গাড়ির হর্ণ, অফিসের ডেডলাইন, ব্যাংক ব্যালেন্সের চাপ—আজকের দৌড়ঝাঁপের জীবনে “সফলতা” শব্দটাই যেন শুধু টাকার পরিমাণ, পদবী বা বিলাসবহুল ভিলার প্রতিশব্দ। কিন্তু হৃদয়টা কি শান্তি চায় না? প্রশ্নটা যখন রাতের নিস্তব্ধতায় উঁকি দেয়, তখনই মনে হয়—প্রকৃত সফলতা কি এটাই? ইসলামী দৃষ্টিকোণে সফলতা এখানেই এক আলাদা দিগন্ত খোলে। এটি শুধু পার্থিব লক্ষ্য নয়; বরং আত্মার পরিশুদ্ধি, আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং অনন্ত জীবনের প্রস্তুতির এক সমন্বিত রূপ। বিশ্বের ১.৯ বিলিয়ন মুসলিমের জীবনদর্শনের কেন্দ্রে থাকা এই ধারণাটিই আজকের আলোচনার মূল বিষয়।
ইসলামী দৃষ্টিকোণে সফলতার সেই গভীর অর্থ: কুরআন কী বলে?
কুরআনে “সফলতা”-এর জন্য ব্যবহৃত শব্দটি হলো “ফালাহ“। এর অর্থ কেবল জয়লাভ নয়, বরং টিকে থাকা, বিকশিত হওয়া এবং চূড়ান্ত মুক্তি। সূরা আল-আসরের সেই অমোঘ বাণী: “কালের শপথ! নিশ্চয় মানুষ ক্ষতির মধ্যে নিমজ্জিত। তবে তারা ছাড়া, যারা ঈমান আনে, সৎকর্ম করে, একে অপরকে সত্যের উপদেশ দেয় এবং ধৈর্যের উপদেশ দেয়।” (কুরআন ১০৩:১-৩)। এখানেই স্পষ্ট—ইসলামী দৃষ্টিকোণে সফলতা চার স্তম্ভে দাঁড়িয়ে:
- ঈমান (বিশ্বাস): আল্লাহ, ফেরেশতা, আসমানী কিতাব, নবী-রাসূল, আখিরাত ও তাকদিরের প্রতি অটল বিশ্বাস।
- আমলে সালেহ (সৎকর্ম): ইবাদত থেকে শুরু করে সামাজিক দায়িত্ব—সবই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য।
- হক্কের দাওয়াত (সত্যের প্রচার): নিজে সঠিক পথে চলা এবং অন্যদেরকেও কল্যাণের পথে আহ্বান।
- সবর (ধৈর্য): বিপদে-অভাবে, ইবাদতে ও গুনাহ থেকে বিরত থাকায় অবিচলতা।
২০২৩-এ জর্ডানের ইসলামিক স্টাডিজ সেন্টারের গবেষণায় উঠে এসেছে: যারা নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত ও অর্থ বুঝে আমল করে, তাদের ৮৯% নিজেদের “আত্মিকভাবে সফল” বলে মনে করেন—চাকরি বা আয়ের স্তর নির্বিশেষে। [সূত্র: University of Jordan Islamic Research Bulletin, Vol. 12(2)]
সফল জীবনের ৭টি কুরআনি গাইডলাইন: বাস্তব জীবনে কীভাবে প্রয়োগ করবেন?
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাওহীদের প্রভাব
ইসলামী দৃষ্টিকোণে সফলতার প্রথম শর্ত হলো “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ”-এর উপলব্ধি। অর্থাৎ, আল্লাহ ছাড়া অন্য সবকিছুই ক্ষণস্থায়ী—সম্পদ, ক্ষমতা, মানুষের প্রশংসা। ঢাকার একজন তরুণ উদ্যোক্তা রাফিদের গল্প ভাবুন: ব্যবসায় মন্দা আসতেই সে হতাশায় ডুবে গিয়েছিল। কিন্তু তাওহীদের শিক্ষা তাকে শিখিয়েছে: “আল্লাহর উপর ভরসা করো, তিনিই যথেষ্ট।” (কুরআন ৬৫:৩)। সে নিয়মিত তাহাজ্জুদে দোয়া শুরু করে এবং নতুন বিপণন কৌশল নিয়ে চিন্তা করে। ছয় মাসের মধ্যে তার প্রতিষ্ঠান লাভজনক হয়।
নামাজ: সময় ব্যবস্থাপনার মহা পাঠশালা
নামাজ কেবল ইবাদত নয়; এটি দিনের গতিশীলতা ও মানসিক সুস্থতার চাবিকাঠি। গবেষণা প্রমাণ করে, নিয়মিত নামাজ আদায়কারীদের মধ্যে স্ট্রেস লেভেল ৪০% কম এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা ৩৫% বেশি (Journal of Religion and Health, 2022)।
জাকাত: সম্পদে বরকত ও সামাজিক ভারসাম্যের হাতিয়ার
ইসলামী অর্থনীতির মূলনীতি হলো: সম্পদ কুক্ষিগত করলে তা অশুভ। মালয়েশিয়ার “Zakat Empowerment Initiative” প্রোগ্রামের তথ্য অনুযায়ী, জাকাতের টাকায় গড়ে উঠা ৭০% ক্ষুদ্র উদ্যোগ টিকে যায় দীর্ঘমেয়াদে—যেখানে সাধারণ ব্যবসার ব্যর্থতার হার ৬০%। [সূত্র: Malaysian Zakat Foundation Annual Report]
রোজা: আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প
রমজান মাসে রোজা রাখা শারীরিক উপকারের পাশাপাশি শেখায় আত্মসংযম—যা সফলতার জন্য অপরিহার্য। ডাক্তার আয়েশা সিদ্দিকা (ঢাকা মেডিকেল কলেজ) বলছেন: “আমার রোগীরা যারা নিয়মিত রোজা রাখেন, তাদের মধ্যে ডায়াবেটিস ও হৃদ্রোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কম।
হজ্জ: বৈশ্বিক ঐক্যের বাস্তব পাঠ
হজ্জ শুধু ধর্মীয় রীতি নয়; এটি ভিন্ন সংস্কৃতির লক্ষাধিক মানুষের সাথে সহাবস্থান, ধৈর্য ও সংগঠনের মহড়া। হাজী আবদুল করিম (চট্টগ্রাম) অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন: “হজ্জ আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে সীমিত সম্পদে কোটি মানুষের সেবা করা যায়—এটাই আমার টেক্সটাইল ব্যবসায় প্রয়োগ করেছি।
জ্ঞানার্জন: ঈমানের আলোকে বিজ্ঞানচর্চা
ইসলাম জ্ঞানের প্রতি এমন গুরুত্ব দেয় যে, “জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপর ফরজ” (ইবনে মাজাহ)। সৌদি আরবের “Vision 2030” প্রকল্পের আওতায় ২০২২-এ ১.২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে গবেষণায়, ইসলামী মূল্যবোধের সাথে প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে।
উত্তম চরিত্র: নবীজি (সা.)-এর অনন্য উত্তরাধিকার
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “সবচেয়ে ভালো মুসলিম সেই, যার হাত ও জবান থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ।” (বুখারী)। একটি সুস্থ সমাজ গঠনই ইসলামী সফলতার চূড়ান্ত লক্ষ্য—যেখানে আত্মকেন্দ্রিকতা নয়, সমষ্টির কল্যাণ প্রধান।
দুনিয়া ও আখিরাতের সফলতার ভারসাম্য: বাস্তব জীবনে যেভাবে সম্ভব
অনেকেই ভাবেন: “পার্থিব সাফল্য আর আধ্যাত্মিকতা কি একসাথে সম্ভব?” ইসলামের উত্তর: হ্যাঁ! নবী সুলাইমান (আ.) ছিলেন বিশাল সাম্রাজ্যের মালিক, আবার আল্লাহর নেক বান্দাও। চাবিকাঠি হলো নিয়তের শুদ্ধতা। উদাহরণ:
- ক্যারিয়ারে: চাকরি বা ব্যবসায় সততা বজায় রাখা, হারাম আয় এড়ানো, সহকর্মীদের সাথে ন্যায় আচরণ।
- পরিবারে: স্ত্রী/সন্তানদের অধিকার আদায় করা, তাদের ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া।
- সমাজে: প্রতিবেশীর খোঁজখবর নেওয়া, গরিবের সাহায্য করা।
গবেষণার ফল: হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৩-এর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা ধর্মীয় মূল্যবোধ অনুযায়ী নৈতিক সিদ্ধান্ত নেন, তাদের চাকরিতে পদোন্নতির হার ২৭% বেশি! কারণ, তাদের সিদ্ধান্তে থাকে দূরদর্শিতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা।
আধুনিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইসলামী কৌশল
১. উদ্বেগ ও হতাশা:
কুরআনের পথনির্দেশ: “নিশ্চয় আল্লাহর স্মরণেই অন্তর শান্তি পায়” (১৩:২৮)। দিনে ১০ মিনিট তাহাজ্জুদ বা জিকিরের অভ্যাস উদ্বেগ ৫০% কমাতে পারে (Journal of Clinical Psychology)।
২. অর্থনৈতিক চাপ:
ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূলমন্ত্র—“লাভ-লোকসান ভাগাভাগি”। মাইক্রোফাইন্যান্সে অংশ নিন যেখানে রিবা (সুদ) নেই। বাংলাদেশের “ইসলামিক ফাইন্যান্স এক্সপের্ট” ড. ফরিদুল ইসলামের পরামর্শ: “সুদভিত্তিক ঋণ নয়, মুশারাকা বা মুদারাবা মডেলে বিনিয়োগ করুন।”
৩. সময়াভাব:
নবীজি (সা.) বলতেন: “দুটি নিয়ামতের ব্যাপারে মানুষ অধিকাংশ সময় ধোঁকায় থাকে—স্বাস্থ্য ও অবসর সময়।” (বুখারী)। দিনের শুরুতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজকে “অ্যানকর টাস্ক” বানান—এটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সময়কে ব্লকে ভাগ করবে।
সফলতার জীবন্ত উদাহরণ: সাহাবায়ে কেরামের জীবনচরিত
- হযরত আবু বকর (রা.): সম্পদে ভরপুর ব্যবসায়ী হয়েও ইসলাম গ্রহণের পর সবকিছু আল্লাহর পথে ওয়াকফ করে দিলেন। ফল? তিনি হয়েছেন উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ খলিফা।
- হযরত খাদিজা (রা.): মক্কার সফলতম ব্যবসায়ী নারী। রাসূল (সা.)-কে বিবাহ করে তার সম্পদ দিয়ে ইসলামের বিজয়ভিত্তি গড়ে দিলেন।
- হযরত বিলাল (রা.): নির্যাতিত দাস থেকে বিশ্বের প্রথম মুয়াজ্জিন—শ্রেষ্ঠত্বের মাপকাঠি যে বংশ বা বিত্ত নয়, তা প্রমাণ করলেন।
বাংলাদেশের প্রাসঙ্গিকতা: নোয়াখালীর কৃষক জামাল উদ্দিন। জৈব পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে লাভবান হচ্ছেন, জাকাত দিচ্ছেন স্থানীয় মাদ্রাসায়। তার মতে: “ফসলের বরকত বাড়ে আল্লাহর রহমতে—রাসায়নিক সারে নয়।”
ইসলামী দৃষ্টিকোণে সফলতা কোনো গন্তব্য নয়; বরং এক নিবিড় যাত্রাপথ—যেখানে প্রতিটি নামাজ, প্রতিটি সৎ সিদ্ধান্ত, প্রতিটি দানই আপনাকে নিয়ে যায় আল্লাহর নৈকট্যের দিকে। এখানে ব্যর্থতা বলে কিছু নেই; আছে শুধু শিক্ষা ও আত্মোন্নয়নের সুযোগ। আজই শুরু করুন ছোট্ট একটি পদক্ষেপ: হয়তো মাগরিবের নামাজ জামাতে আদায় করা, কিংবা এক গ্লাস পানি দিয়ে প্রতিবেশীর সাহায্য করা। মনে রাখবেন, সফলতার সর্বোচ্চ শিখর হলো জান্নাত—আর তার প্রস্তুতি শুরু হয় এখানেই, এই পৃথিবীর ময়দানে।
জেনে রাখুন
প্রশ্ন: ইসলামে দুনিয়াবী সফলতা হারাম কি?
উত্তর: না, দুনিয়াবী সফলতা হারাম নয়; বরং ইসলাম এটিকে উৎসাহিত করে যদি তা হালাল পথে অর্জিত হয় এবং আল্লাহর বিধান মেনে ব্যবহার করা হয়। রাসূল (সা.) দোয়া শিখিয়েছেন: “হে আল্লাহ! আমাদের দুনিয়ার কল্যাণ দিন এবং আখিরাতেরও কল্যাণ দিন।” (কুরআন ২:২০১)।
প্রশ্ন: সফলতার জন্য কোন দোয়া পড়তে হয়?
উত্তর: রাসূল (সা.) প্রায়ই পড়তেন: “রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানাতাও ওয়া ফিল আখিরাতি হাসানাতাও ওয়া কিনা আজাবান্নার।” (হে আমাদের রব! আমাদের দুনিয়া ও আখিরাতে ভালো জিনিস দান করুন এবং আমাদের জাহান্নামের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।) – কুরআন (২:২০১)। এছাড়া সকাল-সন্ধ্যায় “লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ” পাঠ করুন।
প্রশ্ন: ব্যর্থতাকে ইসলাম কীভাবে দেখে?
উত্তর: ইসলাম ব্যর্থতাকে “শিক্ষার সুযোগ” ও “আল্লাহর পরীক্ষা” হিসেবে দেখে। রাসূল (সা.) বলেছেন: “মুমিনের বিষয় বিস্ময়কর! তার সব কাজই কল্যাণকর। সে যদি সুখ পায়, শুকরিয়া আদায় করে—তা তার জন্য ভালো। আর যদি কষ্ট পায়, ধৈর্য ধরে—সেটাও তার জন্য ভালো।” (মুসলিম)।
প্রশ্ন: পরীক্ষায় ভালো ফল বা চাকরিতে সফলতার জন্য ইসলামী উপায় কী?
উত্তর: নিয়মিত নামাজের পাশাপাশি:
১. ইখলাস (নিয়ত শুদ্ধ করা)
২. ইস্তিখারা দোয়া (সিদ্ধান্তের জন্য আল্লাহর সাহায্য চাওয়া)
৩. বেশি বেশি “ইয়া রব্বি যিদনি ইলমা” (হে রব! আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দিন) দোয়া পড়া।
৪. পড়াশোনা/কাজে নিয়মানুবর্তিতা ও পরিশ্রম।
প্রশ্ন: ধনী ব্যক্তিরা কি ইসলামী দৃষ্টিকোণে সফল?
উত্তর: ধন-সম্পদ সফলতার একমাত্র মাপকাঠি নয়। সফলতা নির্ভর করে সম্পদ কীভাবে অর্জিত হলো এবং কোথায় ব্যয় হলো তার উপর। কুরআনে বলা হয়েছে: “আর যে স্বর্ণ-রূপা জমা করে আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও।” (৯:৩৪)।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।