জুমবাংলা ডেস্ক : বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের উদ্যোগে বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে থাকা উল্লেখযোগ্য অংকের টাকা ফেরত দেওয়া হয়েছে। কিউকম, ই-ভ্যালির মতো প্রতিষ্ঠান সরকারের ডিজিটাল কমার্স নীতিমালা অনুযায়ী আবার ব্যবসা শুরু করেছে।
এ ধরণের আরেক প্রতিষ্ঠান ই-অরেঞ্জ, যার মালিকানা নিয়ে জটিলতায় গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ অবস্থার অবসানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ই-অরেঞ্জ এর মালিকানা সংক্রান্ত বিষয়ের আইনগত নিস্পত্তি করতে বলেছে। অন্যদিকে এর প্রতিষ্ঠাতা গ্রাহকের অর্থ ফেরত এবং প্রতিষ্ঠান চালু করতে চান বলে জানা গেছে।
২০২০ সালে কোভিডের সময় অনলাইনে পণ্য বিক্রি ব্যাপকভাবে বাড়ে। এ সময় কিছু প্রতিষ্ঠান অত্যন্ত লোভনীয় অফার দিলে গ্রাহকরা প্রচুর অর্ডার দিতে শুরু করে। এক পর্যায়ে অভিযোগ আসতে থাকে, গ্রাহকদের অনেকেই টাকা দিয়েও পণ্য পাচ্ছেন না। প্রতারণার অভিযোগে তখন অনেক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা হয় এবং উদ্যোক্তাদের অনেকেই গ্রেপ্তার হন। হাজার হাজার গ্রাহকের টাকা আটকে যায়। গ্রাহকদের অর্থ ফেরত দিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে। কমিটি সংশ্লিষ্ট পেমেন্ট গেটওয়ে এবং ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে ধারাবাহিক বৈঠক করছে ও সমাধানের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে।
গত ২ অক্টোবর কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের কারিগরি কমিটির বৈঠকে জানানো হয়, বিভিন্ন পেমেন্ট গেটওয়েতে ৩৫টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের টাকা আটকে আছে। এর মধ্যে ১৫টি প্রতিষ্ঠান ৬৭ হাজার অর্ডারের বিপরীতে প্রায় ৪১১ কোটি টাকা গ্রাহকদের ফেরত দিয়েছে। এর মধ্যে লক্ষ্যণীয় বিষয় হচ্ছে, ই-অরেঞ্জ কোনো টাকা ফেরত দেয়নি। অথচ গ্রাহকদের প্রায় ৩৫ কোটি টাকা ই-অরেঞ্জ পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে আছে। প্রায় ৩ বছর পর প্রথমবারের মতো, ই-অরেঞ্জ এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাক্তন মালিক সোনিয়ার পক্ষে উপস্থিত আইনজীবী মো. শামসুল হুদা সভায় জানান, প্রতিষ্ঠানটির মালিকানা নিয়ে জটিলতা রয়েছে। এর প্রতিষ্ঠাতা উদ্যোক্তা সোনিয়া মেহজাবিন ২০২১ সালে জানুয়ারি মাসে ৩০০ টাকার ষ্ট্যাম্পে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে চুক্তিনামা করে জনৈকা বিথী আক্তারের কাছে ই-অরেঞ্জ এর মালিকানা হস্তান্তর করেন। চুক্তিনামা অনুযায়ী পহেলা এপ্রিল’২১ থেকে ই-অরেঞ্জ এর সকল দায়িত্ব বিথী আক্তার এর। বিথী আক্তার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্সে মালিকানা পরিবর্তন করে তার নামে করে নিয়েছেন এবং তার স্বাক্ষরে ব্যাংক হিসাব থেকে টাকাও তুলেছেন। কিন্তু বিথী আক্তার এখন আর মালিকানা দাবি করছেন না। অন্যদিকে সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমান কারাগারে আটক রয়েছেন। তাদের জামিনে মুক্তি দিয়ে মালিকানা ফেরত দেওয়া হলে গ্রাহকের অর্থ ফেরত দেওয়া সম্ভব হবে। সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ই-অরেঞ্জ মালিকানা সংক্রান্ত বিষয় আইনগতভাবে নিস্পত্তি করে ২৩ অক্টোবরের মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করবে।
ই-অরেঞ্জের মালিকানা সংক্রান্ত বিষয়টি আইনগতভাবে নিস্পত্তির বিষয়ে সম্প্রতি সোনিয়া মেহজাবিনের পক্ষে তার আইনজীবী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, ই-অরেঞ্জ এর প্রতিষ্ঠাতা সোনিয়া মেহজাবিন ২০২১ সালের ১ এপ্রিল থেকে আর মালিক নন। আর বীথি আক্তার মালিক হবার পরও, এখন মালিকানা দাবি করছেন না এবং গ্রাহকদের জন্য কাজ করছেন না। এ অবস্থায় বিভিন্ন মামলার চার্জশীট থেকে সোনিয়া মেহজাবিন এবং তার স্বামীর নাম বাদ দিয়ে তাদেরকে জামিনে মুক্তি দিলে এবং মালিকানা ফেরতের ব্যবস্থা নিলে গ্রাহকের অর্থ ফেরত দেওয়া সহজতর হতো এবং ব্যবসা পুনরায় চালু করার সম্ভাবনা তৈরি হতো।
চিঠিতে জানানো হয়, মালিকানার বিষয়টি আরবিট্রেশনের মাধ্যমে মীমাংসা করার চেষ্টা করা হবে অথবা ক্রয়-বিক্রয় চুক্তিনামা বাতিল করার জন্য মামলা করা হবে। তবে সোনিয়া মেহজাবিন কারাগারে থাকায় মালিকানা বিষয়ে মামলা করতে বেশ প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হচ্ছে। মামলার আরজি, ওকালতনামা, হলফনামাসহ বিভিন্ন জায়গায় তার স্বাক্ষরের দরকার হবে, যা দ্রততম সময়ে শেষ করা কঠিন। মালিকানার বিষয়টি আইনগতভাবে নিস্পত্তির জন্য এক মাস সময় চাওয়া হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর তথা ভোক্তা অধিকার দপ্তরে নভেম্বর ১৪/২০২৪ এর মধ্যে সকল অভিযোগ দিতে বলা হয়েছিল। সোনিয়া মেহজাবিন বর্তমান মালিক না হয়েও সকল গ্রাহকের বৃহত্তর কল্যাণে সাড়ে ৩ বছর ধরে জেল খেটেও ই-অরেঞ্জ এর জন্য কাজ করার নিমিত্তে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ শুরু করা, মালিকানা ফেরত পেতে কাজ শুরু করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছেন ও নিচ্ছেন। গ্রাহকদের জন্যই সোনিয়া ও মাসুকুর এর জামিনে মুক্তি পাওয়াটা অতি জরুরি। এখন যদি কোনো মহলের প্ররোচণা বা কারো কথায় নতুন করে মামলা করা হয় বা সোনিয়া ও মাসুকুরকে জামিন পেতে বেগ পেতে হয় তাহলে বুঝতে হবে সত্যিকার অর্থে ই-অরেঞ্জ এর গ্রাহকদের আটকে পড়া অর্থের সমাধান হোক এটা কোনো একটা দুষ্টু মহল চায় কিনা। নভেম্বর ১৪ এর পরে যদি কোনো গ্রাহক মামলা করেন সেটাও উদ্দেশ্য প্রণোদিত ও ই-অরেঞ্জ এর চালু হওয়া বা সমাধানকে বিলম্বিত করা ছাড়া আর কিছু নয়।
সোনিয়া মেহজাবিন ও মাসুকুর রহমান এর পক্ষে আইনজীবী শামসুল হুদা জানান, ই-অরেঞ্জের সার্ভারের নিয়ন্ত্রণ এখন সোনিয়া মেহজাবিনের হাতে নেই। এর নিয়ন্ত্রণ বীথি আক্তারের কাছে। কিন্তু বীথি আক্তার বর্তমানে পলাতক এবং মালিকানা দাবি করছেন না। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেলের সভাতেও সার্ভার নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও এই ব্যাপারে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। এমতাবস্থায় সার্ভারে গ্রাহকের সকল তথ্য রয়েছে। কোন গ্রাহক কত টাকা দিয়েছেন, কবে দিয়েছেন, কোন পণ্য অর্ডার করেছেন, ডেলিভারি পেয়েছেন নাকি পাননি, কত টাকা পাবেন- এ জাতীয় সকল তথ্য রয়েছে। এসকল তথ্য সঠিক অবস্থায় পাওয়া না গেলে গ্রাহকের অর্থ ফেরত নিয়ে বড় ধরণের সমস্যা হবে। এ কারণে সার্ভার অতি দ্রুত আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের হেফাজতে নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, ই-অরেঞ্জ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। এর চাকুরিচ্যুত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নাজমুল আলম রাসেল যিনি ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে জামিনে বের হয়েছেন। আর বর্তমান প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আমানউল্লাহ। (যিনি সমপ্রতি জামিনে বের হয়েছেন) বীথি আক্তার অথবা আমানউল্লাহ কেউই এটি চালুর উদ্যোগ নেননি। তারা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কোনো যোগাযোগও করেননি। বীথি আক্তার পলাতক রয়েছেন। এ অবস্থায় গ্রাহকের টাকা ফেরত এবং পুনরায় ব্যবসা চালুর বিষয়ে আইনগত সমাধান জরুরি। আর শুধু পেমেন্ট গেটওয়ের টাকা ফেরত দিলেই সমস্যার সমাধান হবে না। এর বাইরে গ্রাহকের অনেক অনিস্পন্ন ইস্যু রয়েছে। আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করা এবং একটি অডিট ফার্মকে দিয়ে নিরীক্ষা করলে প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত পরিস্থিতি জানা যাবে। সব মিলিয়ে গ্রাহকদের স্বার্থে ই-অরেঞ্জ নিয়ে জটিলতার অবসান জরুরি।
প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ এনে দায়ের করা মামলায় ই-অরেঞ্জ শপ এর প্রতিষ্ঠাতা সোনিয়া মেহজাবিন ২০২১ সালের ১৭ আগষ্ট আদালতে আত্মসমর্পন করেন। শুধুমাত্র তার স্বামী হবার কারণে মাসুকুর রহমানও আসামী হন এবং তিনিও আত্মসমর্পন করেন। তিন বছরের একটি শিশু সন্তানকে বাইরে রেখে তারা দুজনই তিন বছর ধরে কারাগারে আছেন। ই-অরেঞ্জ এর নামে প্রথম মামলার এজাহারে আনুমানিক ১১০০ কোটি টাকার প্রতারণা ও আত্মসাতের উল্লেখ করা হয়। কিন্তু তদন্তকারী কর্মকর্তা চার্জশীটে ৩ কোটি টাকার দাবি করেন। ১১০০ কোটি টাকার মতো বড় অংকের ধারণার ভিত্তিতে সিআইডি ২৩২ কোটি টাকার মানি লন্ডারিং মামলা করেন। আবার হাইকোর্টে বেশকিছু গ্রাহকের পক্ষে রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংক ই-অরেঞ্জ এর সকল ব্যাংক হিসাব পর্যালোচনা করে দেশের বাইরে বা মালিকপক্ষের কোনো ব্যাংক হিসাবে টাকা যায়নি বলে হাইকোর্টে রিপোর্ট দেয়।
উল্লেখ্য, গত ২ অক্টোবর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভায় কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া ই-ভ্যালির সিইও মো. রাসেল জানান, ই-ভ্যালি ব্যবসা করার মাধ্যমে গ্রাহকের পাওনা সকল অর্থ ফেরত দেবে। কিউকমের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রিপন মিয়া জানান, ‘এসক্রো’ সিষ্টেমে আটকে থাকা সকল টাকাই তারা গ্রাহকদের ফেরত দিয়েছেন। সভায় সুপারিশ করা হয় যে, পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে থাকা অর্থ দ্রুত ফেরত দেওয়ার উদ্যোগ প্রয়োজন। এজন্য সকল ডিজিটাল কমার্স প্রতিষ্ঠানকে চূড়ান্ত গ্রাহক তালিকা দাখিল করার জন্য এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে গ্রাহকদের অভিযোগ জমা দেওয়ার জন্য গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়া যেতে পারে। সেই মোতবেক কেন্দ্রীয় ডিজিটাল কমার্স সেল ১৪ নভেম্বরের মধ্যে গ্রাহক তালিকা দাখিল এবং অভিযোগ জানানোর জন্য ইতিমধ্যে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।