উইলিয়াম ব্র্যাডফোর্ড শকলির জন্ম ১৯১০ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্যের লন্ডনে। তাঁর মার্কিন মা–বাবা তখন কাজের সূত্রে লন্ডনে বাস করছিলেন। বাবা উইলিয়াম হিলম্যান শকলি ছিলেন মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার বা খনন প্রকৌশলী। আর মা মে শকলি ছিলেন খনিজ সম্পদ জরিপের প্রধান। মা-বাবা দুজনই উচ্চশিক্ষিত ও উচ্চপদে কর্মরত। এ সুবাদে ও একমাত্র সন্তান হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই বিশেষ জ্ঞান ও আভিজাত্যের ভেতর দিয়ে মানুষ হয়েছেন উইলিয়াম শকলি।
তাঁর তিন বছর বয়সে, ১৯১৩ সালে তিনি মা-বাবার সঙ্গে ফিরে আসেন যুক্তরাষ্ট্রে, ক্যালিফোর্নিয়ার পালো আল্টোয়। তাঁদের প্রতিবেশী ছিলেন স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফিজিকসের অধ্যাপক পার্লি রস। অধ্যাপক রস শকলিকে খুব স্নেহ করতেন। তাঁর প্রভাবে শকলি ছোটবেলা থেকেই পদার্থবিজ্ঞানে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
শকলির মা-বাবা নিজেরাই বাড়িতে প্রাথমিক শিক্ষা দেন শকলিকে। তারপর তাঁকে ভর্তি করানো হয় পালো আল্টো মিলিটারি একাডেমিতে। এরপর হলিউড হাইস্কুলে। ১৯২৭ সালে স্কুল শেষে ভর্তি হন লস অ্যাঞ্জেলেসের ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ায়। এক বছর সেখানে পড়ার পর চলে গেলেন ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি বা ক্যালটেকে। সেখান থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৩২ সালে। স্নাতকের ফলের ভিত্তিতে এমআইটির টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ লাভ করেন শকলি। তিনি সোডিয়াম ক্লোরাইডের ক্রিস্টাল বা কেলাসে ইলেকট্রনের ওয়েভ ফাংশনসংক্রান্ত গবেষণা করে এমআইটি থেকে পিএইচডি অর্জন করেন পদার্থবিজ্ঞানে, ১৯৩৬ সালে।
সলিড স্টেট ফিজিকসে ভীষণ দক্ষতা ছিল শকলির। পিএইচডি লাভের সঙ্গে সঙ্গেই চাকরি পেয়ে গেলেন তিনি বেল টেলিফোন ল্যাবরেটরিতে। সে সময় টেলিফোন প্রযুক্তি খুব একটা শক্তিশালী ছিল না। ট্রান্সমিটার ও রিসিভারে ব্যবহার করা হতো বড় বড় ভ্যাকুয়াম টিউব। টেলিফোনের তার দিয়ে হাজার-দেড় হাজার কিলোমিটারের বেশি দূরত্বে শব্দ পাঠাতে গেলে শব্দের মান অনেক কমে যেত। নয়েজ বেড়ে গিয়ে আসল শব্দের কিছুই শোনা যেত না। বেল টেলিফোন ল্যাবরেটরিতে উইলিয়াম শকলির প্রথম গবেষণা প্রকল্প হলো, আরও উন্নত মানের ভ্যাকুয়াম টিউব উদ্ভাবন করা। এগুলোর সাহায্যে শব্দের প্রাবল্য বাড়ানো সম্ভব হয়।
সলিড স্টেট সেমিকন্ডাক্টরের তত্ত্বকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করলেন শকলি। কিন্তু তখনো জার্মেনিয়াম কিংবা সিলিকনের মতো সেমিকন্ডাক্টর সহজে ব্যবহারযোগ্য হয়ে ওঠেনি। ১৯৩৯ সালে শকলি ফিল্ড ইফেক্ট ট্রানজিস্টরের তত্ত্ব দেন, পাশাপাশি চেষ্টা করেন গবেষণাগারে তৈরির। তাঁর পরিকল্পনা ছিল ভ্যাকুয়াম টিউবের বদলে ট্রানজিস্টর ব্যবহার করে টেলিফোন–ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি ঘটানো। কিন্তু সে পরিকল্পনা কার্যকর হওয়ার আগেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বেল ল্যাবরেটরি যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর হয়ে অনেকগুলো প্রকল্প নিয়ে গবেষণা করে। রাডারের যন্ত্রপাতির ইলেকট্রনিক ডিজাইনের দায়িত্ব পড়ে শকলির ওপর। ১৯৪২ সালে তিনি মার্কিন নৌবাহিনীর অ্যান্টিসাবমেরিন অপারেশন রিসার্চ গ্রুপের ডিরেক্টর নিযুক্ত হন। মার্কিন নৌবাহিনী সাবমেরিন ধ্বংস করার অনেক কার্যকর পদ্ধতি উদ্ভাবন করে তাঁর তত্ত্বাবধানে। ১৯৪৪ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি মার্কিন সরকারের যুদ্ধবিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নতুন নতুন যুদ্ধকৌশল উদ্ভাবন করে খুব আনন্দ পেতেন শকলি।
যুদ্ধ শেষে আবার বেল ল্যাবে ফিরে এলেন শকলি। ল্যাবের প্রেসিডেন্ট মারভিন কেলি সেমিকন্ডাক্টর ফিজিকস ভালোভাবে বোঝার জন্য একটি রিসার্চ গ্রুপ তৈরি করেন। ইলেকট্রনিকসে সেমিকন্ডাক্টর ব্যবহারের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছিল তখন। সিলিকন কেলাসের অদ্ভুত কিছু ধর্ম সে সময় আবিষ্কৃত হয়েছে। সেগুলোর তত্ত্ব তখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। শকলি রিসার্চ গ্রুপের সুপারভাইজার নিযুক্ত হলেন। তিনি বেছে বেছে উদীয়মান পদার্থবিজ্ঞানীদের নিয়ে এলেন নিজের গ্রুপে। জন বার্ডিন, ওয়াল্টার ব্র্যাটেইন, জেরাল্ড পিয়ারসন, মরগান স্পার্কস প্রমুখ তরুণ বিজ্ঞানীদের নিয়ে এসেছিলেন নিজের রিসার্চ গ্রুপে।
সলিড স্টেট ফিজিকসে কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রয়োগ তখন শুরু হচ্ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রাডারের ডিটেক্টর হিসেবে জার্মেনিয়াম ও সিলিকন পয়েন্ট কন্ট্যাক্ট ডিটেক্টর ব্যবহার করেছিলেন শকলি। এবার তিনি একইভাবে ফিল্ড এফেক্ট ট্রানজিস্টর উদ্ভাবন করার চেষ্টা করলেন। কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের হিসাব অনুসারে, জার্মেনিয়াম ফিলামেন্টে বিদ্যুৎপ্রবাহ চালনা করলে ভ্যাকুয়াম টিউবের গ্রিডের মতো বিদ্যুৎপ্রবাহ নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কথা। কিন্তু শকলি পরীক্ষাগারে আশানুরূপ ফল পেলেন না। শুধু তা-ই নয়, কেন আশানুরূপ ফল পাচ্ছেন না, তার কোনো বিশ্বাসযোগ্য কারণও খুঁজে পেলেন না।
শকলির পরীক্ষণের ব্যর্থতা থেকে নতুন ধারণা পেলেন জন বার্ডিন। বার্ডিনের ব্যাখ্যা ছিল এ রকম—জার্মেনিয়াম সেমিকন্ডাক্টরে বিদ্যুৎপ্রবাহ চালনা করলে এর উপরিতলে কিছু ইলেকট্রন আটকে থাকে। এই আটকে থাকা ইলেকট্রনের কারণে বিদ্যুৎক্ষেত্রের মধ্যে রাখলেও ইলেকট্রন আর সেমিকন্ডাক্টর ক্রিস্টাল বা কেলাসে প্রবেশ করতে পারে না। এ ধারণার সত্যতা পরীক্ষা করে দেখার জন্য অনেকগুলো পরীক্ষণ ডিজাইন করা হলো বেল ল্যাবে। জন বার্ডিন ও ওয়াল্টার ব্র্যাটেইন এই পরীক্ষণগুলো করেন। উইলিয়াম শকলি সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। বার্ডিন ও ব্র্যাটেইন উদ্ভাবন করলেন প্রথম পয়েন্ট কন্ট্যাক্ট ট্রানজিস্টর।
শকলি যেমন প্রতিভাবান ছিলেন, তেমনি ভীষণ রকমের প্রশংসাপ্রিয় ছিলেন। যেকোনো কিছুতেই তিনি নিজের কৃতিত্ব দাবি করতেন। তাঁর রিসার্চ গ্রুপ থেকে প্রথম ট্রানজিস্টর উদ্ভাবিত হয়েছে, অথচ কৃতিত্বের ভাগ তিনি পাবেন না, তা মেনে নিতে পারছিলেন না কিছুতেই। ট্রানজিস্টরের পেটেন্ট বার্ডিন ও ব্র্যাটেইনের নামে হওয়ার পর সেটার পরীক্ষামূলক ব্যবহার যখন শুরু হলো, শকলি তখন উদ্ভাবন করলেন জাংশন ট্রানজিস্টর। সেই ট্রানজিস্টরের পেটেন্ট পেলেন তিনি।
১৯৫০ সালে উইলিয়াম শকলি লিখলেন তাঁর প্রথম বই ইলেকট্রনস অ্যান্ড হোলস ইন সেমিকন্ডাক্টরস। বইটি সে সময়ের সলিড স্টেট গবেষকেরা বাইবেলের মতো ব্যবহার করতেন। ১৯৫১ সাল থেকে শুরু হলো ট্রানজিস্টর উৎপাদন। ইলেকট্রনিকসের জগতে বিপ্লব শুরু হয়ে গেল।
এ বিপ্লবের অন্যতম নায়ক উইলিয়াম শকলি, তাতে সন্দেহ ছিল না কারোরই। নিত্যনতুন বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানী ধারণায় ভরপুর ছিলেন তিনি। প্রতি সপ্তাহে তিনি মিটিং ডেকে নতুন নতুন গবেষণার ফলাফল ঘোষণা করতেন। উৎসাহে টইটম্বুর থাকতেন সব সময়। উদ্ভাবক হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ। ৯০টির বেশি পেটেন্ট লাভ করেছিলেন। ১৯৫১ সালে মাত্র ৪১ বছর বয়সে আমেরিকার ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সের ফেলো মনোনীত হন। তিনি ছিলেন সে সময়ের সর্বকনিষ্ঠ ফেলো।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।