মো. জাকির হোসেন: বিশ্বের ত্রাস, করেনাভাইরাস। জীবন-মৃত্যুর ব্যবধান করোনা আক্রান্তের একটি মাত্র ছোঁয়া, একটি মাত্র নি:শ্বাস। অনেক দেশের পরিসংখ্যান বলছে ৫০ শতাংশের অধিক করোনা আক্রান্তের কোন উপসর্গই নেই। বাংলাদেশেও অনেক আক্রান্ত মিলেছে যাদের করোনার লক্ষণ নেই। শপিং মলে আপনিও যে, উপসর্গহীনের দ্বারা আক্রান্ত হবেন না তার গ্যারান্টি কোথায়? একসাথে অনেক মানুষ আক্রান্ত হলে চিকিৎসার সুযোগই বা কোথায়? স্বাস্থ্য অবকাঠামো ও ব্যবস্থাপনার দূর্বলতা আমাদের অজানা কী? করোনা কেবল শ্বাসতন্ত্রকেই ছিন্নভিন্ন করছে না, এর ফলে অর্থনীতিরও নাভিশ্বাস ওঠেছে। করোনাকালে অনেক মানুষ দু’মুঠো খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে। বিপন্ন মানবতার এ বিরুদ্ধ সময়ে শপিং মলে গিয়ে ভয়ানক করোনার সম্ভাব্য শিকারে পরিণত না হয়ে চলুন কিছু সাহায্য নিয়ে মানবতার পাশে দাঁড়াই।
আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আল্লাহ তা’আলা কিয়ামতের দিন বলবেন, হে বানী আদম! আমি অসুস্থ ছিলাম। তুমি আমাকে দেখতে আসোনি। সে বলবে, হে আমার রব! আমি তোমাকে কিভাবে দেখতে যাব? তুমি তো বিশ্বজাহানের রব! আল্লাহ বলবেন, তুমি কি জানতে না যে, আমার অমুক বান্দা অসুস্থ ছিল? তুমি তাকে দেখতে যাওনি। তুমি কি জানতে না যে, তুমি যদি তাকে দেখতে যেতে, আমাকে অবশ্যই তার কাছে পেতে। হে আদম সন্তান! আমি তোমার কাছে খাবার চেয়েছিলাম। তুমি আমাকে খাবার দাওনি। সে বলবে, হে আমার রব! আমি তোমাকে কিভাবে খাবার দিতাম? তুমি তো বিশ্বজাহানের রব। আল্লাহ বললেন, তুমি কি জানো না, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে খাবার চেয়েছিল? তুমি তাকে খাবার দাওনি। তুমি কি জানতে না যে, সে সময় যদি তুমি তাকে খাবার দিতে তাহলে তা এখন আমার কাছে পেতে? হে বানী আদম! আমি তোমার কাছে পিপাসা নিবারণের জন্য পানি চেয়েছিলাম। তুমি পানি দিয়ে তখন আমার পিপাসা নিবারণ করোনি। সে বলবে, হে আমার রব! আমি কিভাবে তোমার পিপাসা নিবারণ করতাম? তুমি তো বিশ্বজাহানের রব। আল্লাহ বলবেন, আমার অমুক বান্দা তোমার কাছে পানি চেয়েছিল, তুমি তখন তাকে পানি দাওনি। যদি তুমি সে সময় তাকে পানি দিতে, তাহলে তা এখন আমার কাছে পেতে। ( মুসলিম ২৫৬৯, ইবনু হিব্বান ৯৪৪, সহীহ আদাবুল মুফরাদ ৫১৭, সহীহ আত্ তারগীব ৯৫২, সহীহ আল জামি’ আস্ সগীর ১৯১৬)।
অসহায় বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর ব্যাপারে কুরআ’ন ও হাদিসের আরও কিছু আদেশ-নির্দেশ –
১. পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে, ‘তাদের (বিত্তশালী) ধনসম্পদে অভাবগ্রস্ত ও বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে।’ (সূরা জারিয়াত, আয়াত: ১৯)। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও, অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজ-খবর নাও, বস্ত্রহীন লোকদের বস্ত্র দাও এবং বন্দিকে মুক্ত করে দাও।’ (বোখারি, ২৪১৭)।
২. মহানবী (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়ায় অপরের একটি প্রয়োজন মিটিয়ে দেবে, পরকালে আল্লাহ তার ১০০ প্রয়োজন পূরণ করে দেবেন এবং বান্দার দুঃখ-দুর্দশায় কেউ সহযোগিতার হাত বাড়ালে আল্লাহ তার প্রতি করুণার দৃষ্টি দেন।’ (মুসলিম, ২৫৬৬)।
৩. আল্লাহতা’য়ালা পবিত্র কেোরআনে বলেন, “মুমিনরা পরস্পর ভাই ভাই।”(সূরা হুজরাত : ১০) রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আল্লাহতায়ালা বান্দার সাহায্যে ততক্ষণ থাকেন, যতক্ষণ সে অপর ভাইয়ের সাহায্যে থাকে।’ (মুসলিম, ২৩১৪)। নোমান (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন, ‘সব মুমিন দেহের মতো। যখন তার চোখে যন্ত্রণা হয়, তখন তার পুরো শরীরই তা অনুভব করে। যদি তার মাথাব্যথা হয়, তাতে তার পুরো শরীরই বিচলিত হয়ে পড়ে।’ (মুসলিম, ২৫৮৬) রাসূলুল্লাহ (সা.) আরও এরশাদ করেন, ‘মুমিনরা পারস্পরিক ভালোবাসা ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে এক দেহের মতো। দেহের কোনো অঙ্গ আঘাতপ্রাপ্ত হলে পুরো দেহ সে ব্যথা অনুভব করে।’ (বোখারি, ৬০১১)
৪. আল্লাহ রাব্বুল আলামিন পবিত্র কুরআনে অন্যত্র এরশাদ করেন, “তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি তথা তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে দরিদ্র, এতিম ও বন্দিদের খাদ্য দান করে।” (সূরা দাহর, আয়াত: ৮)। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে মুসলমান অপর কোনো মুসলমানকে বস্ত্রহীন অবস্থায় বস্ত্র দান করবে, আল্লাহ তাকে জান্নাতে সবুজ বর্ণের পোশাক পরাবেন, খাদ্য দান করলে তাকে জান্নাতের ফল খাওয়াবেন, পানি পান করালে জান্নাতের শরবত পান করাবেন।’ (আবু দাউদ, ১৭৫২)
৫. মহান আল্লাহ আরও ইরশাদ করেন, “ইমানদার পুরুষ ও ইমানদার নারী একে অপরের সহায়ক।” (সূরা তওবা: ৭১)। রাসূল (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তার প্রতি দয়া করেন, যে তার বান্দাদের প্রতি দয়া করে।’ (বোখারি, ১৭৩২)।
৬. হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের পার্থিব দুঃখ-কষ্ট দূর করবে, আল্লাহতায়ালা কিয়ামতে তার দুঃখ-কষ্ট দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো সংকটাপন্ন ব্যক্তির সংকট নিরসন করবে, আল্লাহ তার দুনিয়া ও আখেরাতের যাবতীয় সংকট নিরসন করে দিবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। আর আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দার সাহায্য করে থাকেন, যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দা নিজ ভাইয়ের সাহায্যে রত থাকে। (মুসলিম ও তিরমিজি) অন্য আরেক হাদিসে রাসূলে (সা.) বলেন, প্রত্যেক মুসলমানের ওপর সদকা করা ওয়াজিব। একজন প্রশ্ন করলেন, যদি কারো সে সামর্থ্য না থাকে, তবে কি হবে? সাহাবাদের পর্যায়ক্রমিক প্রশ্নের উত্তরে এক পর্যায় নবী (সা.) বলেন, ‘তাহলে কোনো দুঃখে বা বিপদে পতিত ব্যক্তিকে সাহায্য করবে।’ (মিশকাত)
৭.আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি বিধবা, গরিব, অভাবী ও অসহায়দের সাহায্যের জন্য চেষ্টা-তদবির করে, সে আল্লাহর পথে ব্যস্ত ব্যক্তির সমতুল্য। (হাদিস বর্ণনাকারী বলেন) আমার মনে হয়, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সে রাত জেগে অবিরাম নফল নামাজ আদায়কারী এবং অবিরত নফল রোজা পালনকারীর সমতুল্য। (সহিহ বোখারি ও মুসলিম) যারা বিপদগ্রস্ত ও গরিব-দুঃখীকে দান করেন আল্লাহ তাদের পুরস্কৃত করেন। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আরেক হাদিসে বলা হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেন, হে আদম সন্তান! তুমি (আমার অভাবী বান্দাদের জন্য) নিজের উপার্জন থেকে খরচ কর, আমি আমার ভাণ্ডার থেকে তোমাকে দিতে থাকব। (সহিহ বোখারি ও মুসলিম)
৮. হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) ও হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত; তারা বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, গোটা সৃষ্টিকুল আল্লাহর পরিবার। অতএব যে আল্লাহর পরিবারের সঙ্গে সদয় ব্যবহার করে, সে আল্লাহর কাছে সর্বাধিক প্রিয়। (বায়হাকি)
সৃষ্টি জগতের সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ। দুনিয়ার সব সম্পদের মালিক আল্লাহ। মানুষ যে সম্পদের অধিকারী, তা মূলত মহান আল্লাহর কৃপার ফসল। আল্লাহ যাকে অর্থ-সম্পদ দিয়েছেন তিনি সে সম্পদ থেকে অভাবী মানুষকে সাহায্য করলে তাতে আল্লাহতা’য়ালা খুশি হন। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। সেই মানুষেরই একটা অংশ গরীব-দুস্থ। তারা আমাদের সমাজেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। গরীব-দুস্থসহ সমাজের আশ্রয়হীন, দুর্বল ও অসহায় মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করা ইসলামে অন্যতম ইবাদত।
আমি ও আমার পরিবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমরা এবার ঈদ শপিং-এ যাব না। তার বদলে করোনাকালে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবো। পোশাক নয়, আখিরাতের সম্বল সংগ্রহ করবো। বিপন্ন মানবতার সেবায় আখিরাতের সম্বল ক্রয়ের এ শপিং-এ আপনিও সহযাত্রী হবেন কী?
লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল: [email protected]
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।