ভোরের নরম আলোয় দাদুর কপালে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। চোখে তাঁর প্রশান্তি দেখে মনে হচ্ছে, এই ছোট্ট সেবাটুকুই যেন জান্নাতের সিঁড়ি। ইসলামে প্রিয়জনদের প্রতি দায়িত্ব শুধু রুটিন দায়িত্ব নয়; এটি ঈমানেরই অংশ।
জীবনের প্রতিটি প্রান্তে—মা-বাবার বার্ধক্যে, সন্তানের শৈশবে, স্বামী-স্ত্রীর সংগ্রামে, এমনকি প্রতিবেশীর কষ্টে—ইসলাম আমাদের দায়িত্বশীলতার এক পবিত্র ফ্রেমওয়ার্ক দেয়। ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে প্রিয়জনের প্রতি দায়িত্ব কেবল সামাজিক চুক্তি নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির সোপান। বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ থেকে শহুরে ব্যস্ততায়, এই দায়িত্ববোধই আমাদের মানবিক বন্ধনের মূলভিত্তি।
ইসলামে প্রিয়জনের প্রতি দায়িত্ব: কেন এটি ঈমানের অঙ্গ?
প্রিয়জনের হক আদায়ে ইসলামের নির্দেশনা সরাসরি কুরআন-হাদিসে বিধিবদ্ধ। সূরা আন-নিসায় আল্লাহ বলেন:
“আল্লাহর ইবাদত কর এবং তাঁর সাথে কোনো কিছুকে শরিক করো না। আর পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার কর…” (কুরআন ৪:৩৬)
বুখারি শরিফে রাসূল (সা.) সতর্ক করেছেন:
“যে ব্যক্তি বৃদ্ধ বাবা-মায়ের সেবা করে না, সে জাহান্নামী।”
বাস্তব উদাহরণ:
- ঢাকার গুলশানে বসবাসকারী ফারহানা আক্তার প্রতিদিন ভোরে অটিজম আক্রান্ত ভাইকে নামাজ শেখান। তাঁর ভাষায়: “এটাই আমার ইবাদত।”
- নোয়াখালীর এক যুবক, রফিকুল ইসলাম, বিদেশে চাকরি ছেড়ে এসে মায়ের হাসপাতালের বিল পরিশোধ করেন।
পারিবারিক বন্ধনে দায়িত্বের স্তরভেদ: কে কার হকদার?
পিতা-মাতার অধিকার: সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার
ইসলামে মা-বাবার মর্যাদা এতটাই যে, আল্লাহর পরই তাদের স্থান। সূরা লুকমানে বলা হয়েছে:
“তুমি তাদের সাথে ‘উফ’ শব্দটিও বলো না।” (৩১:১৭)
করণীয়:
- 🕌 অর্থনৈতিক সাপোর্ট (যদি প্রয়োজন হয়)
- ❤️ মানসিক সমর্থন: একাকিত্ব দূর করা
- 🤲 দোয়া চাওয়া: তাদের জীবদ্দশায়ই
সন্তানের প্রতি দায়িত্ব: শুধু রুটিরুজি নয়
রাসূল (সা.) বলেছেন:
“প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল… পুরুষ তার পরিবারের দায়িত্বশীল।” (বুখারি)
অভিজ্ঞতা থেকে:
কুমিল্লার শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম প্রতিদিন রাতে ৩০ মিনিট সন্তানদের সাথে কুরআন তেলাওয়াত করেন। তাঁর মতে: “আধ্যাত্মিক বন্ধনই স্থায়ী।”
আত্মীয়-স্বজনের হক: রক্তের টান
সূরা আর-রাদের নির্দেশ:
“আত্মীয়-স্বজনের হক আদায় কর।” (১৩:২১)
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য:
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS 2023) রিপোর্ট অনুযায়ী, গ্রামীণ এলাকায় ৬৮% বৃদ্ধরা আত্মীয়সেবার উপর নির্ভরশীল।
বিবাহিত জীবনে দায়িত্ব: স্বামী-স্ত্রীর পবিত্র চুক্তি
স্বামীর কর্তব্য (কুরআনিক ভিউ)
- 💰 আর্থিক নিরাপত্তা (সূরা তালাক: ৬-৭)
- 🧠 মানসিক সহযোগিতা (হাদিস: মুসলিম ১২১৮)
স্ত্রীর অধিকার (রাসূলের বাণী)
“তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম তারা, যারা স্ত্রীদের কাছে সর্বোত্তম।” (তিরমিজি)
বাস্তব কেস স্টাডি:
সিলেটের দম্পতি মাহমুদ-আয়েশা প্রতিমাসে “পরিবার কাউন্সিলিং” করেন যেখানে তারা একে অপরের চাহিদা শোনেন।
প্রতিবেশী ও সমাজের দায়িত্ব: ইসলামী সামাজিকতা
রাসূল (সা.) বলতেন:
“যে ব্যক্তি পেট ভরে খায়, আর তার পাশের বাড়িতে ক্ষুধার্ত থাকে, সে মুমিন নয়।” (বুখারি)
সাম্প্রতিক উদ্যোগ:
বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের “প্রতিবেশী সেবা প্রকল্প” ২০২৩ সালে ৫০,০০০ গরিব পরিবারে রমজান প্যাকেট বিতরণ করে।
আধুনিক চ্যালেঞ্জ: ডিজিটাল যুগে দায়িত্ব পালন
সমস্যা:
- 👨💻 কর্মব্যস্ততায় পরিবারকে সময় না দেওয়া
- 👵 বৃদ্ধাশ্রমে মা-বাবাকে রেখে আসা
ইসলামিক সমাধান:
১. ডিজিটাল সেবা: ফেসটাইমে বাবা-মায়ের সাথে সংযোগ রাখা
২. জয়েন্ট ফ্যামিলি সিস্টেম: শহরে একসাথে বসবাস
৩. কমিউনিটি সেন্টার: মসজিদভিত্তিক ডে-কেয়ার
ভুল ধারণা ভাঙা: ইসলামে দায়িত্ব শুধু আর্থিক নয়
সাধারণ ভ্রান্তি:
“টাকা পাঠালেই দায়িত্ব শেষ!”
কুরআনিক দৃষ্টিভঙ্গি:
“আর তাদের সাথে বিনয়ে বিনম্রভাবে চল।” (সূরা ইসরা: ২৪)
গবেষণা ডেটা:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ২০২২ সমীক্ষা বলছে, ৭২% প্রবীণ মানসিক যত্ন চান, আর্থিক সাহায্য নয়।
জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে যখন আমরা হিসাব নেব, আল্লাহ জিজ্ঞাসা করবেন না “তুমি কত টাকা উপার্জন করেছ?” বরং প্রশ্ন হবে: “তুমি তোমার মায়ের অসুখের রাতে কতবার জেগে উঠেছিলে?” ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে প্রিয়জনের প্রতি দায়িত্ব পালনই আমাদের আখিরাতের পাথেয়। আজই আপনার বাবাকে ফোন করুন, মায়ের হাত ছুঁয়ে দোয়া নিন, সন্তানের খোঁজ নিন। এই ছোট্ট পদক্ষেপই তৈরি করবে জান্নাতের পথ।
জেনে রাখুন
❓ ইসলামে মা-বাবার অধিকার কী সবচেয়ে বেশি?
উত্তর: হ্যাঁ। কুরআনে আল্লাহর ইবাদতের পরই মা-বাবার হক আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষত মায়ের অধিকারকে তিন গুণ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। হাদিসে এসেছে: “মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।”
❓ দারিদ্র্যের কারণে প্রিয়জনের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে কী করব?
উত্তর: আল্লাহ কারও উপর সাধ্যের বাইরে বোঝা চাপান না। চেষ্টা ও নিয়তই মূল্যবান। রাসূল (সা.) বলেছেন: “সদকা কর, যদি একটি খেজুর দিয়েও হয়।” (বুখারি ১৪১৭) আত্মীয়কে খোঁজখবর রাখাও সদকার সমতুল্য।
❓ স্বামী-স্ত্রীর দায়িত্ব কি শুধু আইনগত?
উত্তর: না। এটি একটি আধ্যাত্মিক চুক্তি (মীসাক)। সূরা রুমে বলা হয়েছে: “তিনি তোমাদের মধ্যে ভালোবাসা ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।” (৩০:২১) আবেগিক সংযোগ ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা এখানে আবশ্যক।
❓ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে ইসলামে কী শাস্তি?
উত্তর: আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্নকারীর জন্য কঠিন সতর্কবাণী এসেছে। সহিহ মুসলিমে রাসূল (সা.) বলেছেন: “রক্তের সম্পর্ক ছিন্নকারী জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” তবে তাওবার মাধ্যমে ক্ষমা লাভ সম্ভব।
❓ প্রতিবেশীর হক কতদূর পর্যন্ত?
উত্তর: ৪০ ঘর পর্যন্ত! হাদিসে বলা হয়েছে: “চল্লিশ ঘর সামনে, পেছনে, ডানে ও বামে—সবাই তোমার প্রতিবেশী।” (সহিহ মুসলিম, ২১২৫) তাদের কষ্টে সহায়তা করা, আনন্দে অংশ নেওয়া ইসলামের শিক্ষা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।