সারাহ রেইন্সফোর্ড, বিবিসি নিউজ (মস্কো): রাশিয়ার একটি সামরিক কার্গো বিমান আমাদের যেখানে উড়িয়ে নিয়ে আসলো সেটি প্রায় পৃথিবীর মাথার ওপর। উত্তর মেরুর কাছাকাছি এই দ্বীপপুঞ্জ একসময় বিরল প্রকৃতির কিছু পাখি আর সিন্ধুঘোটকের জন্য বিখ্যাত ছিল।
কিন্তু ফ্রানয জোসেফ ল্যান্ড নামের এই জায়গাটিতে এখন আছে রাশিয়ার অত্যাধুনিক সামরিক ঘাঁটি। উত্তর মেরু নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কে বাড়তি উত্তেজনার উৎস এখন এই ঘাঁটি।
যুক্তরাষ্ট্র আবারও মস্কোর বিরুদ্ধে এরকম অভিযোগ তুলেছে যে, তারা উত্তর মেরু অঞ্চলের ‘সামরিকায়ন’ ঘটাচ্ছে। অন্যদিকে রাশিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় নৌবহরের প্রধান বিবিসিকে বলেছেন, মেরু অঞ্চলে নেটো এবং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক তৎপরতা স্পষ্টতই ‘উস্কানিমূলক’ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এরকম মাত্রার সামরিক তৎপরতা আর দেখা যায়নি।
উত্তর মেরুকে রাশিয়া যেভাবে অগ্রাধিকার দিচ্ছে
রাশিয়ার মারমানস্ক হতে উত্তর মেরুর কাছে আলেক্সান্ড্রা দ্বীপে আমাদের ফ্লাইট পৌঁছাতে সময় লাগলো দুই ঘণ্টা। আমরা হচ্ছি বিদেশি সাংবাদিকদের প্রথম দল, যাদের এই জায়গাটি দেখাতে নিয়ে আসা হয়েছে।
এখানে বিমান নামার জন্য যে এয়ারফিল্ডটি আছে, সেটির অনেক উন্নয়ন করা হয়েছে, যাতে সারা বছরই সব ধরণের বিমান এখানে নামতে পারে। তবে বিমান থেকে টারমাকে নামার পর যেন আইস রিংকে পা দেয়ার মতো অনুভূতি হবে।
উত্তর মেরুর শীর্ষ থেকে এই জায়গাটি মাত্র ৯৬০ কিলোমিটার নিচে। এখানে আবহাওয়া খুবই চরম, মে মাসের মাঝামাঝিতেও ঘন তুষারপাত আর তুষার ঝড়। আমরা যখন ঝাঁকুনি খেতে খেতে একটি মিলিটারি ট্রাকে চড়ে যাচ্ছি, জানালা দিয়ে আমি তুষারের শুভ্রতা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না।
শীতকালে এখানে তাপমাত্র নেমে যায় মাইনাস ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি। তখন ঘাঁটির কাছাকাছি এসে ঘোরাঘুরি করে যেসব মেরু ভাল্লুক, তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার জন্য সৈন্যরা মাঝে মাঝে তাদের ট্রাক নিয়ে তাড়া করে।
কিন্তু তারপরও রাশিয়া এই অঞ্চলে তার সামরিক উপস্থিতি বাড়ানোকে খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে।
যেন একটি ‘মহাকাশ স্টেশন’
এই সামরিক ঘাঁটির কাঠামোর মাধ্যমেও যেন রাশিয়া একটা বার্তা দিতে চাইছে: এটির চারিদিক রুশ পতাকার রঙে রাঙানো, চারিদিকের তুষার শুভ্র ক্যানভাসের বিপরীতে ফুটে আছে এই উজ্জ্বল রঙ।
তিন পাতার নকশার কারণে এই ঘাঁটি পরিচিত ‘আর্কটিক ট্রেফয়েল’ নামে। উত্তর মেরুতে এটি রাশিয়ার এধরণের দ্বিতীয় ঘাঁটি, যেখানে থাকে দেড়শো সৈন্য।
ঘাঁটিটি ঘুরিয়ে দেখানোর আগে এখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত অধিনায়ক জানালেন, এটি এত অত্যাধুনিক প্রযুক্তির এবং পরিবেশবান্ধব যে, এটি ‘মহাকাশ স্টেশনের’ মতোই। পার্থক্য একটাই, কক্ষপথের পরিবর্তে এটি বসানো হয়েছে উত্তর মেরুর বিশাল শূন্যতার মাঝখানে।
তবে আসল ঘটনা ঘাঁটির ভেতরে নয়, বাইরে। সেখানে রাশিয়ার বাস্টিয়ন মিসাইল লঞ্চার বা ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ যন্ত্রটির ফায়ারিং মেকানিজম উর্ধ্বমুখী করে তারপর আবার নিচে নামিয়ে আনা হচ্ছে। পাশে সাদা পোশাকধারী এক সেনা বুকের কাছে তার বন্দুক ধরে রেখে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকায় দাঁড়িয়ে।
এই মিসাইল সিস্টেম রাখা হয়েছে “শত্রুদের জাহাজ ধ্বংস করার জন্য”, জানালেন একজন সৈনিক। এগুলো খুবই কার্যকর অস্ত্র, বললেন তিনি।
রাশিয়ার নর্দার্ন ফ্লিট বা উত্তরাঞ্চলীয় নৌবহর এবছর তাদের সামরিক শক্তির এক বিরাট মহড়া দেখিয়েছিল। তিনটি পারমাণবিক সাবমেরিন তখন বরফ কেটে একসঙ্গে এগিয়ে গেছে উত্তর মেরুর দিকে।
রুশ সাবমেরিনের এরকম অভিযান এর আগে কখনো দেখা যায়নি। ঐ একই মহড়ার সময় রাশিয়ার দুটি যুদ্ধ বিমান উত্তর মেরুর উপর দিয়ে উড়ে যায়, এগুলোতে তেল ভরা হয় মধ্য আকাশে।
রাশিয়ার এসব সামরিক মহড়া নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং নেটো বেশ চিন্তিত। কারণ স্নায়ু যুদ্ধের পর উত্তর মেরুতে রাশিয়ার এরকম ব্যাপক সামরিক উপস্থিতি আর দেখা যায়নি।
নেটোর মুখপাত্র নিশ্চিত করেছেন যে, রাশিয়ার এসব তৎপরতার ফলে নিরাপত্তার জন্য যে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে, তার জবাবে জোটের পক্ষ থেকে টহল এবং মহড়া বাড়ানো হয়েছে ।
আমরা এই দ্বীপপুঞ্জে যাওয়ার আগে বাসে করে একটি ফৌজি শহর সেভেরোমোরস্কে নোঙর করা এক যুদ্ধজাহাজ দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়। জাহাজটি ২৫২ মিটার লম্বা, পরমাণু শক্তিচালিত।
‘পিটার দ্য গ্রেট’ নামের এই জাহাজ রাশিয়ার নর্দার্ন ফ্লিটের সবচেয়ে বিশালাকায় জাহাজগুলোর একটি।
রুশ যুদ্ধজাহাজ
জাহাজে আমাদের অভ্যর্থনা জানান এই নর্দার্ন ফ্লিটের অধিনায়ক অ্যাডমিরাল আলেক্সান্ডার মোইসেয়েভ। তিনি আমাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন রাশিয়ার জার প্রথম পিটারের এক ছবির সামনে দাঁড়িয়ে। রাশিয়ার নৌবাহিনী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জার পিটার এবং রাশিয়াকে তিনি পশ্চিমমুখী করে তুলেছিলেন।
তবে রুশ অধিনায়ক আলেক্সান্ডার মোইসেয়েভ উত্তর মেরুতে যে সংঘাতের ঝুঁকি বেড়ে গেছে সেজন্যে নেটো বাহিনী এবং যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক পদক্ষেপকে দায়ী করলেন।
উত্তর মেরু অঞ্চলে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ার জন্য নেটো যে রাশিয়াকেই দায়ী করছে , সেটা যখন আমি অ্যাডমিরাল মোইসেয়েভকে বললাম, জবাবে তিনি বললেন, “এখানে বহু বছর, বহু দশক পর্যন্ত নেটোর এতো বাহিনীর উপস্থিতি আর দেখা যায়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তো নয়ই। রাশিয়ার সীমান্তের এত কাছে তাদের এসব তৎপরতাকে আমরা উস্কানি হিসেবেই দেখি। কারণ এখানে আমাদের অনেক মূল্যবান সম্পদ আছে। এটা দিয়ে আমি বোঝাতে চাইছি আমাদের পরমাণু শক্তির কথা।”
১৯৯০ এর দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ভেঙ্গে গেল, তখন রাশিয়া যেসব এলাকা ত্যাগ করে চলে এসেছিল, সেসব জায়গাতেই তারা এখন ফিরে এসে সামরিক শক্তি বাড়িয়ে চলেছে।
“আমরা আমাদের সীমান্ত রক্ষার জন্য আমাদের সক্ষমতা পুনরায় তৈরি করছি মাত্র, কাউকে হুমকি দেয়ার জন্য নয়,” বলছেন এমজিমো বিশ্ববিদ্যালয়ের উত্তর মেরু বিষয়ক বিশেষজ্ঞ লেভ ভরোনকোভ।
“সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ভেঙ্গে গেল, তখন ঐ অঞ্চলের সীমান্ত ফাঁড়িগুলো পর্যন্ত কোন সীমান্তরক্ষী ছাড়া ফাঁকা ফেলে রাখা হয়েছিল।”
তবে এরকম ঘটার সুযোগ আর নেই। কারণ মেরু অঞ্চলের বরফ গলছে। ফলে রাশিয়ার এই সীমান্ত রক্ষার জন্য যে প্রাকৃতিক বাধা ছিল, সেটি অপসারিত হচ্ছে। দেশটির বিস্তীর্ণ উত্তর সীমান্তের নিরাপত্তা তাই নাজুক হয়ে পড়ছে।
নতুন সম্ভাবনার অঞ্চল
ক্যামেরার সামনে যখন রাশিয়ার বাস্টিয়ন মিসাইলের নানা কসরৎ চলছে, তখন আমি দেখলাম দূরে জমাট বাঁধা বরফ কেটে এগিয়ে যাচ্ছে একটি রুশ আইস-ব্রেকার, তার পেছন পেছন চলেছে একটি ছোট কার্গো জাহাজ। তাদের পেছনে এক ভাসমান বরফখণ্ডের ছায়া।
এই দ্বীপপুঞ্জ ঘিরে উত্তরের যে সমূদ্র পথ, জাহাজগুলো সেই পথ ধরে চলেছে। রাশিয়া আশা করছে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে বরফ গলে উত্তর মেরুতে যে সমূদ্রপথ তৈরি হবে, তখন এই পথে জাহাজ চলাচল সহজ হবে। আর তারাই এই সমূদ্রপথ নিয়ন্ত্রণ করবে। আর এখানে সাগরের নীচে মওজুদ যে বিপুল তেল এবং গ্যাস সম্পদ, সেটা রপ্তানি করে তারা বিপুল বাণিজ্য করতে পারবে।
অ্যাডমিরাল মোইসিয়েভ মনে করেন, তার সৈন্যরা রাশিয়ার সীমান্ত রক্ষার পাশাপাশি এই বিরাট অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে প্রধান হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে।
উত্তর মেরুকে ঘিরে এই প্রতিযোগিতায় উত্তেজনা বাড়ছে। রাশিয়া আমাদেরকে ফ্রানয জোসেফ ল্যান্ডে নিয়ে নিজেদের সামরিক পেশী প্রদর্শনের একটা সুযোগ পেল এবং একটা বার্তাও পাঠালো: উত্তর মেরু নিয়ে তাদের বিরাট উচ্চাকাঙ্খা আছে, এবং এখানে তাদের যেসব স্বার্থ আছে, সেগুলো রক্ষায় তারা প্রস্তুত।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।