমন সুবিধা করতে পারছেন না। সেই সূত্র ধরেই তাঁর মাথায় এল বডিলাইন বা ‘ফার্স্ট লেগ’ তত্ত্ব। জার্ডিনের সেই তত্ত্বের প্রয়োগ ঘটান তাঁর দুই ফাস্ট বোলার হ্যারল্ড লারউড ও বিল ভোস। বডিলাইনের ধারণাটি নতুন কিছু না হলেও ১৯৩২-৩৩-এর অ্যাশেজে সাফল্যের নেপথ্যে ছিল ইংরেজ ফাস্ট বোলারদের দ্রুত গতির নিখুঁত ও আগ্রাসী বোলিং।
ব্র্যাডম্যানদের থামানোর টোটকাটা ছিল একদম সহজ। ব্যাটসম্যানের শরীর লক্ষ্য করে একের পর এক গোলার মতো বল ছুড়তে থাকো, উইকেট আপনা-আপনি চলে আসবে। তৎকালীন প্রেক্ষাপটে লেগ সাইডে ফিল্ডারের সর্বোচ্চ সংখ্যা নিয়ে কোনো বিধি-নিষেধ ছিল না, ছিল না এখনকার মতো নিরাপত্তা সরঞ্জামের এত ব্যবহার। হেলমেট, এলবো গার্ড, থাই গার্ড ও চেস্ট গার্ডের প্রচলন ছিল না তখন। এমন অবস্থায় লারউড-ভোসরা ব্যাটসম্যানের লেগ সাইডে চার-পাঁচ জন ফিল্ডার রেখে তাঁর শরীর লক্ষ্য করে নিখুঁত লাইন লেংথে ক্রমাগত একেকটি গোলা ছুড়তে লাগলেন। শরীরের দিকে গোলার মতো ধেয়ে আসা বলের আঘাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে গিয়ে ব্যাটসম্যানরা ক্যাচ দিতে থাকলেন কাছেই ওত পেতে থাকা ফিল্ডারকে।
ইংল্যান্ড ফল পেল হাতেনাতে। বিল উডফুল-বার্ট ওল্ডফিল্ডরা আঘাত পেয়ে মাঠ ছাড়েন। ব্র্যাডম্যান দুই দল মিলিয়ে সর্বোচ্চ রান সংগ্রহ করলেও তা যথেষ্ট ছিল না। ইংল্যান্ড সিরিজ জিতে নেয় ৪-১ ব্যবধানে।
ইংল্যান্ডের এই কৌশল নিয়ে তখন থেকেই চলে তর্ক-বিতর্ক। যদিও বডিলাইন বোলিং জার্ডিনের আগেও ছিল, তবে তা কখনোই ১৯৩২-৩৩ অ্যাশেজের মতো এতটা ‘খ্যাতি’ অর্জন করেনি। ইতিহাসের পাতায় এ কারণেই এখনো অমর হয়ে আছে সেই অ্যাশেজ।
১৯৪৮: ব্র্যাডম্যানের অনন্ত আক্ষেপ
শিরোনাম পড়লে মনে হতে পারে ১৯৪৮ অ্যাশেজে হয়তো অস্ট্রেলিয়া হেরে গিয়েছিল। কিন্তু না। ইংল্যান্ডকে ৪-০ ব্যবধানে গুঁড়িয়ে দিয়ে অ্যাশেজ জিতে নিয়েছিল ব্র্যাডম্যানের অজেয় অস্ট্রেলিয়া। খেলোয়াড় হিসেবে সেটাই ছিল ব্র্যাডম্যানের শেষ সিরিজ। সিরিজের প্রথম চার টেস্টের মধ্যে তিনটিতেই দোর্দণ্ড প্রতাপে জিতে সিরিজ পকেটে পুরে নেওয়ার কারণে শেষ টেস্ট থেকে একটা জিনিস ছাড়া অস্ট্রেলিয়ার চাওয়ার কিছু ছিল না। আর সেটা হল অধিনায়ক ব্র্যাডম্যানের ১০০ গড়।
শেষ টেস্টে মাত্র চার রান করতে পারলেই ব্র্যাডম্যানের ব্যাটিং গড় একদম কাঁটায়-কাঁটায় একশ’ হয়ে যেত। কিন্তু সেটা হলো কোথায়? প্রথম ইনিংসে মাত্র ৫২ রানে অলআউট হয় ইংল্যান্ড, জবাব দিতে নেমে আর্থার মরিসের ব্যাটে চড়ে নিজেদের প্রথম ইনিংসে ৩৮৯ রান তোলে অস্ট্রেলিয়া। তবে সে ইনিংসে মরিসকে ছাপিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হলো অধিনায়ক ব্র্যাডম্যানকে নিয়ে। স্পিনার এরিক হোলিসের এক গুগলি বুঝতে না পেরে শূন্য রানে আউট হয়ে গিয়েছিলেন যে তিনি! পরের ইনিংসে ১৮৮ রানে অলআউট হয়ে যায় ইংল্যান্ড, ফলে নিজেদের দ্বিতীয় ইনিংসে আর ব্যাট করার দরকার হয়নি অস্ট্রেলিয়ার। ব্র্যাডম্যানও আর চার রান করার সুযোগ পাননি। অনন্ত আক্ষেপের জন্ম দিয়ে ব্র্যাডম্যানের গড় আটকে যায় সেই ৯৯.৯৪ তেই!
১৯৭৪-৭৫: টমসনের দৌরাত্ম্য
আগের টেস্টে টমসন ১১০ রান দিয়ে উইকেট পাননি কোনো। তাও অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচকেরা আস্থা রেখেছিলেন ফাস্ট বোলার জেফ ডমিনেট ওপর। সেই আস্থার প্রতিদান কি দুর্দান্তভাবেই না দিয়েছিলেন টমসন! প্রথম চার টেস্টে একাই ১৭.০৩ গড়ে ৩৩ উইকেট তুলে নেন। অ্যাডিলেডে হওয়া চতুর্থ টেস্টে কাঁধের চোটে পড়ে দল থেকে ছিটকে যান এই তারকা। গোটা সিরিজে ইংল্যান্ডের একমাত্র জয় এসেছিল ডমিনেট চোট পাওয়ার পরেই। কে জানে, টমসন চোটে না পড়লে হয়তো সেবার একটা টেস্টও জেতা হতো না ইংলিশদের! অস্ট্রেলিয়ার কাছে এভাবে নাস্তানাবুদ হওয়াটা সইতে পারেননি ইংলিশ অধিনায়ক মাইক ডেনেস। সিরিজের পর অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন তিনি।
১৯৮১: বোথামের অ্যাশেজ
ইয়ান বোথামকে নিয়ে ইংলিশদের মনে প্রথম থেকেই অনেক আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল। ১৯৮০ সালের দিকে ‘বুড়ো’ অধিনায়ক মাইক ব্রিয়ারলি যখন খেলোয়াড়ি জীবন থেকে অবসর নিলেন, ব্যাটে-বলে সব্যসাচী তরুণ বোথামের কাঁধে নেতৃত্বভার সঁপে দিয়ে ইংল্যান্ড নতুন যুগে প্রবেশ করল। অর্থনৈতিক দৈন্য ও জাতিগত দাঙ্গার আগুনে পুড়তে থাকা ইংল্যান্ড তরুণ বোথামের নেতৃত্বে ক্রিকেট-সাফল্যের শিখরে আরোহণ করবে, এমনটাই আশা ছিল ইংলিশদের।
কিন্তু তা আর হলো কোথায়? অধিনায়কত্ব পাওয়ার আগে রান ও উইকেটের ফুলঝুরি ছোটানো বোথাম নেতৃত্বভার পেয়েই যেন মিইয়ে গেলেন। ১৯৮১ সালের অ্যাশেজ শুরু হওয়ার আগে বোথামের নেতৃত্বে ইংল্যান্ড দশ টেস্ট খেলে ড্র করল সাতটি, হারল তিনটিতে। জয়ের দেখা নেই। বোথামও যেন ব্যাট-বল করতে ভুলে গেলেন। অ্যাশেজের প্রথম দুই টেস্টের একটায় ড্র করল, আরেকটায় হারল ইংল্যান্ড। ‘অধিনায়ক’ বোথামের ওপর আস্থা হারাল ইংল্যান্ড বোর্ড, নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য অবসর থেকে ফিরে আসলেন মাইক ব্রিয়ারলি। ইংল্যান্ড কী ঘুণাক্ষরেও ভেবেছিল, তাদের এই এক সিদ্ধান্ত পরবর্তীতে কতটা ‘ঐতিহাসিক’ হিসেবে বিবেচিত হবে?
ব্রিয়ারলির অধীনে নিজেকে যেন আবার নতুন করে ফিরে পেলেন বোথাম। হেডিংলিতে তৃতীয় টেস্টে প্রথম ইনিংসে নিলেন ছয় উইকেট, তাও অস্ট্রেলিয়ার চারশ’ ছাড়ানো স্কোর করতে সমস্যা হলো না। নিজেদের প্রথম ইনিংসে ব্যাট করতে নেমে ইংল্যান্ড করল ১৭৪। ব্যাটসম্যানদের আসা-যাওয়ার মিছিলে শুধু বোথামই ছিলেন সফল, ৫৪ বলে ৫০ রান করেছিলেন তিনি। ফলোঅনে পড়ল ইংল্যান্ড। দ্বিতীয় ইনিংসেও একই দশা, ১৩৫ রান তুলতে গিয়ে ৭ উইকেট হারিয়ে ইংল্যান্ড তখন রীতিমতো ধুঁকছে। কিন্তু বোথাম যে এই ম্যাচকেই ফিনিক্স পাখির মতো জেগে ওঠার উপলক্ষ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন!
দ্বিতীয় ইনিংসে দুই বোলার গ্রাহাম ডিলি আর ক্রিস ওল্ডকে সঙ্গী করে খেললেন ১৪৯ রানের মহাকাব্যিক এক ইনিংস। যে ম্যাচে ইংল্যান্ডের ইনিংসে হারার কথা ছিল, উল্টো দ্বিতীয় ইনিংসে অস্ট্রেলিয়াকে ১৩০ রানের টার্গেট দিলেন বোথামরা। বোথামের মতো পেসার বব উইলিসও দ্বিতীয় ইনিংসে নিজের ছন্দ খুঁজে পেলেন। উইলিসের গতির কাছে আত্মসমর্পণ করলেন অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যানরা। ১১১ রানে গুটিয়ে গেল অস্ট্রেলিয়া, অবিশ্বাস্যভাবে টেস্ট জিতল ইংল্যান্ড।
শুধু হেডিংলিতেই থেমে থাকলেন না বোথাম। এজবাস্টনে ১৫১ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে অস্ট্রেলিয়া জয়ের সুবাস পাচ্ছিল, ৫ উইকেটে তুলে ফেলেছিল ১১৪ রান। বোলিং আক্রমণে এলেন বোথাম। ভয়াল এক স্পেলে স্পেলে ৫ উইকেট নিলেন মাত্র ১ রান দিয়ে। ওল্ড ট্রাফোর্ডে দ্বিতীয় ইনিংসে ১০৪ রানে ৫ উইকেট হারানোর পর নেমে ১০২ বলে ১৩ চার ও ৬ ছয়ে করলেন ১১৮ রান। যে ইনিংসটা অনেকের চোখেই বোথামের ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস। ওভালে শেষ ও ড্র হওয়া টেস্টে বোথাম নিলেন ১০ উইকেট। বোথাম-ময় সিরিজ জিতে নিল ইংল্যান্ড, ৩-১ ব্যবধানে।
২০০৫: ফ্লিনটফের বোথাম হওয়ার গল্প
সেই ১৯৮৯ সালে সর্বশেষ অ্যাশেজ জেতা ইংলিশদের আক্ষেপ আকাশ ছুঁয়েছিল যেন। ১৬ বছর ধরে অ্যাশেজ নেই, ‘ভস্মাধারের লড়াই’য়ে এই সময়টা অস্ট্রেলিয়া একটানা রাজত্ব করে গেছে কখনো স্টিভ ওয়াহ, কখনো মার্ক টেলর বা কখনো অ্যালান বোর্ডারের যোগ্য নেতৃত্বে। অস্ট্রেলিয়ার এই একপেশে কর্তৃত্বের শেষ দেখল ২০০৫ অ্যাশেজ। সাত বছর আগে টেস্ট অভিষেক হলেও এই টেস্টেই ইংলিশ অলরাউন্ডার অ্যান্ড্রু ফ্লিনটফ নিজের সামর্থ্যের সর্বোচ্চটা দেখালেন বিশ্বমঞ্চে। সঙ্গে ছিলেন কেভিন পিটারসেন নামের এক তরুণ। সারা জীবন ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনিসদের রিভার্স সুইং শিল্পকে ‘বল টেম্পারিং’ বলে নাক সিটকানো ইংলিশরা শেষমেশ অদম্য অস্ট্রেলিয়ানদের আটকাতে আশ্রয় নিল রিভার্স সুইংয়ে। ফ্লিনটফ, হার্মিসন আর সাইমন জোন্সের সেই বিষে নীল হলো অস্ট্রেলিয়ানরা। প্রথম টেস্টে বড় ব্যবধানে হারলেও বোলারদের কল্যাণে দ্বিতীয় টেস্ট জিতে নেয় ইংলিশরা। তৃতীয় টেস্টটা হারতে হারতে ড্র করল অসিরা। চতুর্থ টেস্টে নিজেকে যেন পরিপূর্ণভাবে মেলে ধরলেন ফ্লিনটফ, ইংল্যান্ডও সিরিজে এগিয়ে গেল তাতে। শেষ টেস্টে ম্যাকগ্রা-ওয়ার্নদের পিটিয়ে নিজেদের আগমনী বার্তা দিলেন পিটারসেন। আর তাতেই নিশ্চিত হয়ে গেল, ১৬ বছর পর ভস্মাধার আসছে ইংল্যান্ডে! সিরিজে ২৪ উইকেট আর ৪০২ রান করে শেন ওয়ার্নের সঙ্গে যৌথভাবে সিরিজসেরা হলেন ফ্লিনটফ।
সিরিজের আগে হুংকার দিয়েছিলেন অসি পেসার গ্লেন ম্যাকগ্রা, ‘৫-০ ব্যবধানে অ্যাশেজ জিতব আমরা’। তা তো হলোই না, উল্টো, অধিনায়ক হিসেবে প্রথম অ্যাশেজটা হার দিয়ে শুরু করলেন রিকি পন্টিং।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।