রঞ্জু খন্দকার, গাইবান্ধা থেকে : শীতসকালে একটু উষ্ণতার খোঁজে রোদ পোহানো অনেকেরই প্রিয়। কিংবা কুয়াশার চাদরে সূর্যের লুকিয়ে থাকা দিনগুলোয় কনকনে ঠান্ডা থেকে বাঁচতে এমনকী দুপুর-বিকেলসহ ভোর-সন্ধ্যা-রাতে আগুন পোহানো অনেকের কাছেই জরুরি। কিন্তু এই আগুন পোহাতে গিয়ে অনেকেই শিকার হচ্ছেন দুর্ঘটনার। দগ্ধ হয়ে হচ্ছেন আহত। এমনকী পুড়ে মারা যাচ্ছেন কেউ কেউ। গত ১২ দিনে উত্তরাঞ্চলে অন্তত ৪৩ জন আগুনে দগ্ধ হয়েছেন।
উত্তরাঞ্চলের লোকজন জানান, উত্তরবঙ্গসহ দেশের তুলনামূলক দরিদ্র এলাকাগুলোয় খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণ খুবই পরিচিত দৃশ্য। অনেকেই লাকড়ির চুলার পারে বসে নেন আগুনের উত্তাপ। এখন অনেকের ঘরে সিলিন্ডার আসায় কেউ কেউ গ্যাসের চুলায়ও সেঁকে নেন হাত-পাসহ শরীর। এ সময়ই ঘটে দুর্ঘটনা।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা স্কুলশিক্ষক শামসুল আলম বলেন, প্রতিবার শীতে আগুন তাপাতে (পোহাতে) গিয়ে অনেকেই দগ্ধ হয়ে মারা যান। কেউ পঙ্গুও হন। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে তেমন প্রচার-প্রচারণা নেই। যেন তেমন কিছু নয়। অথচ সামান্য সচেতন হলেই এসব মানুষ আগুন থেকে রক্ষা পেত।
গাইবান্ধার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কয়েকদিনের জবুথবু শীতে উষ্ণতা পেতে এবারও আগুন জ্বালিয়ে তাপ পোহানো শুরু করেছেন গ্রামের নিম্ন আয়ের মানুষেরা।
চিকিৎসকসহ সচেতন মানুষেরা বলছেন, আগুন পোহানোর সময় বেশি দগ্ধ হচ্ছেন বৃদ্ধ ও শিশুরা। বৃদ্ধদের মধ্যে নারীর সংখ্যা বেশি। বৃদ্ধ ও শিশুরা আগুন পোহানোর সময় অতটা সতর্ক থাকেন না। অনেক সময় কাপড়ে আগুন লাগা টের পেলেও লাজলজ্জার ভয়ে নারীরা সহজে শরীর থেকে কাপড় খুলতে চান না। তখনই ঘটে বিপত্তি। প্যাঁচানো কাপড়ে আগুন পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
স্থানীয় বাসিন্দা সূত্রে জানা যায়, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায় আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হয়ে জবা রানী (৭৫) নামের এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। গত শুক্রবার রাত ১০টার দিকে পৌর শহরের ১ নম্বর ওয়ার্ডের কর্ণিপাড়া মহল্লায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। জবা মৃত বিপিন চন্দ্র সরকারের স্ত্রী।
সুন্দরগঞ্জ পৌরসভার প্যানেল মেয়র মো. ছামিউল ইসলাম জানান, তীব্র শীত থেকে বাঁচতে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে বাড়ির আঙিনায় খড়ের আগুন জ্বালিয়ে তাপ নিচ্ছিলেন জবা। এ সময় অসাবধানতাবশত খড়ের আগুন কাপড়ে লেগে তাঁর শরীর দগ্ধ হয়। আশপাশের লোকজন তাঁকে উদ্ধার করে সুন্দরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করান। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে জবাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন তাঁরা । শুক্রবার রাতে জবার মৃত্যু হয়।
উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ রোগী রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। এবার গত ১০ দিনেই এ হাসপাতালে ৪২ জন দগ্ধ রোগী ভর্তি হয়েছেন। এদের সবাই আগুন পোহাতে গিয়ে পুড়ে দগ্ধ হয়েছেন।
রংপুর মেডিকেল কলেজের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত ৪৮ ঘণ্টায় দগ্ধ হয়ে এখানে ৫ জন ভর্তি হয়েছেন। গত ১০ দিনের ব্যবধানে এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন ৪২ জন দগ্ধ রোগী। এর মধ্যে বার্ন ইউনিটে ১১ জন এবং সার্জারি, শিশু ও মহিলা ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন ৩১ জন। আক্রান্ত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।
একই সূত্র জানায়, সর্বশেষ ৪৮ ঘণ্টায় ওই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৫ জন হলেন কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার সাজু মিয়ার স্ত্রী ববিতা বেগম (৩৫), ফুলবাড়ীর আশরাফুল আলমের মেয়ে আয়শা সিদ্দিকা (৬), রংপুর নগরের মুন্সিপাড়া এলাকার আলেয়া বেগম (৬৫), লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার সবুজ চন্দ্র রায়ের স্ত্রী পলি রানী (৩০) ও নীলফামারীর ডিমলার মমিনুর ইসলামের স্ত্রী খাদিজা বেগম (৪০)। তাঁরা খড়কুটো জ্বালিয়ে ও চুলার আগুনে শীত নিবারণ করতে গিয়ে দগ্ধ হয়েছেন।
এ হাসপাতালের ৯ নম্বর শয্যায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার পলি রানী। তাঁর শাশুড়ি আরতি রানী জানান, তীব্র ঠান্ডায় আগুন পোহাতে গিয়ে পলির কাপড়ে আগুন ধরে যায়। এতে তাঁর শরীরের নিচের অংশ পুড়ে গেছে। তাঁর শরীরের ৪৫ শতাংশ পুড়ে গেছে বলে চিকিৎসক জানিয়েছেন।
বার্ন ইউনিটের দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক ফারুক আলম বলেন, চিকিৎসাধীন রোগীরা আগুন পোহানোসহ গরম পানি ব্যবহার করতে গিয়ে দগ্ধ হয়েছেন। বার্ন ইউনিটে ১২টি শয্যার মধ্যে ১১ জন চিকিৎসাধীন। রোগীদের শরীরের ১০ থেকে ৪৫ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে।
বারবার শীতকালে আগুন পোহাতে গিয়ে দগ্ধ হওয়ার বিষয়টি দুঃখজনক ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের অবহেলা বলে মনে করেন গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার সুলতানপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক শাহওয়াজ কবির। তিনি বলেন, প্রতিবারই গাইবান্ধাসহ উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় আগুন তাপাতে গিয়ে অনেকে পুড়ে আহত হচ্ছেন। অনেকেই মারা যাচ্ছেন। সতর্কতা ও সচেতনতার অভাবেই এসব দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে, বারবার ঘটছে। দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের উচিৎ বিষয়টি নিয়ে হেলাফেলা না করে এ বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা চালানো।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।