তাকী জোবায়ের : বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ ঋণ জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি.তে। এস. আলম গ্রুপের দুই কর্মচারির নামে প্রতিষ্ঠিত একটি ভুয়া কোম্পানিকে প্রায় ৩ হাজার ৪শ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে ব্যাংকটি। এই বিপুল অংকের ফান্ডেড ঋণের বিপরীতে মর্টগেজ নেওয়া হয়েছে মাত্র ১৮৯ কোটি টাকার জমি। আর প্রতিষ্ঠানের পরিশোধিত মূলধন মাত্র ১০ কোটি টাকা।
জুমবাংলা’র নিজস্ব অনুসন্ধানে প্রায় এক বছর আগে এই ভয়াবহ ঋণ জালিয়াতির তথ্য বের হয়। মাত্র ৪ বছরে এই বিপুল অর্থ বের করে নিলেও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেছে নীরব দর্শকের ভূমিকায়। এই ঋণ জালিয়াতির বিষয়ে গত বছরের শেষের দিকে জুমবাংলা’র পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তাকে অবহিত করা হলেও তারা এড়িয়ে গেছেন।
এমনকি একটি গোয়েন্দা সংস্থার চাপে পড়ে এই সংঘবদ্ধ প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির সংবাদটি এতদিন প্রকাশ করতে পারেনি জুমবাংলা। এর আগে সর্ববৃহৎ ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছিল সোনালী ব্যাংকে। জালিয়াতির মাধ্যমে ২ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা নিয়েছিল হলমার্ক গ্রুপ।
ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা যেই কাগুজে প্রতিষ্ঠানটিকে এই বিপুল অংকের ঋণ দিয়েছে, সেটি ২০১৯ সালের ৭ মে সেঞ্চুরি ফ্লাওয়ার মিলস নামে প্রতিষ্ঠিত হলেও বর্তমান নাম সেঞ্চুরি ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেড।
জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মসে দাখিলকৃত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সেঞ্চুরি ফুডের এমডির দায়িত্বে রয়েছেন আরিফুল ইসলাম চৌধুরী এবং পরিচালক হিসেবে রয়েছেন হাসানুজ্জামান। এই দুইজনের বাড়িই চট্টগ্রামের পটিয়ায়। এই কোম্পানির ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে, ১ নং সাউথ পাহাড়তলি, নান্দিরহাট, চট্টগ্রাম।
কিন্তু সরজমিন পরিদর্শন করে এই ঠিকানায় কিংবা এর আশপাশের ঠিকানায় সেঞ্চুরি ফুড কিংবা সেঞ্চুরি ফ্লাওয়ার নামে কোন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুজে পায়নি জুমবাংলা। এমনকি এখানকার কোন লোকজনও এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে কোন তথ্য দিতে পারেনি।
সেঞ্চুরি ফুডের দুই কর্ণধার আরিফুল ইসলাম চৌধুরী ও হাসানুজ্জামানের প্রকৃত পরিচয় জানতে অনেকের দারস্থ হয় এই প্রতিবেদক। এদের মধ্যে বেসিক ব্যাংকের এমডি মো. আনিসুর রহমান আরিফুল ও হাসানুজ্জামানের ছবি দেখে স্পষ্টভাবে চিনতে পারেন।
তিনি বলেন, ‘আমি যখন অগ্রণী ব্যাংকের ডিএমডি ছিলাম তখন ওরা আমার চেম্বারে প্রায়ই আসতো এস. আলম গ্রুপের বিভিন্ন তদবির নিয়ে। একবার আমরা হাজারিবাগে একটি বাড়ি নিলাম করবো। ওই বাড়িটির প্রকৃত দাম ৮০ কোটি টাকার মতো হলেও আরিফ একদিন আমাকে এসে প্রস্তাব দেয়, ২০ কোটি টাকায় বাড়িটি ছেড়ে দেওয়ার জন্য। তখন আমি রাজি না হলে আমাকে ফোনে এস. আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম মাসুদকে ধরিয়ে দেয় আরিফ। তিনি নিজেও আমাকে অনুরোধ করেন বাড়িটি ছেড়ে দিতে। কিন্তু ছাড়িনি। ওই সময়ই আমি বুঝতে পারি, আরিফ এবং হাসান মূলতঃ এস. আলমের প্রতিনিধি। এরপরও বিভিন্ন সময়ে মাসুদ সাহেবের বিভিন্ন তদবির নিয়ে তারা আমার কাছে এসেছে।
এই প্রতিবেদক আরিফুল ইসলাম চৌধুরীকে পরিচয় গোপন রেখে ফোন দেয়। আরিফুল ইসলাম পরিচয় জানতে চাইলে কৌশল অবলম্বন করে বলা হয়, অগ্রণী ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি আনিসুর রহমানের অফিসে বসে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। আপনি বর্তমানে এস. আলম গ্রুপের কোন পদে আছেন যেন? তিনি উত্তরে বলেন, ম্যানেজিং ডিরেক্টর। এস. আলম গ্রুপের কোন প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে আছেন- প্রশ্ন করলে তিনি জানান সেঞ্চুরি গ্রুপের কথা। হাসানুজ্জামানের পদ কি- জানতে চাইলে বলেন, সে ডাইরেক্টর হিসেবে আছে।
যেভাবে বের হয় ভয়াবহ ঋণ জালিয়াতির তথ্য
২০২৩ সালের শুরুর দিকে দেশের শীর্ষ ৫০ ঋণগ্রহীতার একটি তালিকা আসে এই প্রতিবেদকের হাতে। সেখানে আশ্চর্যজনকভাবে লক্ষ্য করা যায়, তালিকায় দেশের শীর্ষ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর নাম থাকার কথা থাকলেও ৪৯ নাম্বার সিরিয়ালে সেঞ্চুরি ফুড প্রোডাক্টস লিমিটেডের নাম। এই নামের কোনও প্রতিষ্ঠানের পণ্য বাংলাদেশের বাজারে না থাকায় সন্দেহ ঘনীভূত হয়।
কোন ব্যাংক থেকে ওই প্রতিষ্ঠানটি ঋণ নিয়েছে সেটি ওই তালিকায় উল্লেখ না থাকায় দীর্ঘ অনুসন্ধানে নামতে হয়। শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায়, ইসলামী ব্যাংকের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা ফান্ডেড ঋণ নিয়েছে সেঞ্চুরি ফুড। জয়েন স্টক কোম্পানিজে ইসলামী ব্যাংক এই ঋণের বিপরীতে ৬৫০ কোটি টাকা জামানত রাখার তথ্য দিলেও এটিকে অতিমূল্যায়িত বলেছেন ইসলামী ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবও দিচ্ছে ভিন্ন বার্তা। ২০২২ সালের ডিসেম্বর ভিত্তিক শীর্ষ ৫০ ঋণগ্রহিতার তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছে, সেঞ্চুরি ফুডের জামানতের পরিমাণ ১৮৯ কোটি ৪৫ লাখ টাকা।
এদিকে দেখা গেছে, মাত্র এক বছরেই প্রতিষ্ঠানটির ঋণের পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে। ২০২২ সালে সেঞ্চুরির ঋণের পরিমাণ ছিল ১ হাজার ৬৭১ কোটি টাকা।
এস. আলম গ্রুপের ঋণের দায় সমন্বয় ও পাচার
এস. আলম গ্রুপের ও ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেঞ্চুরি গ্রুপের নামে বের করা ঋণের অর্থ মূলতঃব্যবহৃত হয়েছে এস. আলম গ্রুপের ঋণের দায় শোধ করতে। অর্থাৎ, বিভিন্ন ব্যাংকে এস. আলম গ্রুপের যে বিপুল ঋণ রয়েছে, এসব ঋণের দায় শোধ করতেই সেঞ্চুরি গ্রুপের নামে ঋণ সৃষ্টি করা হয়েছে। এছাড়া, এই ঋণের একটি অংশ সদ্য বিদায়ী সরকারের আমলে প্রভাবশালী এক ব্যক্তির কাছে পাচার হয়েছে বলে জানিয়েছেন এস. আলম গ্রুপের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা।
বেনামি ঋণগুলোর হিসাব বাদ দিয়ে শুধু বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবেই বর্তমানে দেশের ১১টি ব্যাংকে এস. আলম গ্রুপের ফান্ডেড ঋণ আছে ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি। এরমধ্যে জনতা ব্যাংকে খেলাপির তালিকায় উঠেছে এস. আলম গ্রুপের নাম।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে আসলেও নিরব ছিল
সেঞ্চুরি ফুডের নাম দিয়ে ইসলামী ব্যাংক থেকে এস. আলম গ্রুপের বিপুল অর্থ বের করে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগ বিএফআইইউ’র প্রধান মাসুদ বিশ্বাসের সঙ্গে গত বছরের নভেম্বরে কথা বলে এই প্রতিবেদক। কিন্তু তিনি বিষয়টি শুনেও সচেতনভাবে এড়িয়ে যান। একই কাজ করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আরও একাধিক শীর্ষ কর্মকর্তা।
কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি তদন্ত দল সেঞ্চুরি ফুডের ঋণ জালিয়াতির বিষয়টি আচ করেছিল ২০২২ সালের ডিসেম্বরে। তারা ইসলামী ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির ১৯৫৯তম সভার নথিপত্র ঘেটে অনিয়মের মাধ্যমে সেঞ্চুরি ফুড প্রোডাক্টের নামে ১ হাজার ১২০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণের তথ্য পায়। এমনকি ঋণের নথিপত্রে যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে, পরিদর্শনে বাংলাদেশ ব্যাংক এসব প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পায়নি। এরপরও বাংলাদেশ ব্যাংক ‘আলতোভাবে’ সতর্ক করে ইসলামী ব্যাংককে। এমনকি, এই ঘটনার পর ইসলামি ব্যাংকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মিত তদন্ত একপ্রকার বন্ধ হয়ে যায়। ডিপার্টমেন্ট অব অফসাইট সুপারভিশনের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে ইসলামী ব্যাংকে কোন তদন্তে যেতে পারছেন না।
সেঞ্চুরির সর্ববৃহৎ ঋণ জালিয়াতির বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক জেনেও যে এড়িয়ে যেতে চাইছিল তা আরও স্পষ্ট হয়, ২০২৩ সালের নভেম্বরে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেওয়ার পরে। সেঞ্চুরিসহ কয়েকটি ঋণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে তথ্য চেয়েছিল দুদক। তখনও সেঞ্চুরির বিষয়ে নিরব থেকেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্টিকারযুক্ত গাড়িতে বস্তাভর্তি টাকা, উদ্ধার হলো যেভাবে
যা জানাল ইসলামী ব্যাংক
এমন একটি কাগুজে কোম্পানির অনুকূলে নামমাত্র জামানতে বিপুল পরিমাণ ঋণ বিতরণের কারণ জানতে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলার কার্যালয়ে কয়েকবার গেলেও তিনি সাক্ষাৎ দেননি। তাকে ফোন করা হলেও রিসিভ করেননি।
সেঞ্চুরি গ্রুপের সর্ববৃহৎ ঋণ জালিয়াতির বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকের সদ্যবিদায়ী অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ কায়সার আলী গত বছরের নভেম্বরে জুমবাংলা’কে বলেছিলেন, ‘গ্রুপ চেয়ারম্যানের (সাইফুল ইসলাম মাসুদ) নির্দেশেই সেঞ্চুরি ফুডকে ঋণ দেওয়া হয়েছে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।