চিরচেনা ঘাটে নেই হাঁকডাক। উচ্চস্বরে গান বাজে না চায়ের দোকানে। নেই বরফ ভাঙার আওয়াজ। সবাই ঝিমিয়ে আছে। চোখে-মুখে হতাশার ছাপ। জেলে, শ্রমিক, ব্যাপারী ও আড়ৎদার সবার একই অবস্থা। ভরা মৌসুমে ইলিশ মাছের আকাল চলছে। শূন্য হাতে ফিরে আসছে জেলে নৌকাগুলো। এতে নোয়াখালী হাতিয়ার বিশটি ঘাটের এই পেশার সঙ্গে জড়িত লক্ষাধিক জেলে পরিবার মানবেতর জীবনযাপন করছে।
এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত ইলিশের ভরা মৌসুম। এ সময় জেলেরা পুরোপুরি ব্যস্ত সময় পার করে ইলিশ শিকারে। প্রতি বছরের ন্যায় এই বছরও দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার জেলেরা নদীতে মাছ শিকারে ব্যস্ত সময় পার করছে। নিঝুমদ্বীপ, বন্দরটিলা, সুইজের ঘাট, মোক্তারিয়া, দানারদোল, সূর্যমুখী, কাজিরবাজার বাংলাবাজার ও চেয়ারম্যানঘাটসহ দ্বীপের বড় ২০টি ঘাটের ছোট বড় প্রায় ১০ হাজার জেলে নৌকা নদীতে বিচরণ করছে। কিন্তু হতাশার বিষয় হলো জেলেদের জালে মিলছে না কাঙ্ক্ষিত ইলিশ। প্রতিদিনই শূন্য হাতে ঘাটে ফিরতে হচ্ছে তাদের।
মৌসুমের বেশির ভাগ সময় ফেরিয়ে গেলেও এখনো লাভের মুখ দেখিনি তারা। অন্যদিকে নদীতে যেতে প্রতিদিনই যে ব্যয় হচ্ছে তাতে আর্থিক দেনার পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেকে পরিবারের দৈনন্দিন ব্যয় মিটাতে হিমশিম খাচ্ছে। ঘাট গুলোতে হাঁকডাক নেই, দেখা দিয়েছে নীরব নিস্তব্ধতা ও হতাশা।
সরেজমিনে উপজেলার সূর্যমুখী ঘাটে দেখাযায় এসব চিত্র। ঘাটের দক্ষিণ পাশে খাল পাড়ে দেখা হয় জেলে সবুর আলীর (৫৫) সঙ্গে। সবুর আলী জানান, ভোলার দৌলতখান বাড়ি তাদের। ভালো মাছ পাওয়ার আশায় গত সপ্তাহে হাতিয়ার পূর্বপাশের এই নদীতে এসেছেন। এখানেও মাছের দেখা মেলেনি। প্রতিদিন দেনা করে নদীতে যেতে হয়। এজন্য গত চারদিন নদীতে না গিয়ে ঘাটে বেকার বসে আছেন।
সংসার কীভাবে চলছে প্রশ্ন করলে কান্নায় ভেঙে পড়েন সবুর আলী। বাড়ি থেকে আসার সময় এক টাকাও দিয়ে আসতে পারেনি। আশা ছিল হাতিয়ার নদী ভালো মাছ পাবেন, বাড়িতে টাকা পাঠাবেন। কিন্তু হয়নি। মাছ নেই এখানেও বাড়িতে নিশ্চয় খেয়ে না খেয়ে সংসার চলছে।
সবুর আলীর মতো অনেকে খাল পাড়ে সময় কাটাচ্ছেন। সবার মুখে হতাশার ছাপ। কথা হয় সূর্যমুখী ঘাটের আব্দুর রব মাঝির সাথে। সে জানায় তার ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ৮ জন কাজ করেন। গত দুই মাসে একটাকাও ভাগে পায়নি কেউ। একদিগে নৌকার খরচ অন্যদিগে লোকজনের সংসারের ব্যায় মিটানো। সব মিলে দুই মাসে এক লাখ ৫০ হাজার টাকা দেনার মধ্যে পড়ে আছেন। এরমধ্যে দুজন লোক কাউকে না বলে গোপনে চট্টগ্রাম চলে গেছেন। এখন নৌকাটি ঘাটে পড়ে আছে। লোকের অভাবে নদীতে যেতে পারছেন না।
তিনি আরও জানান, এই ঘাটে স্থানীয় ও বাহিরের মিলে ৫ শতাধিক ট্রলার রয়েছে। সব মিলে ৩০-৪০টি ট্রলার নদীতে যায়। অন্যরা সবাই ঘাটে বেকার সময় পার করছে। মাছ না থাকাই কেউ এখন নদীতে যায় না।
সূর্যমুখী মাছ ঘাটের শ্রমিক সর্দার নুরইসলাম জানান, তার অধীনে এই ঘাটে ৮৫ জন শ্রমিক কাজ করে। খালে কোন নৌকা বা ট্রলার এলে তারা টুরকিতে করে সেই মাছ ডাকের বাক্সে এনে দেয়। প্রতিদিন যে টাকা পায় তা ভাগ করে নেই এই ৮৫ জন। এই বছর প্রথম থেকে মাছ নেই নদীতে। প্রতিদিন কাজ শেষে ভাগে ৩০-৪০ টাকা করে পায় শ্রমিকরা। এতে নিজেদের চা-নাশতা হয় না। সংসার চালাতে হয় দেনা করে।
সূর্যমুখী ঘাটের মাছ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ফয়েজুর রহমান নান্টু বলেন ৯৩ সাল থেকে মাছ ব্যবসার সাথে জড়িত। এই বছরের মতো এতো কঠিন অবস্থা আর কখনো দেখিনি। মৌসুমের প্রথম থেকে মাছ নেই। অনেকে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে অন্যত্র চলে গেছে। ঘাটে পড়ে থাকা অসংখ্য জেলে নৌকার জেলেরা পালিয়ে গেছে। ঘাটে সবার মুখে হতাশা। একধরনের নীরব হাহাকার চলেছে জেলে পল্লী ও মাছ ঘাটে।
তিনি আরও বলেন, শুধু সূর্যমুখী ঘাটে নয় একই অবস্থা হাতিয়ার বিশটি ঘাটে। মাছ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত সবাই অনেকটা দেউলিয়া হয়ে পড়েছে।
হাতিয়ায় ১১টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় ৭ লাখ ৫০ হাজার লোকের বসবাস। এখানে জেলে পেশার সঙ্গে জড়িত প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। সরকারি ভাবে নিবন্ধিত জেলে সংখ্যা ২৫ হাজার ৯৯৫ জন।
উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফাহাদ হাসান বলেন, ভরা মৌসুমের এই সময় ইলিশ না পাওয়ার কারণ হিসাবে জাটকা নিধন, মা ইলিশ ধরা ছাড়াও ডুবোচর, জলবায়ুর পরিবর্তনের কথা উল্লেখ করেন তিনি।
এ ছাড়াও উপকূলীয় এলাকায় কলকারখানার বর্জ্য নদীতে আসাতে মাছের বিচরণ অনিরাপদ হয়ে উঠছে। এজন্য এসব নদীতে কাঙ্ক্ষিত ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে না। তবে তিনি আশা করছেন মৌসুমের সামনের সময় গুলোতে আশানুরূপ ইলিশ পাওয়া যাবে।
সূত্র : আরটিভি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।