উপকূলের পতিত জমিতে বিনা চাষে গম
জুমবাংলা ডেস্ক : জমিতে ধান থাকা অবস্থায় সেই ক্ষেতে গমবীজ ছিটিয়ে ফসল চাষাবাদকে রিলে পদ্ধতিতে গম চাষ বলা হয়ে থাকে। অস্ট্রেলিয়া-বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে উপকূলের পতিত নোনাজমিতে আমন ধান কাটার ২০-২৫ দিন আগেই গত ১৪ নভেম্বর ২৮ জন কৃষকের ধানের জমিতে গমবীজ ছিটিয়ে দেওয়া হয়। আশপাশের কৃষক তো বটেই, এই ২৮ জন কৃষকও ধানের জমিতে এভাবে গমবীজ ছিটানোকে নিছক পাগলামি মনে করলেন।
গমবীজ ছিটানোর সময় জমির মাটি কিছুটা ভেজা ভেজা ছিল। এ সময় জমিতে লবণাক্ততা অনেক কম থাকে। গমবীজ ছিটানোর তিন-চার দিনের মধ্যেই এর থেকে চারা গজাতে শুরু করল। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, এই ধানের জমিতেই গমের চারা বড় হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হলো- কেন ধানের জমিতে এভাবে গমের বীজ ছিটানোর প্রয়োজন হলো! গম ফসল শীত পছন্দ করে। গম গাছের বৃদ্ধিকালে ১৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচের তাপমাত্রায় গম গাছ ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারে। সে কারণে মধ্য নভেম্বরে জমিতে গমবীজ বপন করলে জানুয়ারি মাসের প্রথমার্ধে গম গাছ তার বৃদ্ধির সময়ে কাঙ্ক্ষিত তাপমাত্রা পাবে, ওই সময়ে ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারবে এবং ভালো ফলন দিতে সক্ষম হবে।
যেহেতু নভেম্বর মাসে জমিতে আমন ধান থাকে, সে কারণে গমবীজ মধ্য নভেম্বরেই ধানের জমিতে ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে উপযুক্ত তাপমাত্রায় গম ফসল ভালোভাবে বেড়ে উঠছে এবং ভালো ফলন দিতে সক্ষম হচ্ছে।
এর মধ্যে ধান পাকতে শুরু করল। কৃষকরা ডিসেম্বরের ৫ তারিখের মধ্যেই তাঁদের সব ধান কেটে ফেললেন। ধান কাটার সময় কৃষকরা একটু ওপর থেকে তাঁদের ধান কাটলেন, যাতে গমের চারাগুলো না কাটা পড়ে। এরপর কৃষকেরা গমের জমিতে পরিমাণমতো সার ছিটালেন। সার পেয়ে গাছগুলো তরতাজা হয়ে উঠল। স্থানীয় কৃষকরা এ পর্যন্ত এটাকে পাগলামি হিসেবেই দেখলেন।
কৃষকরা এরপর জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে হঠাৎ করেই দেখলেন গম গাছে প্রচুর শিষ বের হচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে এ খবর সারা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। আমন ধান কাটার পর যেখানে হাজার হাজার কৃষকের জমি পতিত পড়ে আছে, সেখানে এই ২৮ জন কৃষকের জমিতে গমের প্রচুর শিষ বের হচ্ছে- এ যেন অভাবনীয়, অকল্পনীয়।
সত্যতা যাচাই করতে কৃষকরা দলবেঁধে চলে এলেন। প্রোভার্টি ইরাডিকেশন প্রোগ্রাম নামে যে সংস্থাটি ড. নিয়োগীর তত্ত্বাবধানে কৃষকের মাঠে এই কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছিল, তারাও নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ল। বাংলাদেশ গম ও ভুট্টা গবেষণা ইনস্টিটিউটের ড. মুস্তাফা খানের পরামর্শে উপরি সার প্রয়োগ হলো। পাশের পুকুর থেকে সেচ দেওয়া হলো। অতিরিক্ত বৃষ্টির পানি যেন জমির ফসল নষ্ট করতে না পারে, সে জন্য আগে থেকেই নিস্কাশন ব্যবস্থা ছিল।
গত ১৩ ফেব্রুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার বিজ্ঞানীরা এলেন। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা এলেন। নীতিনির্ধারকরা এলেন। গম বিশেষজ্ঞরা এলেন। সাংবাদিকরা এলেন। পতিত নোনাজমিতে গম দেখলেন। কৃষকদের সঙ্গে কথা বললেন। অভিভূত হলেন। সব জল্পনা-কল্পনা-অবিশ্বাসকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের দৌলতপুর এবং আশপাশের গ্রামের হাজার হাজার কৃষক লবণাক্ত পতিত জমিতে অসাধারণ গম প্রত্যক্ষ করলেন।
বিনা চাষে কম খরচে যে গম কৃষকরা উৎপাদন করলেন, তা সত্যিই অবিশ্বাস্য। অস্ট্রেলিয়া সরকারের সহযোগিতায় ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া এবং প্রোভার্টি ইরাডিকেশন প্রোগ্রাম এই প্রযুক্তিটি ড. নিয়োগীর তত্ত্বাবধানে উপকূলের পতিত জমিতে বাস্তবায়ন করছে। ড. মুস্তাফা খানের প্রয়োজনীয় কারিগরি পরামর্শ সবসময় নেওয়া হচ্ছে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও ক ভি ডে র কারণে দেশে যেন খাদ্য ঘাটতি না হয় সেজন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। বিনা চাষে কম খরচে কৃষকরা গম উৎপাদন করতে পারলে বিদেশ থেকে খাদ্য দ্রব্যটির আমদানিনির্ভরতা কমবে। আমাদের দেশের মাটিতে পরীক্ষামূলকভাবে প্রকল্পটি সফল হয়েছে। এটির ব্যাপক প্রসার দরকার। কৃষকরা সহজে এটিকে গ্রহণ করতে চাইবে না; কিন্তু আমরা যে সফলতা দেখিয়েছি তা তাদের সামনে তুলে ধরতে হবে। একই জমিতে একই সময়ে বিকল্প ফসল আবাদ করতে পারলে দ্বিগুণ ফসল পাওয়া যায়। অথচ এতে মাটির গুণাগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে। রিলে পদ্ধতিতে গম আবাদে আলাদাভাবে চাষাবাদের দরকার হয় না। এতে খরচ বাঁচে।
আমরা আশা করি প্রধানমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, কৃষি সচিবসহ নীতিনির্ধারকরা উপকূলের লবণাক্ত পতিত জমিতে এই প্রযুক্তি সামনের নভেম্বর মাসেই গমের মৌসুমে অন্তত একটি টেস্ট কেস হিসেবে বাস্তবায়ন করবেন। এ ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়ার সংশ্নিষ্ট গবেষণা সংস্থা প্রয়োজনীয় কারিগরি সহায়তা দিতে প্রস্তুত থাকবে।
ড. এম. জি. নিয়োগী: ডেপুটি প্রজেক্ট লিডার, ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন, অস্ট্রেলিয়া
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।