সানজানা চৌধুরী, বিবিসি বাংলা (ঢাকা): “আমরা টেকসই বেড়িবাঁধ চাই, সাহায্য আমাদের দরকার নাই, সাহায্য আমরা চাই না। আমরা চাই এদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বসবাসের জন্যি টেকসই বেড়িবাঁধ।”
বিবিসি বাংলার কাছে এভাবেই আকুতি জানাচ্ছিলেন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বাসিন্দা কৃষ্ণপদ মণ্ডল।

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে বেড়িবাঁধ ভেঙে তিনি আয় রোজগারের একমাত্র সম্বল চিংড়ি ঘের, ফসলি জমি সবই হারিয়েছেন। বসতভিটাতেও পানি উঠে গেছে।
গত ৩০ বছর ধরে চিংড়ি ঘের করে আসছেন তিনি। কিন্তু প্রতিবছর ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসে নিঃশেষ হয়েছেন বার বার।
একই পরিস্থিতি গ্রামের অন্যান্য বাসিন্দাদের। মুহূর্তের মধ্যে জীবন জীবিকার ওপর এমন আঘাতে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন এই অসহায় মানুষগুলো।
এই ক্ষয়ক্ষতির মূল কারণ হিসেবে তারা অভিযোগ করছেন টেকসই বাঁধ না থাকাকে।
কৃষ্ণপদ মণ্ডল আক্ষেপ করে জানান তাদের সহায়তার প্রয়োজন নেই, তারা চান যেন বাঁধ যেন ঠিক করে দেয়া হয়।
তিনি বলেন, “সবার চিংড়ি ঘের সব মাইর গেসে। গরিব মানুষের কথা কি বলবো, এর আগে আম্পানে গেলে, আইলায় গেলে, এবারও জলে গেলে, টেকসই বেড়িবাঁধ না হলে আমরা তো টিকতি পারবো না।”
ঘূর্ণিঝড় ইয়াস বাংলাদেশে আঘাত না হানলেও উপকূলবর্তী এলাকাগুলোর বেড়িবাঁধ ভেঙে গিয়ে ১৪টি জেলার ২৭টি উপজেলার অন্তত কয়েকশ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে বলে জানিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়।
তারমধ্যে পূর্ণিমা ও পূর্ণগ্রাস চন্দ্রগ্রহণের প্রভাবেও পানির উচ্চতা বেড়েছে কয়েকফুট।
কিন্তু ষাটের দশকে নির্মিত দক্ষিণাঞ্চলের এসব মাটির বাঁধের এখন এতোই জরাজীর্ণ অবস্থা যে জোড়াতালি দিয়েও জলোচ্ছ্বাস ঠেকানোর মতোও অবস্থা নেই।
বছরের পর বছর ভাঙতে ভাঙতে উচ্চতা, প্রতিরোধ ক্ষমতা এতোটাই কমে গেছে যে কয়েকটি এলাকার মানুষ নিজ উদ্যোগে মাটি চাপা দেয়ার চেষ্টা করেও পানির তোড় আটকাতে পারেনি।
অথচ সরকার প্রতিবছর বাঁধ নির্মাণ বাবদ কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে আসছে বলে খবর প্রকাশ হতে দেখেছেন সাতক্ষীরার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ভবতোষ কুমার মণ্ডল।
কিন্তু তিনি বা স্থানীয়দের কেউ তাদের এলাকায় দৃশ্যত কোন কাজ হতে দেখেননি বলে অভিযোগ করেন।
মি. মণ্ডল জানান, টেকসই বেড়িবাঁধের কোন উদ্যোগ গ্রহণ না করায় তার এলাকার ২৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধের ২৫ কিলোমিটার উপচে পানি প্রবেশ করেছে। ১৫টি স্পট ভেঙে গেছে।
কালেভদ্রে এই বেড়িবাঁধ মেরামত করা হলেও খোঁজ খবর নিয়ে তারা জানতে পেরেছেন যে ঠিকাদার বদল হতে হতে সেই কাজ তারা করতে দেখেছেন লেবার ঠিকাদারদের। যাদের কাজে কোন গুণগত মান থাকে না।
অনেক সময় মানুষের মাটি চাপা দেয়া ভঙ্গুর কাঠামোর ওপর রাস্তা বানিয়ে কাজ দেখানো হয়। যা শেষ পর্যন্ত পানি ঠেকাতে কোন কাজে আসেনা। সামান্য জলচ্ছ্বাসেই তলিয়া যায়।
মি. মণ্ডল আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “গ্রামের মানুষ মিলে মাটি দিয়েও আমরা বাঁধ রক্ষা করতে পারিনি। বরাদ্দের কথা তো অনেক শুনি, কাজ তো দেখিনা। উল্টো মানুষ এসে চেয়ারম্যানকে ধরে। অথচ কোথায় কী টেন্ডার হয়, কতো বরাদ্দ আমরা কিছুই জানি না। যদি এই এলাকায় স্থায়ী বেড়িবাঁধ না হয়, তাহলে আগামী যে প্রজন্ম আসবে, তারা টিকতে পারবে বলে মনে হয় না।”
ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান নিজেও সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, দক্ষিণাঞ্চলের অনেক মাটির বাঁধ সরু হতে হতে জমির আইলের মতো হয়ে গেছে।
এসব বাঁধে জোড়াতালি দিয়ে বড় দুর্যোগে খুব একটা সুরক্ষা দেয়া সম্ভব না।
তবে ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি এলাকা চিহ্নিত করে সেখানে এরিমধ্যে বাঁধ মেরামত ও স্থায়ীভাবে পুনর্নির্মাণের কাজ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পানি সম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম।
স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের বিষয়টি সময়সাপেক্ষ বলে তিনি জানান।
মি. হক বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ার কারণে লক্ষ কোটি টাকার প্রকল্প পাস হচ্ছে। সে লক্ষ্যে সরকার স্থায়ী সমাধানের দিকেই যাচ্ছে।
এরিমধ্যে বেশ কয়েকটি প্রকল্প পাস হয়েছে। যেসব বাধে ঝুঁকি বেশি সেগুলোর কাজ প্রক্রিয়াধীন আছে।
উপমন্ত্রী বলেন, “প্রকল্পগুলো চলছে, কোথাও কাজ শুরু হয়েছে, কোথাও চলছে, কোথাও হবে। সবগুলো তো আর একসাথে বাস্তবায়ন করা যাবে না। এগুলোয় সময় লাগে।”
“যেসব এলাকার বাঁধ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ আমরা পর্যায়ক্রমে সেই বাঁধগুলো উঁচু করছি, প্রশস্ত করছি। আমাদের লক্ষ্য সব জায়গায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ। তার আগ পর্যন্ত মেরামতের কাজ চলবে।”
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাধ নির্মাণসহ সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে ২০০ কোটি টাকার মতো দুর্নীতি অনিয়ম হয়েছে বলে গত বছর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল টিআইবি।
এ ব্যাপারে উপমন্ত্রী জানিয়েছেন যে প্রকল্পের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে তারা কাজ করে যাচ্ছেন।
এরিমধ্যে বেশ কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে তারা কালো তালিকাভুক্ত করেছেন বলে জানান।
এছাড়া দুর্নীতির কোন অভিযোগ পেলেই তারা দ্রুততম সময়ে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।


