আন্তর্জাতিক ডেস্ক: বিশ্বে যেসব দেশে করোনাভাইরাস সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত হয়েছে তার মধ্যে ইরান অন্যতম। তবে ইরানের জনগণের মধ্যে প্রবল ধারণা ইরানের সরকার করোনাভাইরাস সংক্রমণের মাত্রা সম্পর্কে সঠিক ধারণা দিচ্ছে না। ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। খবর বিবিসি বাংলার।
করোনাভাইরাসে গণসংক্রমণের পর ইরানে অনেক চিকিৎসক টানা কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের একজন মোহাম্মদ। তিনি উত্তর প্রদেশের গিলানের একটি হাসপাতালে কাজ করেন।
তার সহকর্মীরা মারা গেছেন, তার বন্ধুরা মারা গেছেন এবং ১৪ দিনেও নিজের পরিবারের সাথে দেখা হয়নি তার।
এমনকি তার মেডিকেল স্কুলের সাবেক শিক্ষকও করোনাভাইরাসের একজন ভুক্তভোগী।
মোহাম্মদের ভাষ্যমতে, করোনাভাইরাস শুধু নির্দিষ্ট কোনো হাসপাতাল না বরং পুরো ব্যবস্থাকে স্থবির করে দিয়েছে।
“কর্মীদের উদ্যম কমতির দিকে, পরিবার চিন্তিত এবং আমাদের প্রচন্ড চাপের মধ্যে কাজ করতে হচ্ছে।”
ইরানে সরকারের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য দিলে তার ফলাফল হিসেবে গ্রেফতার পর্যন্ত হতে পারেন মোহাম্মদ, তাই তার নাম পরিবর্তন করে দেয়া হচ্ছে।
তবে তিনি একা নন। উত্তর প্রদেশের আরো অনেক চিকিৎসক বিবিসির সাথে কথা বলেছে এবং তারা তাদের শোচনীয় অবস্থার বর্ণনা দিয়েছে। তারা মনে করেন যে সরকার খুব খারাপ পন্থায় এই সংকট মোকাবেলা করেছে।
মোহাম্মদ বলছেন, “আমাদের মেডিকেলের কর্মীরা প্রতিদিন মারা যাচ্ছে, আমাদের পর্যাপ্ত মাস্ক নেই।”
মোহাম্মদ বিবিসিকে বলেন, “আমি জানি না কত মানুষ মারা গেছে কিন্তু সরকার নিশ্চিতভাবেই এই সংকটের মাত্রা কমিয়ে বলছে। তারা সংক্রমণের শুরু থেকেই মিথ্যা বলছে।”
ইরানের ৩১টি প্রদেশে কোভিড-১৯ ছড়াতে সময় নিয়েছে মাত্র ১৬দিন।
১৬টি দেশ দাবি করেছে তারা এমন ব্যক্তি পেয়েছে যার ভাইরাস সংক্রমণ ইরানে হয়েছিল।
ইরাক, আফগানিস্তান, বাহরাইন, কুয়েত, ওমান, লেবানন, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কানাডা, পাকিস্তান, জর্জিয়া, এস্তোনিয়া, নিউজিল্যান্ড, বেলারুশ, আজারবাইজান, কাতার ও আর্মেনিয়া এই দাবি করেছে।
ইরানের সরকার শুরু থেকেই এই সংক্রমণের মাত্রা অস্বীকার করে আসছে বলে দাবি করেন দেশটির সরকারের সমালোচকরা।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খোমেনী ১৯শে ফেব্রুয়ারি প্রথমবার ঘোষণা দেন করোনাভাইরাস নিয়ে চিন্তা করার কিছু নেই, এটা নিয়ে ইরানের শত্রুরা বাড়িয়ে বলছে।
এক সপ্তাহ পরে ইরানে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকে যখন, তখন দেশটির প্রধানমন্ত্রী হাসান রুহানি একই কথা আবারও বলেন।
“এটা ষড়যন্ত্র ও শত্রুদের ভীতি দেখানোর একটা কৌশল,” করোনাভাইরাসকে এভাবে আখ্যা দেন তিনি।
তিনি বলেন, দেশটিকে স্থবির করতে এই নকশা করা হয়েছে। ইরানীদের দৈনন্দিন স্বাভাবিক জীবনযাপন করার পরামর্শ দেন তিনি।
সম্প্রতি ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে বলা হয় করোনাভাইরাস হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি করা ‘জৈব অস্ত্র’।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা তার টুইটে লেখেন, “বায়োলোজিকাল অ্যাটাক।”
ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেব অনুযায়ী, মার্চের ২০ তারিখ ইরানে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৩০০ এবং আক্রান্তের সংখ্যা ১৮ হাজারে।
গিলান, গোলেস্তান এবং মাজারদার্ন ইরানের তিনটি সবচেয়ে সংকটময় প্রদেশ। এসব জায়গার চিকিৎসকরা বিবিসিকে জানান, করোনাভাইরাস পরীক্ষার কিট এবং অন্যান্য মেডিক্যাল সামগ্রী খুবই সীমিত সংখ্যায় দেয়া হয়েছে।
সাধারণ ঔষধ, অক্সিজেন ট্যাংক, মাস্ক এবং রক্ষাকারী গ্লাভসও সংখ্যায় কম সেখানে। ডাক্তাররা বাধ্য হয়ে অস্থায়ী হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়েছেন।
নিবিড় পরিচর্যা বিভাগের একজন চিকিৎসক বিবিসিকে বর্ণনা দিয়েছেন কীভাবে এলাকার একটি ফুটবল স্টেডিয়াম বিছানা দিয়ে ঝটপট তৈরি করা হয়েছে রোগী সামাল দিতে।
ডাক্তাররা বিবিসিকে বাস্তব অভিজ্ঞতার নিরিখে বলছে, আনুষ্ঠানিক যে সংখ্যা সরকার বলছে তা বাস্তবের চেয়ে অনেক কম।
একজন চিকিৎসক বলেছেন, “আমাদের হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ রোগী আসছে। ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত। কিন্তু আমাদের যথেষ্ট উপকরণ নেই, তাই যাদের অবস্থা খুব খারাপ তাদেরই আমরা আমলে নিয়েছি।”
তিনি আরো বলেন, গেল দুই সপ্তাহে দিনে পাঁচজন রোগী মারা গেছেন। অনেকসময় এমনও হয়েছে যতক্ষণে করোনাভাইরাস পরীক্ষার যন্ত্র এসেছে ততক্ষণে রোগী মারা গেছেন।
মেডিকেল কর্মীও কম মারা যায়নি এই ঘটনায়। মেডিকেলে কাজ করা অনেক কর্মী বলছেন, “আমরা আমাদের বহু সহকর্মী হারিয়েছি।”
এর মধ্যে একটি ঘটনা হৃদয়বিদারক। নার্জেস খানালিজাদি ২৫ বছর বয়সী একজন নার্স, তিনি ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে মারা যান।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তার ছবি ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু সরকার এটা স্বীকার করেনি যে, সে কোভিড-১৯ এ মারা যায়।
রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন সবসময়ই দেখাতে থাকে যে সাহসী একদল মেডিকেল কর্মী সহজেই কাজ করে যাচ্ছে এবং তারা ভাইরাসের সাথে লড়াই করে রোগীদের বাঁচাচ্ছে।
কিন্তু ইরানের নার্সিং সংস্থা এটা নিশ্চিত করেছে যে করোনাভাইরাসের ফলেই নার্জেসের মৃত্যুর হয়।
কীভাবে এতো দ্রুত ভাইরাস ছড়ালো
সরকার বলছে ১৯শে ফেব্রুয়ারি দুজন ‘প্যাশেন্ট জিরো’ ছিল, যাদের একজন কোম শহরে মারা যান।
‘প্যাশেন্ট জিরো’ হচ্ছে ডাক্তারদের ব্যবহৃত একটি কোড। যা কোনো এলাকার বা দেশের প্রথম রোগীকে বোঝানো হয়।
১৯শে ফেব্রুয়ারি যিনি মারা যান তিনি একজন ব্যবসায়ী এবং চীন থেকে আসেন। কোম শহরটি দ্রুতই ভাইরাসের কেন্দ্রে পরিণত হয়।
শিয়া মুসলিমদের জন্য কোমের আলাদা তাৎপর্য আছে। দেশটির উচ্চ সারির ইসলামিক নেতাদের জন্য এই জায়গাটা তীর্থস্থান।
এখানে ২ কোটি ঘরোয়া ও ২৫ লাখ আন্তর্জাতিক পর্যটক আসেন।
অনেক ধর্মীয় স্থান আছে এখানে যা ধার্মিকরা সম্মান দেখানোর জন্য চুমু খান ও স্পর্শ করে থাকেন। এখান থেকে দ্রুত ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে।
কিন্তু এই শহরটিতে কোনো কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা না নিয়ে মোহাম্মদ সাইদের মতো ইসলামিক গুরু আরো বেশি মানুষকে আমন্ত্রণ জানান।
তিনি বলেন, “আমরা মনে করি এটা সুস্থ হওয়ার জন্য উত্তম একটি জায়গা। শারীরিক ও মনের রোগ দূর করার জন্য আরো বেশি মানুষের এখানে আসা উচিৎ।”
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরুরী কার্যপরিচালনা বিভাগের পরিচালক রিচার্ড ব্রেনান ইরান ঘুরে এসে জানান, কোম শহরের ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে ইরানের ভেতর ও বাহিরের বহু মানুষ এখানে যাওয়া আসা করছে। এভাবে দ্রুত পুরো ইরানে ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ছে।
রিচার্ড ব্রেনান বলেন, কোম ও তেহরানে পরীক্ষাগার ও হাসপাতালে বাড়তি উদ্যোগ দেখেছেন তিনি।
এখন কোম শহরের সকল মাজার বন্ধ আছে।
সরকার কী সংক্রমণ কমিয়ে দেখাচ্ছে?
ইরানে ফেব্রুয়ারি মাসে দুটো বড় ঘটনা ঘটে যায়। একটি ইসলামিক অভ্যুত্থানের ৪১ বছর পূর্তি অন্যটি দেশটির সংসদ নির্বাচন।
১১ই ফেব্রুয়ারি ইরানের বিজয় দিবস। এর কিছুদিন আগেই ইরানে সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।
তেহরানের একজন সিনিয়র চিকিৎসক একথা বলেন।
তারা তখন দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে এ বিষয়ে কথা বলেন।
“আমরা বিশ্বাস করি ইরানের সরকার করোনাভাইরাসের বিষয়টি লুকোতে চেয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় নানা জমায়েত চালিয়ে যেতে চেয়েছে।”
ইরানে ছয় মাস ধরে চলে আসা নানা ঘটনাপ্রবাহের ফলে এই ইসলামিক অভ্যুত্থানের পূর্তি এবং নির্বাচন ছিল সরকারের জন্য পরীক্ষা।
নভেম্বরে জ্বালানীর মূল্য বৃদ্ধির কারণে আন্দোলন, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে টানাপোড়েন, কাশেম সোলায়মানির মৃত্যু- এসব ঘটনা দেশটির সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করে রাখে।
এরপর আবার একটি বিমান বিধ্বস্ত করে দেয় ইরান। যেখানে ১৭৬ জন যাত্রী মারা যান এবং ইরানের সরকার প্রথমে এই মিসাইল হামলার কথা অস্বীকার করে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আল খোমেনী বলেন, “ভাইরাসের কথা বলে দেশের নির্বাচনে অংশগ্রহণে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। এটা একটা প্রোপাগান্ডা।”
সম্প্রতি ইরানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাইদ নামাকি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা কমানোর কথা অস্বীকার করে বলেন, “১৯শে ফেব্রুয়ারি প্রথম আমরা জানাই দেশে করোনাভাইরাস ধরা পড়েছে। ২১শে ফেব্রুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা এটা জেনেও।”
নির্বাচনের পাঁচদিনের মাথায় ইরানের মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৯ জনে, ১৩৯ জনের করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিশ্চিত করা হয়।
কোম শহরের একজন সংসদ সদস্য একই দিনে বলেন, “আমাদের শহরে গত দুই সপ্তাহে ৫০ জন মারা গেছে।”
ইরানের ডেপুটি স্বাস্থ্য মন্ত্রী ইরাজ হারিরচি তৎক্ষণাৎ এই দাবি অস্বীকার করেন এবং সেদিন বিকেলেই একটি সংবাদ সম্মেলনে তাকে ঘামতে ও কাশি দিতে দেখা যায়।
পরবর্তীতে তার করোনাভাইরাস ধরা পড়ে এবং ইরানের আরো অনেক উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের মধ্যে তিনিই প্রথম সংক্রমিত হন।
১৩ই মার্চ হারিরচি সুস্থ হয়ে গেছেন বলে জানা যায়।
বিবিসির পারস্য বিভাগের তদন্তে জানা গেছে একটি নির্দিষ্ট দিনে যে পরিমাণ মানুষ মারা গেছে বলে সরকার বলছে তার তুলনায় সংখ্যা ছয়গুণ বেশি।
কিন্তু এখন যখন আনুষ্ঠানিক সংখ্যাও বাড়ছে, তখন ইরানীদের প্রশ্ন, কী করে এই ভাইরাসের সংক্রমণ থামানো যায়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।