আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ইতিহাসের ভয়ানক হামলার শিকার হয়েছে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েল। মাত্র ২০ মিনিটে ৫ হাজার রকেট ছুড়ে ইসরায়েলের শক্তিশালী আয়রন ডোম প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে নাজেহাল করে দিয়ে বিশ্বে আলোড়ন ফেলে দিয়েছে হামাস যোদ্ধারা। জানা গেছে হামলার নেপথ্যে মাস্টারমাইন্ড হামাসের কমান্ডার মোহাম্মদ দেইফ।
শনিবার হামাস গাজা উপত্যকা থেকে হাজার হাজার রকেট নিক্ষেপ করার সঙ্গে সঙ্গে সম্প্রচারিত একটি অডিও বার্তায় ইসরায়েলের মোস্ট ওয়ান্টেড ম্যান শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছিল। জেরুজালেমের আল আকসা মসজিদে ইসরায়েলিদের হামলার প্রতিশোধের জন্য এই পদক্ষেপ নিয়েছে হামাস।
হামাসের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র রয়টার্সকে জানিয়েছে, ২০২১ সালের মে মাসে ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম স্থানে ইসরায়েলের নৃশংস অভিযানের পর থেকেই হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন দেইফ। এই হামলার ফলস্বরূপ ইসরায়েলের ১২০০ জন নিহত এবং প্রায় ৩ হাজার আহত হয়েছে।
গাজার সূত্র বলেছে, ‘রমজানের সময় ইসরায়েল আল আকসা মসজিদে হামলা, মুসল্লিদের মারধর, তাদের ওপর হামলা, বয়স্ক এবং যুবকদের মসজিদ থেকে টেনে বের করার দৃশ্য এবং ফুটেজের মাধ্যমে এর সূত্রপাত হয়েছে। এসব ঘটনা হামাসের ক্ষোভ আরও উস্কে দিয়েছে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে।’
আল আকসার কম্পাউন্ডে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে এই নৃশংসতা প্রায় ১১ দিন স্থায়ী হয়েছিল। হামাসও এতে জড়িয়ে পড়ে তখন। এর ঠিক দুই বছরের বেশি সময় বাদে শনিবারের (৭ অক্টোবর) হামলাটি ১৯৭৩ সালের আরব-ইসরায়েল সংঘাতের পর ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সবচেয়ে খারাপ লঙ্ঘন।
বাধ্য হয়ে ইসরায়েলকে যুদ্ধ ঘোষণা করতে এবং গাজায় প্রতিশোধমূলক বিমান হামলা চালাতে হয়েছে। এর ফলে প্রাণ হারিয়েছে ১ হাজার ৫৫ জন ফিলিস্তিনি এবং আহত হয়েছে ৫ হাজারের বেশি।
২০২১ সালের পর দেইফকে মারার জন্য অন্তত ৭ বার প্রচেষ্টা চালায় ইসরায়েল। কিন্তু সাতবারই ব্যর্থ হয় তারা। মোহাম্মদ দেইফ জনসমক্ষে খুব কমই কথা বলেন এবং কখনই প্রকাশ্যে আসেননা তিনি। তাই যখন হামাসের টিভি চ্যানেল ঘোষণা করা হয় যে শনিবার ভাষণ দিবেন তিনি তখনই ফিলিস্তিনিরা বুঝে যায় এবার মারাত্মক কিছু ঘটতে যাচ্ছে।
রেকর্ড করা ভাষণে দেইফ বলেছিলেন, ‘আজ আল-আকসার ক্রোধ আমাদের জাতির ক্রোধ বিস্ফোরিত হচ্ছে। আমাদের যোদ্ধারা, আজ দিনটা আপনাদের। আজ অপরাধীদের বোঝানোর দিন যে তাদের সময় শেষ হয়ে গেছে।’
দেইফের মাত্র তিনটি ছবি রয়েছে, একটি তার ২০ বছর বয়সের, অন্যটি মুখোশ পরা এবং আরেকটি তার ছায়ার ছবি। অডিও টেপটি সম্প্রচারের সময় এগুলো ব্যবহৃত হয়েছিল।
দেইফের ছায়ার খবরও কেউ জানেনা। ধারণা করা হয় তিনি সম্ভবত গাজায় ছিটমহলের নীচে সুড়ঙ্গের গোলকধাঁধায় আস্তা গেড়েছেন। তিনি সরাসরি হামলার পরিকল্পনা ও পরিচালনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন বলে ইসরায়েলের একটি নিরাপত্তা সূত্র জানিয়েছে।
ফিলিস্তিনি সূত্রমতে, গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলায় যতগুলো বাড়ি ধ্বংস হয়েছে তার মধ্যে একটি দেইফের বাবার। সূত্রে জানা গেছে, দেইফের ভাই এবং পরিবারের অন্য দুই সদস্য নিহত হয়েছেন।
দুই মাথা, একজন মাস্টারমাইন্ড
হামাসের ঘনিষ্ঠ সূত্রটি বলেছে, হামলার প্রস্তুতির সিদ্ধান্তটি যৌথভাবে গৃহীত হয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছেন হামাসের আল কাসাম ব্রিগেডের কমান্ডার দেইফ এবং গাজার হামাসের নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার। তবে মাস্টারমাইন্ড ছিলেন দেইফ। আর এই অভিযানের তথ্য শুধু হামাসের একজন নেতাই জানতেন।
অভিযানটি এতটাই গোপন ছিল যে হামাসের অন্যতম প্রধান পৃষ্ঠপোষক ইরানও জানতো না বিস্তারিত। তারা শুধু জানতো হামাস বড় ধরনের হামলার পরিকল্পনা সাজিয়েছে।
সূত্র জানিয়েছে, যখন তেহরান জানতো যে একটি বড় অপারেশন সাজাচ্ছে হামাস তখন ইরান-সমর্থিত লেবাননের হিজবুল্লাহ এবং ইরানের সঙ্গে যৌথ কোনো অপারেশন রুমে এ নিয়ে বিন্দুমাত্র আলোচনা করা হয়নি।
ইসরায়েলে কোনো হামলা করবে না হামাস, এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে দীর্ঘ সময় নিয়েছেন দেইফ। ইসরায়েলকে বুঝানো হয়েছিল ইরান কিংবা হামাস কেউই ইসরায়েলে হামলা করতে আগ্রহী না। বরং তারা গাজায় অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকেই নজর দিয়েছে।
কিন্তু যখন ইসরাইল গাজানের কর্মীদের অর্থনৈতিক প্রণোদনা দেওয়া শুরু করে তখনই হামসের যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও মহড়া দেওয়া হচ্ছিল। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়েই কৌশলে কাজগুলো করা হয়েছে বলে হামাসের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানিয়েছে।
হামাসের পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক প্রধান আলি বারাকা বলেছেন, ‘আমরা এই যুদ্ধের জন্য দুই বছর ধরে প্রস্তুতি নিয়েছি।’
শান্তভাবে দেইফ তার রেকর্ড করা বার্তায় বলেছিলেন, হামাস বারবার ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে তার অপরাধ বন্ধ করার জন্য, বন্দীদের মুক্তি দেওয়ার জন্য এবং ফিলিস্তিনি জমির দখল বন্ধ করার জন্য ইসরায়েলকে সতর্ক করেছিল।
তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন দখলদার ইসরায়েল পশ্চিম তীরের আমাদের গ্রাম ও শহরে তাণ্ডব চালায় এবং বাড়িঘরে হামলা চালায়, হত্যা করে, আহত করে, ধ্বংস করে এবং আটক করে। একই সময়ে, তারা আমাদের হাজার হাজার একর জমি বাজেয়াপ্ত করে, আমাদের লোকদের তাদের বাড়িঘর থেকে উচ্ছেদ করে। গাজায় তাদের অপরাধমূলক অবরোধ অব্যাহত থাকার সময় অবৈধ বসতি স্থাপন করে।’
কে এই মোহাম্মদ দেইফ
মোহাম্মদ দেইফ সম্পর্কে নতুন করে বিশেষ কিছু জানার উপায় নেই। তার জন্ম ১৯৬৫ সালে তৎকালীন মিসর নিয়ন্ত্রিত গাজার খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে। জন্মের পর তার নাম রাখা হয় মোহাম্মদ মাসরি।
১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার সংগ্রাম ‘ইন্তিফাদা’ শুরুর পর হামাস প্রতিষ্ঠিত হলে মোহাম্মদ মাসরি তাতে যোগ দেন। সেখানে তিনি মোহাম্মদ দেইফ নামে পরিচিত হন। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ দেইফ দ্রুত হামাসের সামরিক ইউনিট, আল-কাশিম ব্রিগেডে জনপ্রিয়তা পান।
হামাসের একটি সূত্রমতে, ১৯৮৯ সালে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার হন দেইফ। তখন প্রায় ১৬ মাস কারাবন্দি থাকেন তিনি। হামাসের নেতা হয়ে ওঠার পর দেইফ বোমা তৈরি ও মাটির নিচে সুড়ঙ্গের জাল বিস্তারের কাজ শুরু করেন।
দেইফ গাজার ইসলামিক ইউনিভার্সিটি থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান নিয়ে পড়ালেখা করেছেন। শিল্পকলার অনুরাগী দেইফ তার বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনোদন সংক্রান্ত কমিটির প্রধান ছিলেন এবং মঞ্চে অভিনয় করতেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।