গোপাল হালদার, পটুয়াখালী : শুরুতে কেউ বুঝতে পারেনি। সাজসজ্জা দেখে মনে হতে পারে, হয়তো কারও বিয়ের উৎসব। চারপাশে ব্যানার, বাদ্যযন্ত্র, স্লোগান, লোকজনের হই-হুল্লোড়, কেউ ভিডিও করছে আবার কেউবা তুলছে সেলফি। মিনি ট্রাকে সাজানো আছে বিশাল কালো রঙের এক ষাঁড়।
কিন্তু কাছে গিয়ে বোঝা গেল-এটা কোনো বিয়ের আয়োজন নয়। এটা এক ভালোবাসার মহোৎসব। উৎসবটি ঘিরে আছে এক অসম্ভব স্বপ্ন-পটুয়াখালীর এক দরিদ্র কৃষক সোহাগ মৃধার নিজের হাতে লালন-পালন করা ষাঁড়টি উপহার দিতে চান তাঁর প্রিয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে। ষাঁড়টির নাম-‘কালো মানিক’।
পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ উপজেলার উত্তর ঝাটিবুনিয়া গ্রামে সোহাগ মৃধা ২০১৮ সালের শেষের দিকে চৈতা বাজার থেকে মাত্র ১ লাখ ৩৭ হাজার টাকায় একটি গাভি কিনেছিলেন। অল্প সময়ের মধ্যে গাভিটি একটি বাছুর প্রসব করে। পরে গাভিটি বিক্রি করে বাছুরটিকে রেখে দেন তিনি। আর সেই বাছুরই আজকের এই কালো মানিক।
ছয় বছরের যত্ন, আদর আর কঠোর পরিশ্রমের ফসল বিশাল আকৃতির ষাঁড়টির এখন ওজন প্রায় ৩৫ মণ, দৈর্ঘ্য ১০ ফুট, উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। স্থানীয় বাজারে গত বছর কোরবানির সময়ে ষাঁড়টির দাম উঠেছে ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু সোহাগের সাফ কথা-‘এই ষাঁড় বিক্রির জন্য না-এটা তার নেত্রীর জন্য।’
ঢাকায় ষাঁড়টি পৌঁছে দেওয়ার প্রস্তুতি চলে বেশ কিছুদিন ধরেই। দুইটি মিনি ট্রাক ভাড়া করা হয়েছে, খরচ হবে প্রায় ৬০ হাজার টাকা। দলের প্রতীকে সুসজ্জিত ব্যানার, কাপড়, এমনকি বাদ্যযন্ত্রের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। গ্রামের শত শত মানুষ মিলে তৈরি করেছে এক আনন্দ-উৎসবের পরিবেশ-যেন বিয়ের শোভাযাত্রা, অথচ পাত্র এই উৎসবের সবচেয়ে আলাদা চরিত্র ‘কালো মানিক’।
সোহাগ মৃধা বলেন, ‘ভাইরালের জন্য না। আমি সত্যিই চাই, নেত্রীর কোরবানির জন্য যাক আমার কালো মানিক। এতে আমার কোনো লাভ নেই-শুধু ভালোবাসা আছে।’
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ শাসনামলে ২০২৩ সালে সংবাদমাধ্যমে দেখেছিলাম, এক কৃষক গরু উপহার দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তখন মনে মনে ইচ্ছা হয়েছিল-যদি কোনো দিন সুযোগ পাই, আমিও আমার প্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে একটি গরু উপহার দেব। আজ সেই সুযোগ এসেছে। আল্লাহ যদি কবুল করেন এবং নেত্রী যদি এই গরু গ্রহণ করেন, তাহলে আমার দীর্ঘদিনের ইচ্ছা পূরণ হবে। আশা করি, নেত্রী আমাকে নিরাশ করবেন না।’
প্রথমে অনেকে ভেবেছিল, সোহাগ হয়তো একটু বাড়াবাড়ি করছে। কিন্তু এখন তার বাড়ির উঠোনে লোকজনের ভিড় দেখে, কেউই আর অবিশ্বাস করেন না।
প্রতিবেশী মতিয়ার মিয়া বলেন, ‘প্রথমে ভাবছিলাম মজা করছে। এখন বুঝি, সে সত্যি করে বলছে। এটা শুধু গরু না-একজন কৃষকের ত্যাগ, ভালোবাসা আর রাজনীতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।’
সোহাগের মা হাজেরা বেগম বলেন, ‘ও ছোটবেলা থেইকাই বিএনপি ভালোবাসে। কয় বছর ধইরা কয়-এই গরু নেত্রীরে দিব। সংসারে কত কষ্ট গেছে, কত সময় ভাত কম খাইছি; কিন্তু ওরে থামাই নাই। মানিকরে আমরা ঘরের মানুষ বানাইয়া রাখছি। আজ যাইতেছে ঢাকায়, আমাদের গোয়াল ঘর খালি হইয়া যাইবে। চোখে পানি আসে, কিন্তু মনে শান্তি লাগে-নেত্রী যদি গ্রহণ করেন, তয় আমরা ধন্য হইয়া যামু।’
সোহাগের স্ত্রী পলি বেগম বলেন, ‘আমরা এই মানিকরে ৬ বছর সন্তানের মতোই মানুষ করছি। গায়ে সর্দি লাগলে ওষুধ দিছি, খাইছে কি না সেই দুশ্চিন্তা করছি। আজ যাইতেছে ঢাকায়, ঘর ফাঁকা লাগবে। কিন্তু এই কান্না দুঃখের না-এটা খুশির কান্না। যদি নেত্রী এই গরু গ্রহণ করেন, তয় আমাদের সব কষ্ট সার্থক হইব।’
সোহাগ জানেন না আদৌ বেগম খালেদা জিয়া তাঁর এই উপহার গ্রহণ করবেন কি না। তিনি এটাও জানেন না, ঢাকায় পৌঁছেও যদি ফিরিয়ে দেওয়া হয়, তবুও তাঁর ভালোবাসা কখনোই কমবে না। কারণ তাঁর চোখে কালো মানিক কেবল একটি গরু নয়-এটি তার শ্রদ্ধা, ভালোবাসা এবং রাজনৈতিক চেতনার এক জীবন্ত প্রতীক।
শেষ কথায় সোহাগ বললেন, ‘ভালোবাসা দিয়া হিসাব কষা যায় না ভাই। নেত্রী যদি না-ও নেন, তবু শান্তি পাব-চেষ্টা তো করছি। এইটাই আমার জীবনের বড় পাওয়া।’
আমড়াগাছিয়া ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সোহাগ আমাদের দলের একনিষ্ঠ, ত্যাগী কর্মী। গরুটি নেত্রীকে উপহার দেওয়ার কথা যখন প্রথম বলল, তখন আমরা অনেকেই বিশ্বাস করতে পারিনি। ভেবেছিলাম, আবেগে বলছে। কিন্তু ধাপে ধাপে ওর প্রস্তুতি দেখে এখন স্পষ্ট বুঝি-এটা শুধু আবেগ না, এটা ওর বিশ্বাস, ভালোবাসা আর রাজনীতির প্রতি দায়বদ্ধতা। আজকাল রাজনীতিতে এতটা নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দেখা যায় না। সোহাগ তা প্রমাণ করেছে। আমরা গর্বিত, এমন একজন কর্মী আমাদের ইউনিয়নে আছে। আগামী ক’দিনের মধ্যেই কালো মানিক ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হবে। আমরা তার সফলতা কামনা করি।’
আজ পটুয়াখালী থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছে কালো মানিক-সঙ্গে গেছে সোহাগের ছয় বছরের ত্যাগ, পরিবারের গর্ব আর প্রিয় নেত্রীর প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। এটা শুধু একটি ষাঁড়ের যাত্রা নয়-এটা এক কৃষকের অন্তরের কোরবানি।
শোভাযাত্রা ধীরে ধীরে গ্রামের পথ ধরে এগিয়ে চলছে-বাদ্যযন্ত্র বাজছে, মানুষ দোয়া করছে, কেউ কেউ কাঁদছে। কেউ বলছে, ‘যদি নেত্রী জানতেন এই ভালোবাসার কথা, হয়তো চোখ ভিজে যেত তাঁরও।’
খালেদা জিয়ার হাতে গুলশানের বাড়ির নামজারির কাগজ পৌঁছে দিল সরকার
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।