ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের জটিল ইতিহাসে নতুন এক মোড় এসেছে সাম্প্রতিক আলোচনার মধ্য দিয়ে। বহু বছর ধরে দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস ও পারস্পরিক হুমকির আবহে এখন আলোচনার টেবিলে বসছে দুই পক্ষ। ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এই আলোচনার সূচনা কেবল একটি কূটনৈতিক প্রয়াস নয়, বরং এটি হতে পারে মধ্যপ্রাচ্যের অস্থিরতা প্রশমনের এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ। এই আলোচনার আবেগঘন ও কৌশলগত দিকটি বোঝা আজকের আন্তর্জাতিক রাজনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি: উত্তপ্ত আলোচনা ও আস্থা অর্জনের চেষ্টা
ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র ইস্যুটি এক দশকের বেশি সময় ধরে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। ২০১৫ সালের ঐতিহাসিক পারমাণবিক চুক্তি (JCPOA) ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচিতে সীমা আরোপ করেছিল, যাতে বিশ্ব নিশ্চিত হয় যে দেশটি পরমাণু অস্ত্র তৈরি করবে না। তবে ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করলে উত্তেজনা পুনরায় বৃদ্ধি পায়।
Table of Contents
বর্তমানে, ইরানের হাতে রয়েছে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম, যা অস্ত্র-গ্রেড মাত্রার কাছাকাছি। বিশ্লেষকদের মতে, এটি পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রযুক্তিগত সক্ষমতার কাছাকাছি চলে এসেছে। তবে ইরান সবসময় দাবি করে আসছে যে, তাদের পরমাণু কর্মসূচি শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পরিচালিত।
এই পরিস্থিতিতে, ওমানে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান নতুন করে আলোচনায় বসেছে। উপস্থিত ছিলেন ওমানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফ এবং ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি। দুই পক্ষই পরবর্তী আলোচনার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে, যা এই প্রক্রিয়ার স্থায়িত্বের দিকেই ইঙ্গিত করে।
শান্তির পথে অগ্রগতি না কি নতুন দ্বন্দ্বের সূচনা?
যদিও এই আলোচনাগুলো কৌশলগত সাফল্যের ইঙ্গিত দেয়, তবে এগুলো ঝুঁকিমুক্ত নয়। ট্রাম্পসহ যুক্তরাষ্ট্রের কট্টরপন্থী রাজনীতিকরা হুঁশিয়ারি দিয়েছেন যে, আলোচনায় ব্যর্থ হলে তেহরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বিমান হামলার সম্ভাবনা রয়েছে। এর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ইরান জানিয়েছে, তাদের কাছে অস্ত্র-গ্রেড ইউরেনিয়ামের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে এবং তারা প্রয়োজনে প্রতিরোধে প্রস্তুত।
এই উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশে শান্তিপূর্ণ সমাধান কতটা সম্ভব, তা সময়ই বলে দেবে। তবে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাইল বাঘায়ি স্পষ্ট করে বলেছেন, ইরান কূটনৈতিক সমাধানে বিশ্বাস করে এবং তাদের জাতীয় স্বার্থই তাদের প্রথম অগ্রাধিকার।
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রও এখন ইরানকে কিছু অর্থনৈতিক ছাড় দিতে পারে, বিশেষ করে নিষেধাজ্ঞা শিথিলকরণে। তবে তার বিনিময়ে ইরান থেকে কতটা ছাড় আশা করা হচ্ছে, তা এখনও পরিষ্কার নয়। ইরান যে পুরোপুরি তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধ করবে না, তা বিশ্লেষকদের মতে প্রায় নিশ্চিত।
২০১৫ সালের চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান আলোচনা
২০১৫ সালের চুক্তিটি ছিল এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যেখানে ইরান পারমাণবিক কর্মসূচির কিছু অংশ সীমিত করার শর্তে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি পায়। কিন্তু চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে আসা ও ইরানের পুনরায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শুরু করার ফলে পুরো প্রক্রিয়া ভেঙে পড়ে।
বর্তমানে আবার আলোচনা শুরু হলেও এই প্রক্রিয়ায় আস্থা ফিরিয়ে আনা সহজ হবে না। দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিনের বৈরিতা, আঞ্চলিক রাজনীতি, ইসরায়েলের মত অবস্থান এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপ সবই এই আলোচনাকে জটিল করে তুলছে।
ইসরায়েলের উদ্বেগ ও মধ্যপ্রাচ্যের সামগ্রিক নিরাপত্তা
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন দেশগুলোর একটি ইসরায়েল। তারা বরাবরই বলে আসছে, ইরান একটি পরমাণু অস্ত্র অর্জনের চেষ্টা করছে যা পুরো অঞ্চলের জন্য হুমকি। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এর আগেও “লিবিয়া সমাধান” অর্থাৎ সরাসরি হামলা ও ধ্বংসের কথা বলেছেন।
তবে ইরান এই ধরনের অবস্থানকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছে এবং লিবিয়ার প্রাক্তন শাসক মুয়াম্মার গাদ্দাফির উদাহরণ তুলে ধরে সতর্কতা প্রকাশ করেছে। ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি বহুবার বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর অন্ধ আস্থা বিপদ ডেকে আনতে পারে।
ওমানের ভূমিকা ও কূটনৈতিক মধ্যস্থতা
ওমানের মধ্যস্থতায় এই আলোচনার সূচনা শান্তির এক সম্ভাব্য ইঙ্গিত বহন করে। অতীতে ওমান বহুবার মধ্যস্থতাকারী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এই প্রক্রিয়ার সফলতা নির্ভর করছে, কতটা গোপনীয়তা, আন্তরিকতা ও কৌশলগত বোঝাপড়ার ভিত্তিতে এটি এগিয়ে যাবে তার ওপর।
বর্তমানে আলোচনাগুলো মূলত পরোক্ষভাবে চলছে, তবে ভবিষ্যতে তা সরাসরি রূপ নিলে একে বড় সাফল্য হিসেবেই বিবেচনা করা হবে। উভয় পক্ষ যদি সত্যিই পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ ও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে আগ্রহী হয়, তবে এটি হতে পারে একটি নতুন সূচনা।
FAQs: ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে সাধারণ প্রশ্নোত্তর
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি কবে শুরু হয়?
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি শুরু হয় ১৯৫০-এর দশকে, মূলত শান্তিপূর্ণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্দেশ্যে। তবে ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর কর্মসূচিটি নতুন মাত্রা পায়।
ইরান এখন কত শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে?
বর্তমানে ইরান প্রায় ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে, যা অস্ত্র-গ্রেড মাত্রার খুব কাছাকাছি।
২০১৫ সালের চুক্তির প্রধান শর্তগুলো কী ছিল?
ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সীমিত করবে, পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে আন্তর্জাতিক তদারকি থাকবে এবং এর বিনিময়ে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করা হবে।
ইসরায়েল কেন ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ে উদ্বিগ্ন?
ইসরায়েল মনে করে ইরান পরমাণু অস্ত্র অর্জন করলে তা তাদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হতে পারে, বিশেষ করে ইরানের ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান থাকায়।
এই আলোচনার ভবিষ্যৎ কী?
সবকিছু নির্ভর করছে দুই দেশের আন্তরিকতা ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকার ওপর। তবে এখনও দীর্ঘ পথ বাকি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।